ই-পেপার রবিবার ২৩ মার্চ ২০২৫
রবিবার ২৩ মার্চ ২০২৫
ই-পেপার

রবিবার ২৩ মার্চ ২০২৫

ইউক্রেনের কাছ থেকে সব নিতে যাচ্ছেন পুতিন
প্রকাশ: শনিবার, ২২ মার্চ, ২০২৫, ৫:৫১ এএম আপডেট: ২২.০৩.২০২৫ ৬:০১ এএম  (ভিজিট : ১৯১)
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

গত সপ্তাহে জেদ্দায় অনুষ্ঠিত মার্কিন-ইউক্রেনীয় আলোচনার পরপর হওয়া রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দীর্ঘ টেলিফোন সংলাপের পর ইউক্রেনে যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে প্রবেশ করার ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে। মস্কো এবং কিয়েভ উভয়ই শান্তি চুক্তির বিষয়ে ট্রাম্পের প্রচেষ্টার সঙ্ঘে একমত বলে মনে হচ্ছে, যদিও নির্দিষ্ট বিষয়গুলোর বিস্তারিত অবস্থান এখনও অস্পষ্ট।

কিয়েভ ৩০ দিনের শর্তহীন যুদ্ধবিরতি এবং পরবর্তী শান্তি আলোচনার জন্য ওয়াশিংটনের প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছে। শান্তি আলোচনার আগে যুদ্ধকে স্থগিত করা ইউক্রেনের চাওয়া ছিল না, তবে আরও ভূখণ্ড, অবকাঠামো, মানবজীবন এবং সম্ভবত আমেরিকার সমর্থন হারানোর সম্ভাবনা তাকে এ প্রস্তাবে রাজি করিয়েছে।

অন্যদিকে রাশিয়া ৩০ দিনের জন্য ইউক্রেনের জ্বালানি অবকাঠামোর ওপর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা স্থগিত করতে সম্মত হয়েছে, তবে একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধবিরতির জন্য আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এর আগে, মস্কো যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়নের যৌক্তিক দিক, লঙ্ঘন রোধের নিশ্চয়তা এবং যুদ্ধবিরতির পর কী ঘটবে, এসব বিষয় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। এ সতর্কতার কারণ হলো-রাশিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে, যা কোনো চূড়ান্ত সমঝোতার কাঠামো নির্ধারণের আগে হারাতে চায় না। যাই হোক, ট্রাম্প-পুতিন ফোনালাপের পর রুশ কর্মকর্তারা শান্তি চুক্তির সম্ভাবনা নিয়ে বেশ আশাবাদী মনে হয়েছে।

যদি যুদ্ধবিরতির আলোচনা এগিয়ে যায়, তা হলে প্রশ্ন উঠবে, পুতিন কি ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে সর্বাত্মক আক্রমণ চালানোর সময় যে লক্ষ্য স্থির করেছিলেন, তা পুরোপুরি অর্জন করতে পারবেন?

এখন পর্যন্ত, একটি বাস্তবসম্মতভাবে অর্জনযোগ্য শান্তি চুক্তির সামগ্রিক কাঠামো সব পক্ষের কাছেই স্পষ্ট। মস্কো বারবার উল্লেখ করেছে যে, শান্তি চুক্তি ইস্তানবুল চুক্তির কাঠামো অনুসরণ করবে, যা ২০২২ সালের বসন্তে রুশ ও ইউক্রেনীয় প্রতিনিধি দল দ্বারা প্রণয়ন করা হয়েছিল, তবে শেষ পর্যন্ত ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের চাপে ইউক্রেন এটি বাতিল করে। এ চুক্তিগুলোর আওতায় ইউক্রেনের সামরিক নিরপেক্ষতা, সেনাবাহিনীর আকারের সীমাবদ্ধতা এবং ইউক্রেনে বসবাসকারী রুশ ভাষাভাষীদের সুরক্ষার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত ছিল।

তিন বছরের যুদ্ধের পর, মস্কো এখন চায় কিয়েভ আনুষ্ঠানিকভাবে দোনেতস্ক, লুহানস্ক, খেরসন এবং জাপোরিজ্জিয়া-এই চারটি ইউক্রেনীয় অঞ্চলের ক্ষতি স্বীকার করে নিক, যেগুলোকে রাশিয়া তার ভূখণ্ড হিসেবে ঘোষণা করেছে, যদিও এখনও পুরোপুরি দখল করতে পারেনি। তবে, এটি সম্ভব যে ক্রেমলিন তার সর্বোচ্চ দাবির বিষয়ে নমনীয় হতে পারে এবং ইউক্রেনের কাছে এই অঞ্চলগুলোর অদখলকৃত অংশ থেকে সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের দাবি ছাড়তে পারে।

মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কি ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, আঞ্চলিক আলোচনায় জাপোরিজ্জিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভবিষ্যৎ অন্তর্ভুক্ত থাকবে, যা বর্তমানে রাশিয়ার দখলে রয়েছে এবং ফ্রন্ট লাইনের কাছাকাছি অবস্থান করছে। যদি রাশিয়া এ আলোচনার অংশ হয়, তা হলে এটি বোঝাবে যে তারা আর জাপোরিজ্জিয়ার উত্তর দিকের অদখলকৃত অংশ বা অন্য তিনটি অঞ্চলের অদখলকৃত ভূখণ্ড দাবি করছে না।

পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে আলোচনাগুলো ইতিবাচক একটি লক্ষণ, কারণ এটি ইঙ্গিত দেয় যে পশ্চিমা দেশগুলো এবং ইউক্রেন বাস্তবসম্মত ছাড় আদায়ের দিকে ঝুঁকছে, যা রাশিয়ার কাছ থেকে পাওয়া সম্ভব, বরং সম্পূর্ণ অবাস্তব দাবির মতো নয়। যেমন ন্যাটোর স্থলসেনা ‘শান্তিরক্ষী’ সেজে ইউক্রেনে প্রবেশ করা, যা যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স জোরালোভাবে সমর্থন করছে।

পুতিনের যুক্তি বোঝার মূল চাবিকাঠি হলো-এটা স্বীকার করা যে তিনি ভ‚মি দখলের জন্য লড়ছেন না। তার দৃষ্টিতে, ইউক্রেন ২০১৫-১৬ সালের মিনস্ক চুক্তিগুলো ব্যর্থ করার শাস্তি হিসেবে এই সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু করা হয়েছে, যার ফলে এখন ইউক্রেনের এক-পঞ্চমাংশ ভূখণ্ড রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। মিনস্ক চুক্তিগুলো অনুসারে বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চল দোনেতস্ক ও লুহানস্ককে ইউক্রেনের আনুষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা ছিল। কিন্তু ইস্তানবুল চুক্তি থেকে সরে আসার শাস্তি হিসেবেই রাশিয়া শুধু এ দুটি অঞ্চল নয়, খেরসন ও জাপোরিজ্জিয়াও সংযুক্ত করেছে।

যদিও পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি কোনো ভূখণ্ডের বদলে দেওয়া যেতে পারে, অথবা রুশ ভাষাভাষীদের অধিকার ও মস্কো-সংশ্লিষ্ট ইউক্রেনীয় অর্থোডক্স চার্চ সম্পর্কিত রাজনৈতিক ছাড়ের বিনিময়ে সমাধান হতে পারে কিন্তু পুতিনের জন্য একটি বিষয় অমীমাংসাযোগ্য। তা হলো-ন্যাটো দেশগুলো ইউক্রেনের নিরাপত্তা কাঠামো বা নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর ওপর কোনো প্রভাব বা উপস্থিতি বজায় রাখতে পারবে না।

এ সংঘাতের মূলে রয়েছে নব্বই দশকে পশ্চিমাদের নেওয়া সিদ্ধান্ত। যেখানে তারা নবগঠিত গণতান্ত্রিক রাশিয়াকে একীভূত করার বদলে তার মুখোমুখি দাঁড়ানোর পথ বেছে নেয়। প্রকৃতপক্ষে, এই দ্বন্দ্বটি মূলত একটি স্পষ্ট সীমারেখা নির্ধারণের লড়াই, যার বাইরে যুক্তরাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব আর বিস্তৃত হবে না। অন্তত সেই সময় পর্যন্ত, যতক্ষণ না রাশিয়ার পশ্চিমা একীকরণ নিয়ে আবারও আলোচনা সম্ভব হয়।

এ মুহূর্তে পুতিন শুধু ইউক্রেনের নিরপেক্ষতার ওপরই জোর দেবেন না, বরং তিনি যে ‘ন্যাটো অবকাঠামো’ বলে বর্ণনা করেন, তার অপসারণও দাবি করবেন। এর মধ্যে সামরিক প্রশিক্ষণ ও সরবরাহ কেন্দ্র, পাশাপাশি রাশিয়ার সীমান্তবর্তী সিআইএর গুপ্ত আড়িপাতা স্টেশন অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

এয়াড়া, তিনি সম্ভবত ইউক্রেনের নিরাপত্তা কাঠামোর ‘পাশ্চাত্যকরণ’ হ্রাসের দাবিও করবেন, যা সিআইএ এবং এমআই সিক্সের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত, যেমন ইউক্রেনের প্রধান গোয়েন্দা অধিদফতর এবং ইউক্রেনের নিরাপত্তা পরিষেবার কিছু বিভাগ।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো-তিনি কিয়েভ এবং ন্যাটোর কাছে ২০০৮ সালের ন্যাটো বুখারেস্ট সম্মেলনে দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাতিলের দাবি জানাবেন, যেখানে ইউক্রেনকে ভবিষ্যতে জোটের সদস্য করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। এই প্রতিশ্রুতি, যা ইউরোপীয় মিত্রদের ওপর মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ বুশ চাপিয়ে দিয়েছিলেন, রুশ পররাষ্ট্রনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনে এবং এটি প্রথমে জর্জিয়ার সঙ্গে সংঘাত এবং পরে ইউক্রেন যুদ্ধের দিকে নিয়ে যায়।

ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে আসা ইঙ্গিত অনুযায়ী, এসব লক্ষ্য অর্জনযোগ্য হতে পারে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ক্ষেত্রেও। অন্যদিকে ক্রেমলিন ইঙ্গিত দিয়েছে যে, পশ্চিমে জমে থাকা রাশিয়ার ৩০০ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ ইউক্রেনের যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠনের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। এই অর্থকে রাশিয়া ইতিমধ্যেই হারানো বলে ধরে নিয়েছে এবং হয়তো মনে করছে, এ ধরনের একটি ‘উদার’ পদক্ষেপ গ্রহণ করলে তারা তাদের এখন শত্রুভাবাপন্ন ইউক্রেনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের সুযোগ পেতে পারে।

যদি তিনি এই সবকিছু পেতে পারেন, তা হলে পুতিন তার সিদ্ধান্তকে ন্যায্য বলে মনে করবেন, একজন যুদ্ধাপরাধী হওয়া এবং রাশিয়ার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সামাজিক, জাতিগত, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে বর্বর আগ্রাসন চালান। ইউক্রেনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা এবং ন্যাটোকে রুশ সীমান্ত থেকে আরও দূরে ঠেলে দেওয়ার পাশাপাশি, পুতিন আরও একটি লক্ষ্য অর্জনের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলে মনে হয়। আর সেটা হচ্ছে, সমগ্র বিশ্বের দৃষ্টিতে রাশিয়ার মহাশক্তির মর্যাদা পুনরুদ্ধার করা।

পশ্চিমা নেতাদের জন্য, রাশিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হওয়ার অর্থ হবে একটি বিলম্বিত উপলব্ধি। একটি প্রধান পারমাণবিক শক্তিকে, যা মানবতাকে ধ্বংস করতে সক্ষম, সামরিকভাবে পরাজিত করা সম্ভব নয়। তখন তারা হয়তো এই বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে যে সফট পাওয়ারের মাধ্যমে মস্কোকে খুব কার্যকরভাবে প্রভাবিত করা সম্ভব। এটি এমন একটি কৌশল যা স্নায়ু যুদ্ধের সময় পশ্চিমা বিশ্ব অনেক বেশি সাফল্যের সঙ্গে প্রয়োগ করেছিল।

রাশিয়া সংস্কৃতিগত ও অর্থনৈতিকভাবে ইউরোপের ওপর নির্ভরশীল থাকবে, যেমনটি এটি বরাবরই ছিল। ইউরোপীয় সম্প্রদায় রাশিয়াকে যেভাবেই দেখুক না কেন, রাশিয়া নিজেকে সেই সম্প্রদায়েরই অংশ হিসেবে বিবেচনা করবে। এটি পশ্চিমাদের জন্য মস্কো থেকে উদ্ভূত হুমকিগুলো কমানোর আরও কৌশলগত সুযোগ তৈরি করে, যা ইউক্রেনে বর্তমানে পশ্চিমা কর্মকর্তারা যে ‘প্রক্সি যুদ্ধ’ চালাচ্ছেন, তার চেয়ে বেশি কার্যকর হতে পারে।

লেখক- লিওনিড র‌্যাগোজিন, কলামিস্ট, আলজাজিরা




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ। নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।
ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close