প্রকাশ: মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ, ২০২৫, ৭:৪৬ পিএম (ভিজিট : ১০১৬)
আব্দুল মান্নান ও তার স্ত্রী। ছবি: সময়ের আলো
একাত্তরে তৎকালীন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পিস কমিটির সদস্য ওসমান হাজীর নির্দেশে ১৫ জন মুক্তিকামী জনতাকে আটক করা হয়। এরপর তাদের ব্রাশ ফায়ার করা হয়।
গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই ১৪ জন শহীদ হন। এসময় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান আব্দুল মান্নান নামের এক যুবক।
সোমবার (২৪ মার্চ) বেলা ৩টার সময় সময়ের আলোকে পাক-হানাদার বাহিনীর এমন নৃশংস হত্যার বর্ণনা দেন ওই দিন প্রাণে বেঁচে যাওয়া একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী আব্দুল মান্নান।
নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার উমার ইউনিয়নের, সীমান্তবর্তী কুলফৎপুর গ্রামের মৃত সিরাজ মন্ডলের ছেলে মান্নান। মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৮ বছরের যুবক মান্নানের বয়স এখন ৭২ বছর। বয়সের ভারে কপালে ও শরীরের চামড়ায় পড়েছে ভাঁজ। স্ত্রীসহ এক ছেলে ও তিন মেয়েকে নিয়ে তার অভাবের সংসার।
আব্দুল মান্নান। ছবি: সময়ের আলো
মুক্তিযোদ্ধার ভাতা তো নয়ই, স্বাধীনতার কয়েক যুগ পেরিয়ে গেলেও পরিবারে মেলেনি গণহত্যার স্বীকৃতি।
অন্যদিকে একমাত্র ছেলের চাকরির জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে তাকে। তবুও হয়নি গতি।
গণহত্যার শিকার পরিবার ও এলাকাবাসীরা ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, স্বাধীনতার কয়েক যুগ পেরিয়ে গেলেও সরকারের পক্ষ থেকে গণকবরটি সংরক্ষণ বা সংস্কারের জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়নি। অবহেলা, অযত্নে পড়ে থাকা নাম ফলকটি নষ্ট হতে বসেছে। শুধু তাই নয়, গণকবরের উপর গরু ছাগল আর মানুষের বিচরণ ভূমিতে পরিণত হওয়ায় সন্ধ্যা নামলেই বসে নেশাখোরদের আড্ডা। এ কারণে চতুর্দিকে একটি প্রাচীর দিয়ে গণকবরগুলো সংস্কারের দাবি জানানো হয়।
তারা বলেন, কুলফৎপুর গণকবরে কোনো বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়নি। অথচ প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বর এলেই নাম ফলকের পাদদেশে মোমবাতি প্রজ্বলনের মাধ্যমে উদযাপন করা হয় বুদ্ধিজীবী দিবস। এতে গণহত্যার শিকার মুক্তিকামী বীর শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা তো নয় বরং ইতিহাসকে বিকৃত করা হচ্ছে।
সঠিক ইতিহাস উদঘাটনের মাধ্যমে গণহত্যার শিকার বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের দাবি জানান তারা।
গণকবরে শহীদদের নাম ফলক। ছবি: সময়ের আলো
গণকবরে শহীদদের নাম ফলকের তথ্যসূত্রে জানা যায়, সীমান্তবর্তী উমার ইউনিয়নের কুলফৎপুর এলাকার মৃত বজির উদ্দীনের ছেলে শহীদ আমজাদ হোসেন, মৃত কফিলউদ্দিন মন্ডলের ছেলে শহীদ চান মদ্দীম মন্ডল, ইছরত আলী দেওয়ানের ছেলে শহীদ কছি মদ্দিন মন্ডল, মৃত সুবার উদ্দীনের ছেলে শহীদ ছয়েফ উদ্দীন, মৃত আবেদন আলী মন্ডলের ছেলে শহীদ আবতাব উদ্দীন, মৃত আবেদন আলী মন্ডলের ছেলে শহীদ তায়েজ উদ্দীন, মৃত সিরাজ উদ্দীন মন্ডলের ছেলে শহীদ মতিবল হোসেন, টুটিকাটা এলাকার মৃত ছবির উদ্দীনের ছেলে শহীদ আব্বাস আলী, মৃত শরিফ উদ্দীনের ছেলে শহীদ আবেদ আলী শহীদ হয়েছিলেন।
এছাড়া কৈগ্রাম এলাকার মৃত সালে মদ্দীনের ছেলে শহীদ রহিম উদ্দীন, মৃত মহির উদ্দীনের ছেলে শহীদ ফয়জুল ইসলাম, মৃত কিমির উদ্দীন মন্ডলের ছেলে শহীদ তজির উদ্দীন মন্ডল, মৃত সহিদ তজির উদ্দীনের ছেলে শহীদ তমিজ উদ্দিন (রাজু), দাড়াবাতা এলাকার মৃত রহিম উদ্দীনের ছেলে শহীদ অবির উদ্দীনসহ ১৪ জন বীর শহীদ গণহত্যার শিকার হয়েছিলেন।
মান্নান বলেন, ‘শ্রাবণ মাসের ৬ তারিখ সোমবার পাকহানাদার বাহিনীর ১৫০ জন সদস্য দুপুর একটার দিকে আমাদের বাড়ি ঘেরাও করে। বড় ভাইয়ের সঙ্গে আমাকেও দুই হাত ও চোখ বেঁধে কুলফৎপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমাকেসহ ১৫ জনকে সামনে হাত বেঁধে সারিবদ্ধ হয়ে বসে রাখা হয়।’
তিনি বলেন, ‘চোখের সামনে পাক বাহিনীর সদস্যরা সর্বপ্রথম আমার বড় ভাই মজিবুলের দিকে বন্দুক তাক করে গুলি করলে মজিবুল আমার বুকে এসে পড়ে। ভাইয়ের মৃত্যুর সঙ্গে অজস্র রক্ত দেখে আমিও মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। এবং মৃত্যুর ভান করে মাটিতেই চুপটি মেরে শুয়ে থাকি। এরপর একে একে ব্রাশ ফায়ার করে ১৪ জনকে হত্যা করা হয়। আমাদের মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে কিনা পাক-বাহিনীর সদস্যরা রাইফেলের বাঁট ও পা দিয়ে খুঁচে সবার শরীরে আঘাত করতে থাকে।
‘এ সময় রাইফেলের বাঁট ও পা দিয়ে অন্যান্যদের মতো আমার শরীরেও খোঁচাতে থাকে। এমন দুর্বিষহ কষ্ট সহ্য করতে না পেরে আমি যখন নড়ে উঠি। গুলি করার জন্য পাক আর্মিরা আমার ঘরে বন্ধুকের নল চেপে ধরে। প্রাণে যেন মেরে ফেলা না হয় এ কারণে পাকিস্তানি আর্মিদের কাছে কত যে আকুতি মিনতি করেছি.! হাত পেতে প্রাণ ভিক্ষে চেয়ে বলেছি, স্যার আমাকে মেরে ফেলবেন না।’
মান্না আরও বলেন, ‘আকুতি মিনতি শুনে পাক আর্মিদের একজন সদস্য আমার নাম জানতে চান। আমি তখন বললাম, স্যার আমার নাম আব্দুল মান্নান। ওই আর্মির সদস্য তখন বললেন আমার নামও তো আব্দুল মান্নান। তাহলে তুই আমার বন্ধু। এসময় তিনি আর্মির এক বড় স্যারকে বলেন, স্যার এই ছেলেটিকে ছেড়ে দিন স্যার। আমার নামের সঙ্গে ওর নামের মিল রয়েছে স্যার। ওকে আমি মিতা বানিয়েছি স্যার। তাছাড়া সে বয়সে অনেক ছোট, তার বড় ভাইকে আমরা মেরে ফেলেছি স্যার। ওকে মেরে ফেললে ওর বংশে বাতি জ্বালানোর আর কেউ থাকবে না স্যার।
‘এরপর আমাকে না মেরে বন্দুকের একটি বাক্স ঘাড়ে তুলে দিয়ে পার্শ্ববর্তী ফার্সিপাড়া ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর কয়েকটি রুটি দিয়ে আমাকে বলে এগুলো খা। তখন কি খেতে পারি.! রুটিগুলো খেতে পারিনি। প্রাণে বেঁচে যাওয়ার পর আমি মাঝপথে রুটিগুলো ফেলে দিয়ে ১৪ জনসহ আমার ভাইকে যেখানে মেরে ফেলা হয়েছিল সেখানে ছুটে আসি।’
তিনি বলেন, ‘এসে দেখি রক্তাক্ত অবস্থায় নিথর দেহের মতো পড়ে আছে ১৪টি শহীদের লাশ। চারদিকে রক্ত আর রক্ত। সে সময় ১৪ জন শহীদদের জানাজা শেষে কবর দেওয়ার মতো কেউ ছিল না। আর্মিদের ভয়ে বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা তিনজন মিলে কোদাল দিয়ে এক হাঁটু গর্ত খুঁড়ে ওই অবস্থায় তাদেরকে শুধু পুঁতে ফেলা হয়েছিল। এদের কারো পরনে লুঙ্গি, সার্ট, গেঞ্জি ওই অবস্থায় গর্তে রেখে মাটি চাপা দেওয়া হয়।’
মান্নান বলেন, ‘ফার্সিপাড়া ক্যাম্পে যখন ধরে নিয়ে যাওয়া হলো তখন অপরিচিত ছয়জন ব্যক্তির সঙ্গে আমার দেখা হয়। তাদের সঙ্গে ভীষণ অত্যাচার করে আর্মির সদস্যরা। তাদের মধ্যে কেউ স্কুলের শিক্ষক, সাধারণ মানুষ ও উকিল ছিলেন। পরবর্তীতে তাদের ভাগ্যে কী হয়েছিল তা জানা নেই। তবে ফার্সিপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পেছনে একটি গণকবরের অস্তিত্ব রয়েছে। গণকবরটি খনন করা হলে সেসময়ের গণহত্যার শিকার বুদ্ধিজীবীদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।’
এ বিষয়ে সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোস্তাফিজুর রহমান সময়ের আলোকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবীদের অরক্ষিত ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী উপজেলা প্রশাসন কাজ করছে।