
মসজিদে তারাবি নামাজ আদায় করছেন মুসল্লিরা। ছবি: সংগৃহীত
আজকের তারাবিতে ২৪তম পারা তেলাওয়াত করা হবে। সুরা জারিয়াতের ৩১ থেকে সুরা তুর, সুরা নাজম, সুরা কমার, সুরা রহমান, সুরা ওয়াকিয়া ও সুরা হাদিদ পর্যন্ত । এই অংশে আসমান-জমিন সৃষ্টি, কাফেরদের ভ্রান্ত চিন্তার খণ্ডন, তাকদির, পূর্ববর্তী জাতির অবাধ্যতার পরিণতি, মানুষ ও জিন জাতি সৃষ্টির উদ্দেশ্য, নবিজির দাওয়াত, মেরাজ, উপদেশ, নবিজির হাতের ইশারায় চাঁদ বিদীর্ণ হওয়া, ঈমান, ঈমানদারের প্রতিদান, আল্লাহর পথে জীবন-সম্পদ উৎসর্গ, আল্লাহর অস্তিত্ব ইত্যাদি বিষয়ের বয়ান আছে।
কেন মানুষ সৃষ্টি করা হলো
আল্লাহ আদম (আ.)-কে বানালেন। পৃথিবীতে পাঠালেন। এই আদমের জাতি মানুষ আল্লাহর প্রিয় সৃষ্টি। আল্লাহ তাদের ভালোবেসে নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন। তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদতের জন্য। তাঁর আদেশ মোতাবেক চলার জন্য। আল্লাহ বলেন, ‘আমি জিন ও মানবজাতিকে শুধু আমার ইবাদত করার জন্য সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা জারিয়াত, আয়াত: ৫৬)
ইবাদত হলো আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নির্দেশিত পথ ও মতে জীবন পরিচালনা করা। আল্লাহ যা কিছু নিষেধ করেছেন, তা থেকে বিরত থাকা। নামাজ পড়া। রোজা রাখা। সামর্থ্যবান হলে জাকাত আদায় ও হজ করা। প্রতিবেশী ও আত্মীয়ের হক আদায় করা। সঠিকভাবে উত্তরাধিকার বণ্টন ও মানুষের কল্যাণে কাজ করা । সুদ, ঘুষ, ব্যভিচার, খুন, ধোঁকা, প্রতারণা, জুলুম, নির্যাতন, মিথ্যা ও গিবত ইত্যাদি মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকা।
অন্তরাত্মা উড়তে শুরু করেছে
সুরা তুর মক্কায় অবতীর্ণ। এটি কোরআনের ৫২তম সুরা। আয়াত সংখ্যা ৪৯। রাসুলুল্লাহ (সা.) তখন মক্কায়। মাগরিব নামাজ পড়ছিলেন। নামাজে তিলাওয়াত করছিলেন সুরা তুর। জুবাইর ইবনে মুতইম তখনো মুসলমান হননি। তিনি তিলাওয়াত শুনছিলেন। যখন সুরা তুরের ৩৫ থেকে ৩৭ নম্বর আয়াত শুনলেন, তার মনে হলো, অন্তরাত্মা উড়তে শুরু করেছে। সেদিনই তাঁর অন্তরে ইসলাম জায়গা করে নিয়েছে।
সেই আয়াতগুলোর অর্থ হলো, ‘তারা কি আপনা-আপনিই সৃষ্টি হয়ে গেছে, না কি তারাই (নিজেদের) স্রষ্টা? নাকি আকাশমণ্ডলি ও পৃথিবী তারা সৃষ্টি করেছে? না; বরং মূল কথা হচ্ছে, তারা বিশ্বাসই রাখে না। তোমার প্রতিপালকের ভান্ডার কি তাদের কাছে রয়েছে? নাকি তারাই সবকিছুর নিয়ন্ত্রক?’ (সুরা তুর, আয়াত : ৩৫-৩৭; বুখারি, ৩০৫০, ৪৮৫৪; দালাইলুন নুবুওয়া, আবু নুআইম, ১/৩০৮)
মুত্তাকিরা জান্নাতে যেমন থাকবে
সুরা তুরের ১৭ থেকে ২৮ নম্বর আয়াতে জান্নাতে জান্নাতিদের কী কী নেয়ামত থাকবে, তার বিবরণ রয়েছে। যেমন—
১. তাঁরা সুখে ও সম্পদে থাকবেন।
২. তাঁরা সবকিছু আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করবেন।
৩. তাঁরা দোজখ থেকে রক্ষা পাবেন।
৪. তৃপ্তির সঙ্গে খাবেন ও পান করবেন।
৫. সারি সারি সাজানো আসনে হেলান দিয়ে আরামে বসবেন।
৬. সুনয়না সুন্দরী হুর বিয়ে করবেন।
৭. তাঁদের সন্তানেরাও তাঁদের সঙ্গে থাকবেন।
৭. চাহিদা অনুযায়ী ফলমূল ও গোশত পাবেন।
৮. আনন্দ কৌতুকে শরাবের পানপাত্র নিয়ে কাড়াকাড়ি করবেন; তবে শরাব পানে অনর্থক প্রলাপ ও পাপ থাকবে না।
৯. তাঁদের সেবায় নিয়োজিত সুরক্ষিত মণিমুক্তা সদৃশ কিশোরেরা তাঁদের কাছাকাছি ঘোরাফেরা করবে।
যে আয়াত শুনে অবিশ্বাসীরাও সিজদা করেছিল
সুরা নাজমের শেষ আয়াত নাজিল হলে রাসুলুল্লাহ (সা.), উপস্থিত সাহাবি ও অবিশ্বাসীরা সিজদা করেছিল। (তাফসিরে ইবনে কাসির)। এ সুরায় আল্লাহ বেশ কিছু বিষয়ের কসম করে মুহাম্মাদ (সা.)-এর সত্য নবি হওয়া, তাঁর প্রতি নাজিলকৃত ওহিতে সন্দেহ ও সংশয় না থাকার প্রমাণ, মূর্তি উপাসক ও যারা ফেরেশতাদের আল্লাহর কন্যা সাব্যস্ত করে তাদের নিন্দা, কিয়ামতের বর্ণনা, কারও গুনাহের বোঝা অপরের কাঁধে চাপানো হবে না এবং আল্লাহর কুদরতের বর্ণনা রয়েছে।
চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার বয়ান
এক্কায় অবতীর্ণ সুরা কমারের আয়াত সংখ্যা ৫৫। এটি কোরআনের ৫৪ তম সুরা। সুরার শুরুতে রাসুল (সা.)-এর আঙুলের ইশারায় চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার আলোচনা থাকায়, এর নাম সুরা কমার রাখা হয়েছে।
তখন ইসলামের শুরুর সময়। রাসুলুল্লাহ (সা.) মক্কার অবিশ্বাসীদের একত্ববাদের দাওয়াত দিচ্ছেন। তারা অস্বীকার করে চলল। একবার আবু জাহেলের নেতৃত্বে একদল মুশরিক ও ইহুদিরা জানাল, ‘যদি মুহাম্মাদ চাঁদ দ্বিখণ্ডিত করতে পারে, তাহলে তাঁকে আল্লাহর রাসুল হিসেবে মেনে নেব।’
জিলহজ মাসের ১৪ তারিখ। নবিজি (সা.) আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন। চাঁদের দিকে আঙুল ইশারা করলেন। চাঁদ দিখণ্ডিত হয়ে যায়। অবিশ্বাসীরা ব্যাপারটি জাদু বলল। ইহুদিদের কেউ ইসলাম গ্রহণ করেছিল। তারা তাওরাতে চাঁদের ব্যাপারটি পড়েছিল। দ্বিখণ্ডিত চাঁদ মক্কার বাইরের লোকজনও দেখেছিল। তারপরও অবিশ্বাসীরা বলল, ‘এটা জাদু। আমরা তাঁকে রাসুল মানব না।’ পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘(কিয়ামতের) সময় এসে গেছে এবং চাঁদ ফেটে গেছে। তারা যদি কোনো নিদর্শন দেখে, তবে কৌশলে এড়িয়ে যায় এবং বলে যে, এটা তো চিরাগত জাদু। তারা মিথ্যারোপ করল এবং নিজেদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করল। প্রত্যেক কাজ যথাসময়ে স্থিরীকৃত হয়।’ (সুরা কমার, আয়াত : ১-৩)
আল্লাহর কোন নেয়ামত অস্বীকার করবে?
মদিনায় অবতীর্ণ সুরা রহমান কোরআনের ৫৫তম সুরা। এর আয়াত সংখ্যা ৭৮। এ সুরার প্রথম আয়াতটিই হলো, আর-রহমান, তাই এর নাম রহমান রাখা হয়েছে। এ সুরার আরেক নাম ‘উরুসুল কোরআন’ বা ‘কোরআনের নববধূ’।
জগতের সবকিছু মানুষের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে নেয়ামত। সুরা রহমানে আল্লাহ দুনিয়া-আখেরাতের বহু নেয়ামতের উল্লেখ করেছেন। এ নেয়ামতের বর্ণনা প্রসঙ্গে আল্লাহ মোট ৩১ বার প্রশ্ন করেছেন, ‘অতএব তোমরা তোমাদের রবের কোন কোন নেয়ামত অস্বীকার করবে?’
যা আছে সুরা ওয়াকিয়ায়
মক্কায় অবতীর্ণ সুরা ওয়াকিয়ার আয়াত সংখ্যা ৯৬টি। এ সুরার আরেক নাম গিনা, অর্থাৎ সমৃদ্ধিশালী। এ সুরায় কিয়ামতের সময়কার বিভিন্ন বর্ণনা, কিয়ামতের দিন মানুষের শ্রেণি বিভেদ, আল্লাহর অস্তিত্ব, একত্ববাদ, কুদরত ও ক্ষমতার প্রমাণ, পুনরুত্থান ও হিসাব-নিকাশ, কোরআনের মাহাত্ম্য, মানুষ সৃষ্টির প্রক্রিয়া ও আল্লাহর আনুগত্য ইত্যাদির কথা আছে।
সুরা হাদিদের বিষয়বস্তু
সুরা হাদিদ মদিনায় অবতীর্ণ, এতে আয়াত আছে ২৯। হাদিদ অর্থ লোহা। লোহা সৃষ্টির আলোচনা থাকায় এ সুরার নাম হাদিদ। তাফসিরে ইবনে কাসিরে আছে, ‘রাসুল (সা.) বলেছেন, সুরার ৩ নম্বর আয়াতটি অন্যান্য হাজার আয়াত অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।’ এ সুরায় আল্লাহ লোহা সৃষ্টির দুটি কারণ উল্লেখ করেছেন।
এক. এতে শত্রুদের মনে ভীতি সঞ্চার হয়।
দুই. এতে রয়েছে বহুবিধ কল্যাণ।
এ সুরায় আছে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি ইমান, জগতের সবকিছু আল্লাহর, তিনি মালিক, সবকিছু তাঁর প্রশংসা করে, দ্বীন প্রতিষ্ঠায় জীবন-সম্পদ কোরবানি, আল্লাহর ভয় ও দুনিয়ার মোহে ধোঁকায় না পড়ার বয়ান।
লেখক: আলেম ও সাংবাদিক