ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম তিন দশকের অধিক সময় ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতির খুঁটিনাটি নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী কাজ করে যাচ্ছে। প্রায় ২৬০ জন অর্থনীতি বিটের সাংবাদিকদের নিয়ে এই ফোরামের সদস্যরা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করে দেশে ও বিদেশে খ্যাতি অর্জন করেছে। ইআরএফ সাংবাদিকদের একমাত্র সংগঠন যেটি প্রতি বছর অর্থমন্ত্রী ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সঙ্গে প্রাক-বাজেট আলোচনায় অংশগ্রহণের সুযোগ পায়।
অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি, কাঠামোগত পরিবর্তন ও বিশ্ব বাণিজ্য নিয়ে জনগণকে অবহিত করে চলেছে অর্থনীতি বিটের সাংবাদিকরা। তারা প্রতিনিয়ত ডাটা নিয়ে কাজ করে ও তার নিগূঢ় বিশ্লেষণ করে। ইআরএফ-এনবিআরের যৌথ প্রচেষ্টায় দেশের রাজস্ব ফাঁকি রোধ ও কর জিডিপি হার বেগবান করা সম্ভব। করদাতার সংখ্যা বেড়েছে আপনার লিডারশিপে। আমরা আশা করি তা বছর শেষে আরও বাড়বে। প্রতি বছরের মতো এবারও আমাদের ফোরামের পক্ষ থেকে আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবনা পেশ করা হলো—
১. বাজেটে মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র শ্রেণির ওপর করের বোঝা কমাতে বাড়তি দেওয়া কর এমএফএসের মাধ্যমে ফেরতের ব্যবস্থা করা। যাদের করযোগ্য আয় নেই তাদের ব্যাংক সুদের ওপর কর্তৃক টাকা ফেরত দেয়, ২. নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি, শিক্ষা ও চিকিৎসা উপকরণে কর হার ৫.০ শতাংশে সীমিত রাখা, ৩. ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বিকাশে পৃথক রাজস্ব নীতি প্রণয়ন। বন্ড সুবিধা যাতে তারা সহজে পান, ৪. বাজেটে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি রাজস্ব পরিকল্পনা করা ও তার জন্য বরাদ্দ রাখা, ৫. বেসরকারি প্রভিডেন্ট ফান্ডকে করমুক্ত রাখা, ৬. কর আহরণ বাড়াতে তা নিয়ে এনবিআর-ইআরএফ যৌথ জরিপ চালু করা, ৭. প্রান্তিক করদাতাদের জন্য ডেডিকেটেড ডিজিটাল সার্ভিস, ৮. তামাকের কর বাড়িয়ে কর আদায় থেকে স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো, ৯. ব্যক্তি করদাতাদের সর্বোচ্চ কর হার ৩০-৩৫ শতাংশ করা, ১০. ভ্যাটের হার ৭.০ করা, ১১. বাজার মূল্যায়ন পদ্ধতির মাধ্যমে সম্পদ কর আদায়, ১২. পত্রিকা, টেলিভিশন, অনলাইনসহ মিডিয়ার কর হার কমিয়ে আনা, ১৩. রাজস্ব বোর্ডের তিনটি বিভাগের জন্য পৃথক হেল্প লাইন নাম্বার চালু, ১৪. কাস্টমসের টাইম রিলিজ স্টাডির মতো আয়কর ও ভ্যাটেও একই রকম স্টাডি করা, ১৫. এনবিআরে তিনটি বিভাগের ফোকাল পয়েন্ট নিয়োগ যাতে বিনিয়োগকারী ও সেবাপ্রত্যাশী করদাতারা সহায়তা পান, ১৬. শতভাগ বেতন প্রদান ইলেকট্রনিক মাধ্যমে না করে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ নগদে দেওয়ার সুযোগ রাখা আগামী পাঁচ বছর। ভারতে আছে, ১৭. চট্টগ্রাম, বেনাপোল ও মোংলা বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়ন ও নারীবান্ধব করা। বিনিয়োগ বাড়াতে হবে রাজস্ব আদায়ে, ১৮. প্রত্যক্ষ করের দিকে জোর দেওয়া এবং সমন্বিত ডিজিটালাইজেশন কার্যক্রম হাতে নেওয়া, ১৯. জেলা ও সিটি করপোরেশনে এখন বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। এ জন্য যেখানে বেশি কর, সেখানে এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (এলটিইউ) মতো এ মিডিয়াম করদাতা ইউনিট বা এমটিইউ খোলা, ২০. কর ছাড় দেওয়ার ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা ও জবাবদিহি থাকতে হবে। প্রতি করছাড়ের আদেশের সঙ্গে কত রাজস্ব ক্ষতি হলো তার একটা প্রাক্কলন দেওয়া, ২১. মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সম্পর্ক রেখে ব্যক্তি করদাতাদের কর ছাড়ের সীমা সাড়ে তিন লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪ লাখে উত্তীর্ণ করা যেতে পারে, ২২. এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের ইমপোর্ট ট্যারিফ ব্যবস্থায় কাঠামোগত পরিবর্তন করে ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনতে হবে। এখনও বাংলাদেশের ট্যারিফ এলডিসিগুলোর গড় ট্যারিফের চেয়ে বেশি। গত কয়েক বছর ধরে ট্যারিফ রেট কমিয়ে আনার কথা বলা হলেও তাতে বড় ধরনের অগ্রগতি দেখা যায়নি। ইতিমধ্যে ভর্তুকি কমানোর অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক নগদ সহায়তা কমানোর কার্যক্রম শুরু করেছে। এনবিআরকেও বিভিন্ন ধরনের ট্যারিফ ওয়াল কমানোর কাজ এই বাজেট থেকেই শুরু করা উচিত। অন্যথায় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করতে গেলে হঠাৎ করে শুল্ক কমিয়ে আনার ধাক্কা সামলানো কঠিন, ২৩. এনবিআরের যেকোনো পলিসি ডিসিশনের ইমপ্যাক্ট অ্যানলাইসিস হওয়া উচিত, যার ভিত্তিতে পরবর্তীতে ডিসিশন নেওয়া সম্ভব হবে। ট্যাক্স, ভ্যাট ও শুল্কছাড়ের সুফল কাদের পকেটে যায়, তার নির্মোহ বিশ্লেষণ হওয়া দরকার। একটি ইফেক্টিভ ফিসক্যাল পলিসির জন্য এই গবেষণা ও বিশ্লেষণ খুবই প্রয়োজন, যে প্রস্তাব অতীতেও ইআরএফের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে। সরকারের অন্যান্য দফতরের সমন্বয়ে কিংবা ইআরএফের সহায়তায় এ বিষয়ে গবেষণা করা উচিত, ২৪. এনবিআরের গবেষণা ও পরিসংখ্যান বিভাগকে আধুনিক, যুগোপযোগী, দক্ষ করতে দক্ষ জনবল নিয়োগসহ এ জন্য বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রস্তাব করছি, ২৫. কর পরিশোধিত আয় থেকে একজন ব্যক্তি ব্যাংকে টাকা জমা রাখলে মুনাফার ওপর ১০-১৫ শতাংশ, ২৬. কর পরিশোধিত আয় থেকে একজন ব্যক্তি ব্যাংকে টাকা জমা রাখলে মুনাফার ওপর ১০-১৫ শতাংশ কর কাটা হয়। আবার ব্যাংকের জমা স্থিতির ভিত্তিতে আবগরী শুল্ক কাটা হয়। এমনিতেই মানুষের সঞ্চয় সক্ষমতা কমেছে। আবার বিভিন্ন ভীতির কারণে অনেকে ব্যাংকে টাকা রাখতে চাইছেন না। এ রকম অবস্থায় ৫-১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জমার ওপর আবগরী শুল্ক প্রত্যাহার এবং মুনাফার ওপর কর কমানো যেতে পারে, ২৭. এনবিআরে রিটার্ন জমা এবং ঋণ নেওয়ার সময় ব্যাংকের কাছে দেওয়া সম্পদ বিবরণীর তথ্যে বিস্তর ফারাক থাকে। এখন ড্রাইভার, দারোয়ান, অফিস সহায়কসহ বিভিন্নজনের নামে অনেকে ব্যবসা দেখিয়ে বড় অঙ্কের ঋণ বের করে নিচ্ছে। বেনামি এই ঋণ আর আদায় হয় না। এ ক্ষেত্রে বড় ঋণ অনুমোদনের আগে এনবিআরের নির্দিষ্ট ডাটাবেজ থেকে ব্যবসায়িক তথ্য নেওয়া বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। এতে ঋণ জালিয়াতি কমবে।
আবার রাজস্ব আদায় বাড়বে, ২৮. ব্যবসায়ী, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান যার যে কর ধার্য হবে তা আদায় নিশ্চিত করা এনবিআরের অন্যতম লক্ষ্য। আর এ জন্য সবাই যেন হয়রানিমুক্তভাবে কর পরিশোধ করতে পারেন সে জন্য সব পর্যায়ে বাধ্যতামূলক অনলাইন ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে, ২৯. ইআরএফ সদস্যদের জন্য এনবিআর ভবনে একটি মিডিয়া সেন্টার খোলা, ৩০. বস্তুনিষ্ঠ ও বিশ্লেষণধর্মী খবর প্রচারে উৎসাহিত করতে ইআরএফ-এনবিআর রিপোর্টিং অ্যাওয়ার্ড চালু করা, ৩১. এনবিআরের বিভিন্ন প্রজেক্টের প্রচারণার খাতে ইআরএফকে সম্পৃক্ত করা যাতে সঠিক তথ্য জনগণ জানতে পারে ও গুজব ছড়িয়ে না পড়ে, ৩২. অর্থবছরের প্রতি প্রান্তিকে একবার ইআরএফ সদস্যদের সঙ্গে এনবিআরের মিটিং, ৩৩. দেশ থেকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার হচ্ছে, এই পাচার রোধে ২০১৩ সালে ট্রান্সফার প্রাইসিং নামে একটি আইন করা হয়েছিল। বাস্তবে এর অগ্রগতি কতটুকু সেটি আমরা জানি না। কর ফাঁকি রোধে এনবিআরের কাজের দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখতে চাই, ৩৪. রফতানির ক্ষেত্রে অন্য সম্ভাবনাময় খাত যেন তৈরি পোশাক শিল্পের মতো নিয়মিত বন্ডেড সুবিধা পায় সে ব্যবস্থা করা, ৩৫. পরিবেশবান্ধব বা সবুজ শিল্পায়নে বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে এনবিআর সাধারণ কারখানা ও পরিবেশবান্ধব শিল্পের মধ্যে করপোরেট করের ব্যবধান কমপক্ষে ৫ শতাংশ রাখা যেতে পারে। পরিবেশবান্ধব কারখানায় অতিরিক্ত বিনিয়োগের তুলনায় বিদ্যমান ২ শতাংশ কর সুবিধা অপ্রতুল বলে মনে করছে অনেকে, ৩৬. আমাদের কৃষি যান্ত্রিকরণের জন্য মেশিনারি ও এর যন্ত্রাংশের শুল্ককর মুক্ত আমদানি সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব করছি, ৩৭. দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য স্বাস্থ্য পরিক্ষার আধুনিক যন্ত্রপাতি আমদানিও শুল্ককর মুক্ত রাখা উচিত বলে প্রস্তাব করছি।
গত সোমবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে এটা উপস্থাপন করেন ইআরএফ সভাপতি।
লেখক: ইআরএফ সভাপতি