ই-পেপার রোববার ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪
রোববার ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪

লক্ষণ ভালো সুফল নেই
প্রকাশ: বুধবার, ২ আগস্ট, ২০২৩, ৩:০৫ এএম  (ভিজিট : ৩২৯)
ডলার সংকটের কারণে পণ্য আমদানিতে বেশ কড়াকড়ি আরোপ করেছিল সরকার। বিশেষ করে বিলাসীপণ্য আমদানিতে এক রকম নিষেধাজ্ঞাই ছিল। এর ফলও মিলেছে। এক বছরের ব্যবধানে পণ্য আমদানি কমেছে ২৫ বিলিয়ন ডলারের। এতে ডলার সাশ্রয় হয়েছে।

অন্যদিকে এক বছরের ব্যবধানে দেশে রফতানি আয় বেড়েছে সাড়ে ৫ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স আহরণের গতিও বেশ ভালো। রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স আহরণ বাড়ায় ডলারের সরবরাহ বেড়েছে। অন্যদিকে বিশ্ববাজারে কমে আসছে ডলারের তেজিভাব। সব উপকরণই দেশের বাজারে ডলার সংকট দূর হওয়ার জন্য সহায়ক। তবে বাস্তবে তেমনটি দেখা যাচ্ছে না। উপরন্তু দেশের বাজারে ডলার সংকট কাটছে না।

ব্যাংকগুলোতে ডলার সংকট এখনও প্রকট। চাহিদামতো এলসি বা ঋণপত্র খোলা যাচ্ছে না। ব্যাংকগুলো সময়মতো এলসি দায় ও বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। আন্তঃব্যাংক লেনদেনে এখনও ডলারের বিনিময় হার ১০৯ টাকার ওপরে। খোলাবাজারে সেটি ১১৩-১১৫ টাকায় বিনিময় হতে দেখা যাচ্ছে। আবার ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, ঋণপত্র খুলতে গেলে বা পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে এক ডলারের বিপরীতে ১২০-১২২ টাকাও নিচ্ছে কোনো কোনো ব্যাংক। সুতরাং দেশে ডলার সংকট এখনও স্পষ্ট। অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা বলছেন, ডলারের এই সংকট সহসা কেটে ওঠার কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে, দেশের বাজারে ডলারের সংকট ধীরে ধীরে কমে আসছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক ও ভারপ্রাপ্ত মুখপাত্র সরওয়ার হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, ‘আমরা মনে করি দেশে ডলার সংকট ধীরে ধীরে কমে আসছে। ডলারকেন্দ্রিক যেসব অস্থিরতা ছিল বাজারে সেগুলোও কমে এসেছে। ডলার সংকট যে কমে আসছে সেটি বোঝা যাবে বেশ কিছু তথ্য বিশ্লেষণ করলেই। যেমন কয়েক দিন আগেও ডলারের মার্কেট লিকুইডিটি ছিল ২ বিলিয়ন ডলারের। এখন সেটি বেড়ে হয়েছে ৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের। সরকার বিলাসীপণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করেছে। এর ফলে এক বছরের ব্যবধানে আমদানি কমেছে ২৫ বিলিয়ন ডলারের। ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে আমদানি ছিল ৯৪ বিলিয়ন ডলারের। সদ্যবিদায়ি ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানি কমে হয়েছে ৬৯ বিলিয়ন ডলারের। আবার গত এক বছরের ব্যবধানে দেশে রফতানি আয় বেড়েছে সাড়ে ৫ বিলিয়ন ডলারের। ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে রফতানি আয় হয়েছিল ৫০ বিলিয়ন ডলারের, ২০২২-২৩ অর্থবছরে হয়েছে ৫৫ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলারের। এ ছাড়া গত কয়েক মাস ধরেই রেমিট্যান্স আহরণ পরিস্থিতিও বেশ ভালো। এসব কারণে দেশে ডলারের সরবরাহ বেড়েছে। সব মিলিয়ে আগের চেয়ে দেশের বাজারে ডলার সংকট অনেকটাই কমে এসেছে।’

তবে ডলার সংকট কমে এসেছে-এ কথা মানতে নারাজ অর্থনীতিবিদ ও দেশের ব্যবসায়ীরা। তাদের ভাষ্য, ডলার সংকট কমেনি, বরং আগের মতোই আছে। আর সংকট সহসা কাটবেও না।

এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, ‘দেশে ডলার সংকট যদি কাটত তা হলে তো ব্যাংকগুলোতে এলসি খোলার সংকট দূর হতো। তা হলে তো ব্যাংকগুলো সময়মতো এলসি দায় ও বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে পারত। ব্যাংকগুলো তো সেটি পারছে না। তা হলে কীভাবে বলব, ডলার সংকট আগের চেয়ে কমেছে। বাস্তবতা হচ্ছে, ডলার সংকট এখনও কাটেনি, সহসা কাটবেও না। আগামী ডিসেম্বরের আগে দেশে ডলার সংকট কাটবে বলে আমার মনে হয় না। তবে বিশ্ববাজারে ডলার কিছুটা দুর্বল হয়েছে, দেশে আমদানি কমেছে, রফতানি বেড়েছে এবং রেমিট্যান্সও ভালো আসছে। এসব কারণে দেশের বাজারে ডলারের সংকটময় পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হওয়ার দরকার ছিল, কিন্তু সেটি হয়নি এখনও। বিষয়টি নিয়ে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ভাবতে হবে।’

ব্যবসায়ীরাও বলছেন, ডলার সংকট কাটেনি বরং এখনও পদে পদে বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সময়ের আলোকে বলেন, ‘পোশাকের কাঁচামাল আমদানিতে এলসি খুলতে গেলেই টের পাওয়া যাচ্ছে ডলার সংকট কতটা রয়েছে। একদিকে ব্যাংকগুলো ডলার সংকটের কারণে সময়মতো এলসি খুলতে পারছে না, অন্যদিকে এলসি খুললেও এক ডলারের বিপরীতে দিতে হচ্ছে ১২০-১২২ টাকা। ডলার সংকটের কারণে সময়মতো পণ্য আমদানি করতে পারছি না। এতে কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, ক্রেতাকেও সময়মতো পণ্য পাঠাতে পারছি না। জানি না কবে ডলার ক্রাইসিস থেকে রেহাই পাব।’

বিশ্ববাজার পরিস্থিতি বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, ডলারের তেজিভাব বেশ কমে এসেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ডলারের দাম দুই দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছিল বিশ্ববাজারে। তবে এখন বেশ কমে এসেছে সে তেজিভাব। গত সপ্তাহে ইউএস ডলার ইনডেক্স গত এক বছরের বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে নিচে নেমে এসেছে। ব্রিটিশ পাউন্ড, ইউরো, সুইস ফ্রাঁ, জাপানের ইয়েন, কানাডিয়ান ডলার ও সুইডেনের ক্রোনার বিপরীতে ডলার ইনডেক্স ঠিক করা হয়। এতে দেখা যাচ্ছে, ডলারের বিপরীতে এসব মুদ্রার মান বাড়ছে। সে অনুযায়ী দেশেও ডলারের বিপরীতে টাকা শক্তিশালী হওয়ার কথা।

দেশের বাজারে ডলারের তেজিভাব কমানোর দাবি আরও জোরালো করছে রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধির কারণে ডলারের সরবরাহ বৃদ্ধি। গত এক বছরের ব্যবধানে দেশে রফতানি আয় যেমন বেড়েছে সাড়ে ৫ বিলিয়ন ডলারের, তেমনি রেমিট্যান্সও বেড়েছে বিগত কয়েক মাস।

রেমিট্যান্সের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১৯৭ কোটি ৩০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। ঈদের মাস জুনে রেমিট্যান্স এসেছিল ২১৯ কোটি ৯০ লাখ ডলার, যা গত ৩৫ মাসের মধ্যে ছিল সর্বোচ্চ। আর একক মাস হিসেবে এ অঙ্ক এ যাবৎকালে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এর আগে ২০২০ সালের জুলাইয়ে দেশে সর্বোচ্চ ২৫৯ কোটি ৮২ লাখ ডলারের প্রবাসী আয় এসেছিল। 

সদ্যবিদায়ি ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট রেমিট্যান্স এসেছে ২ হাজার ১৬১ কোটি ৬ লাখ মার্কিন ডলার। আগের ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট রেমিট্যান্স এসেছে ২ হাজার ১০৩ কোটি ১৭ লাখ মার্কিন ডলার। আর বিদায়ি ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন ২ হাজার ১৬১ কোটি মার্কিন ডলারের রেমিট্যান্স। এটি এ যাবৎকালের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এর আগে করোনাকালে ২০২০-২১ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৪৭৭ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স এসেছিল দেশে।

এসব কারণে দেশে ডলার সংকট কিছুটা হলেও কাটার কথা। তবে বাস্তবতায় তেমনটি দেখা যাচ্ছে না। কারণ ব্যাংকগুলোর এলসি দায় ও বিদেশি ঋণ পরিশোধে শুধু ২০২২-২৩ অর্থবছরেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে। সদ্য গত হওয়া জুলাইয়েও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার বিক্রি অব্যাহত ছিল। চলতি মাসেই রিজার্ভ থেকে বিক্রির পরিমাণ ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে। গত ১৯ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রস হিসেবে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার। যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নির্দেশনা অনুযায়ী (বিপিএম৬) রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৩ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার।

চলতি বছরের জুন থেকে আগস্ট-এ তিন মাসে কী পরিমাণ আমদানির এলসি খোলা হতে পারে, সেটি প্রক্ষেপণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে দেখা যাচ্ছে, জুনে ৪৮৯ কোটি, জুলাইয়ে ৪৭৫ কোটি ও আগস্টে ৪৭৪ কোটি ডলারের এলসি খোলা হতে পারে। অর্থাৎ এ তিন মাসে মোট ১৪ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলার প্রাক্কলন করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, এ তিন মাসে ২৫০ কোটি ডলারের ব্যাক টু ব্যাক এলসি খোলা হতে পারে। যদিও জুন ও জুলাইয়ে এরই মধ্যে প্রাক্কলনের চেয়ে অনেক বেশি এলসি খুলেছে ব্যাংকগুলো।

এদিকে দেশের সাধারণ মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে নাজুক পরিস্থিতির কারণ হিসেবে ডলার সংকটকে দায়ী করা হয়। বছর দেড়েক আগেও বাংলাদেশে প্রতি ডলারের দাম ছিল ৮৫ টাকা, সেখান থেকে বেড়ে এখন ১০৯ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। বলা হয়ে থাকে, ডলারের বিপরীতে কোনো দেশের মুদ্রা ১০ শতাংশ দাম হারালে মূল্যস্ফীতি বাড়ে ১ শতাংশ।

বর্তমানে টাকার মান হারিয়েছে প্রায় ২২ শতাংশেরও বেশি। ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে গত ডিসেম্বরে দেশের মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক শূন্য ৫ থেকে বেড়ে ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ হয়েছিল, এখন সেটি ৯ শতাংশের ওপরে। ডলারের দামের পাশাপাশি আমদানি পণ্যের বাড়তি দাম মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে পণ্যসামগ্রীর এ বাড়তি দামের চাপ পড়ছে সাধারণ মানুষের ওপর। দেশের ইতিহাসে একসঙ্গে সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের মূল্য এতটা অস্বাভাবিক হারে আর কখনো বাড়তে দেখা যায়নি। এর পেছনে ব্যবসায়ীদের কারসাজি যেমন মুখ্য ভূমিকা রেখেছে, তেমনি ডলার সংকট ও ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণেও পণ্যমূল্য বেড়েছে।

সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close