
চলমান যুদ্ধবিরতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে গাজায় হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। গত সোমবার উপত্যকায় তাদের এক দিনের হামলায় ৪ শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। এদের মধ্যে শতাধিক শিশু ছিল। যুদ্ধবিরতি উপেক্ষা করে কেন নতুন হামলা চালাচ্ছে ইসরাইল? এর পেছনে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ক্ষমতা ধরে রাখা এবং ট্রাম্প ফ্যাক্টরের কথা বলছেন বিশ্লেষকরা। তারা আরও বলছেন, দীর্ঘমেয়াদে গাজাকে ফিলিস্তিনিশূন্য করে তোলাও এসব হামলার উদ্দেশ্য।
দীর্ঘ ১৫ মাসের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পর এ বছরের ১৯ জানুয়ারি ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মুক্তি আন্দোলনের সশস্ত্র সংগঠন হামাস যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। এই যুদ্ধবিরতি তিনটি ধাপে বাস্তবায়নের কথা ছিল। প্রথম ধাপে ৪২ দিনের জন্য সংঘর্ষ বন্ধ রাখা, দ্বিতীয় ধাপে গাজায় সব ধরনের সামরিক কার্যক্রমের সমাপ্তি ঘটানো এবং তৃতীয় ধাপে ইসরাইলি সেনাদের স্থায়ীভাবে প্রত্যাহার করা হবে বলে চুক্তি হয়। তবে যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপ শেষ হওয়ার আগেই ইসরাইল তাদের সামরিক তৎপরতা বাড়িয়ে তোলে। সবশেষ গত সোমবার ইসরাইলি সেনারা যুদ্ধবিরতির চুক্তি ভেঙে গাজার ওপর ব্যাপক বোমাবর্ষণ করে ৪ শতাধিক মানুষকে হত্যা করে।
এদিকে স্থানান্তরের আদেশে আবারও গাজাজুড়ে হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করছে। এমনকি হারেৎজের মধ্যপন্থি সামরিক ভাষ্যকার আমোস হারেলও প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকারের স্বার্থে এই হামলা তথা আগ্রাসনকে যুদ্ধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আইয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, মনে হচ্ছে এই হামলার পেছনের প্রেরণা ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত। আমরা অন্তত তিনটি ক্ষেত্র শনাক্ত করতে পারি। এক. নেতানিয়াহুর রাজনৈতিকভাবে বেঁচে থাকা, সামরিক ও নিরাপত্তা পরিষেবাগুলোতে তার আধিপত্য এবং জনসাধারণকে উত্তেজিত না করে মিত্রদের সন্তুষ্ট করার ইচ্ছা।
সরকারের স্বার্থে আগ্রাসন : নেতানিয়াহুকে চলতি মাসের শেষের দিকে বাজেট অনুমোদন করতে হবে। অন্যথায় তার সরকারের পতন হবে এবং ইসরাইল নির্বাচনে যাবে। বাজেট অনুমোদিত হলে এটি ২০২৬ সালের অক্টোবরে পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত তার প্রশাসনের টিকে থাকার নিশ্চয়তা দেবে। নেতানিয়াহুর জন্য তাই এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাজেট অনুমোদন না করার কোনো ইঙ্গিত না থাকলেও ইউনাইটেড তোরাহ জায়নবাদ পার্টির অতিরিক্ত কট্টরপন্থি সদস্যরা নেতানিয়াহুর জন্য উদ্বেগের কারণ ছিল। নেতানিয়াহুর জোট ওই দল ও তাদের আটটি আসনের ওপর নির্ভরশীল। ইতিমধ্যেই দলটি হুমকি দিয়েছে, অতি রক্ষণশীল তরুণদের সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি না দিলে তারা নেতানিয়াহুকে বাজেটে সমর্থন দেবে না। সে কারণেই প্রধানমন্ত্রীকে তার সরকারকে শক্তিশালী করতে হবে।
ট্রাম্প ফ্যাক্টর : মিডল ইস্ট আইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তারপর ট্রাম্প ফ্যাক্টর আছে। ফেব্রুয়ারিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গের বৈঠক থেকে ফিরে আসার পর, নির্দিষ্ট নিয়ম বা আইন মেনে চলার প্রয়োজন মনে করছেন না। তারপর থেকে নেতানিয়াহু ইসরাইলি সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান থেকে তার বিরোধীদের নির্মূল করার তীব্রতা বাড়িয়েছেন। সামরিক এবং গোয়েন্দা পরিষেবা; ইসরাইলি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দুটি স্তম্ভ তার বোঝা অনুভব করেছে।
যুদ্ধবিরতি চুক্তির বিষয়েও নেতানিয়াহু ট্রাম্পের চেতনায় কাজ করেছিলেন। নেতানিয়াহু ট্রাম্পের সমর্থনে, অনুভব করেছিলেন যে তিনিও একটি লিখিত চুক্তি উপেক্ষা করতে পারেন এবং সবচেয়ে সহিংস উপায়ে গাজা আক্রমণ করতে পারেন।
ইসরাইলি জনগণের ভয় : মিডল ইস্ট আইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজায় স্থল অভিযান পরিচালনা করতে ভয় পান নেতানিয়াহু। যদিও তার সরকারের সহযোগী বেন গভির ও অর্থমন্ত্রী চান গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের পুরোপুরি উৎখাত করতে। তবে নেতানিয়াহু ভূমিতে অভিযান চান না। কেননা সামরিক বাহিনীতে রিপোর্ট করার হার ৫০ শতাংশে নেমেছে।
কী বলছেন বিশ্লেষকরা : বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন, ইসরাইলের কৌশল দীর্ঘমেয়াদি জনসংখ্যাগত বিবেচনার দ্বারা চালিত। রাজনৈতিক ইতিহাসবিদ মোহাম্মদ আল-আস্তাল বর্তমান পর্যায়টিকে ‘জনসাধারণের স্থানচ্যুতির নৃশংস প্রক্রিয়া’ হিসাবে বর্ণনা করেছেন, যা গাজাকে পদ্ধতিগতভাবে জনশূন্য করার জন্য নকশা করা হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম নিউ আরবকে তিনি বলেন, ‘ইসরাইলের চূড়ান্ত লক্ষ্য শুধু সামরিক বিজয় নয়, বরং জনসংখ্যাগত প্রকৌশল। যুদ্ধের একটা উদ্দেশ্য নদী এবং সমুদ্রের মধ্যে ফিলিস্তিনিদের উপস্থিতি কমানো। এর মূল প্রক্রিয়া জোরপূর্বক স্থানচ্যুতি।’
আল-আস্তাল যুক্তি দিয়েছেন, ইসরাইলের কৌশল একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ জায়নবাদী নীতি অনুসরণ করে। তা হলো : ‘বেশি জমি, কম আরব।’ তার মতে, জনসাধারণকে উপত্যকায় রেখে গাজা দখলের মানে নেই। জনসাধারণ কমিয়ে আনতে তাই অবিরাম বোমাবর্ষণ, ইচ্ছাকৃত অনাহার আর নির্বাসনে ঠেলে দেওয়াকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আল-আস্তালের মতে, গাজা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের অন্য দুই দিক হলো : উপত্যকার গ্যাস রিজার্ভের ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং লোহিত সাগর ও ভূমধ্যসাগরের মধ্যে একটি নতুন বাণিজ্য পথের বিকাশ।