
ছবি: সংগৃহীত
আসন্ন ঈদের আগে বেতন-বোনাস নিয়ে সংকট দেখা দিতে পারে এমন শতাধিক কারখানার তালিকা মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএকে দেওয়া হয়েছে গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে। একই সঙ্গে ঈদের আগে এসব কারখানায় বেতন-বোনাসকে ঘিরে যাতে কোনো অস্থিরতা না হয়, তার জন্য আগে থেকেই যেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়-সে পরামর্শও দিয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা। বিজিএমইএ ও শ্রমিক নেতাদের সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্রে জানা যায়, গার্মেন্টস খাতের বর্তমান পরিস্থিতি ও ঈদের আগে বেতন-বোনাস দেওয়াকে ঘিরে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে গত বুধবার সাভারের গলফ ক্লাবে একটি ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নাইন ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মঈনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়।
বৈঠকে তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা মনসুর খালেদ এবং শ্রমিক পক্ষে উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতারা। এ ছাড়া বৈঠকে শিল্প পুলিশসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক সূত্রে জানা যায়, বৈঠকে এনএসআইয়ের পক্ষ থেকে মোট ৯৮টি গার্মেন্টস কারখানার তালিকা দেওয়া হয়। এ সময় বলা হয়, গাজীপুর, সাভার এবং আশুলিয়া এলাকার এসব কারখানায় ঈদের আগে বেতন-বোনাস নিয়ে সংকট দেখা দিতে পারে। যাতে বেতন-বোনাস নিয়ে এসব কারখানায় কোনো সংকট না হয় তার জন্য আগে থেকে যেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়- সে সুপারিশও করা হয় গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে।
বৈঠকে উপস্থিত থাকা এক শ্রমিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সময়ের আলোকে বলেন, গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই ৯৮টি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করলেও বৈঠকে শিল্প পুলিশসহ আরও কিছু সংস্থার পক্ষ থেকে শতাধিক ঝুঁকিপূর্ণ কারখানার কথা বলা হয়। তবে মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর প্রতিনিধি মনসুর খালেদ বৈঠকে ৩৮ থেকে ৪০টির মতো গার্মেন্টস কারখানায় ঈদের আগে বেতন-বোনাস নিয়ে সংকট হতে পারে বলে জানান।’
ওই শ্রমিক নেতা আরও জানান, বৈঠকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নাইন ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মঈন ব্যস্ততার কারণে অল্প সময় উপস্থিত থাকলেও তিনি কঠোর নির্দেশ দেন যেন ঈদের আগে কোনোভাবেই বেতন-বোনাস ইস্যুকে ঘিরে পোশাক শিল্প খাতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি না হয়। কোনো কারণে কোনো কারখানার শ্রমিক যদি আন্দোলনে নামে, তবে তারা যেন কোনোভাবেই রাস্তা অবরোধ করে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করতে না পারে, তার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সচেষ্ট থাকতে হবে।
এদিকে সরকার, মালিক এবং শ্রমিক প্রতিনিধির সমন্বয়ে ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ পরিষদের (টিসিসি) সভা হয়েছিল গত ১২ মার্চ শ্রম ভবনে। সে সভায় ২০ রোজার মধ্যে শ্রমিকদের বেতন ও ঈদ বোনাস দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। শুধু তাই নয়, চলতি মার্চ মাসের ১৫ দিনের বেতনও দেওয়ার কথা বলা হয়, যা মেনে নিয়েছিল মালিকপক্ষও। তবে ২০ রোজা পার হয়ে গেলেও বেতন-বোনাস দেওয়ার চিত্র মোটেও সন্তোষজনক নয়।
বিজিএমইএর তথ্যই বলছে, ২০ রোজা পর্যন্ত মার্চ মাসের ১৫ দিনের বেতন দিয়েছে মাত্র ১৫টি কারখানা, ঈদ বোনাস দিয়েছে ৫২৫টি কারখানা মালিক। এখনও বোনাস দেয়নি ১ হাজার ৫৮২টি কারখানা মালিক। আর বর্তমানে চালু থাকা ২ হাজার ১০৭টি গার্মেন্টস কারখানার মধ্যে এখনও ফেব্রæয়ারি মাসের বেতন দেননি ৬৪টি কারখানার মালিক। এ ছাড়া এখনও জানুয়ারি মাসের বেতন দেয়নি ৩টি কারখানার মালিক। এর মধ্যে ঢাকায় রয়েছে ২টি, একটি চট্টগ্রামে।
এ ছাড়া গত ১২ মার্চের টিসিসির ওই ৮৫তম বৈঠকে মোট সাতটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে ছিল ঈদের আগে কোনো শ্রমিক ছাঁটাই করা যাবে না।
কারখানার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও শ্রমিক প্রতিনিধিরা শ্রম আইন অনুযায়ী ঈদের ছুটির তারিখ নির্ধারণ করবেন, যা পাশর্^বর্তী কারখানার ছুটির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।
শ্রমিকদের ২০ রমজানের মধ্যে বেতন-বোনাসসহ সব পাওনা পরিশোধ করতে হবে। পাশাপাশি, মার্চ মাসের বেতনের অন্তত ১৫ দিনের অংশ মালিকপক্ষ পরিশোধ করবে।
বিজিএমইএ ও বিকেএমইএসহ মালিকপক্ষের ক্যাশ ইনসেনটিভ বাবদ সরকারের কাছে পাওনা দ্রæত পরিশোধের জন্য অর্থ বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুরোধ জানানো হবে।
শ্রমিকদের পাওনাদি পরিশোধ এবং ছুটি সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সক্রিয় থাকবে।
শ্রম পরিস্থিতি মনিটরিং করতে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে একটি কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেল গঠন করা হবে, যেখানে শ্রমিক-মালিকপক্ষের প্রতিনিধি এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সদস্যরা থাকবেন এবং ২৮ ও ২৯ মার্চ শিল্প এলাকাগুলোতে ব্যাংক খোলা রাখতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হবে।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় শ্রমিক ও মালিকপক্ষের প্রতিনিধি, শিল্প পুলিশ, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতিনিধি, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতর এবং শ্রম অধিদফতরের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
মজুরি পরিশোধ পরিস্থিতির বিষয়ে জানতে বিজিএমইএর প্রশাসক আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে তার মোবাইলে কয়েকবার কল দেওয়া হলেও তিনি কল রিসিভ না করায় মন্তব্য জানা যায়নি।
তবে এ বিষয়ে বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সময়ের আলোকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত গার্মেন্টস খাতের সার্বিক পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে। কারখানা মালিকরা যার যার সুবিধামতো করে শ্রমিকদের বেতন-বোনাস দিয়ে দিচ্ছেন। ফেব্রুয়ারি মাসের বেতন প্রায় শতভাগ কারখানায় দেওয়া হয়ে গেছে। যেহেতু মার্চ মাসের অর্ধেক বেতন দেওয়ার কথা বলা হয়েছে- মালিকরা সেটাও চেষ্টা করছেন। ইতিমধ্যে অনেক কারখানাতেই মার্চ মাসের অর্ধেক মজুরি দেওয়া হয়েছে, ঈদের আগে যে কয়েক দিন আছে, আশা করছি সেগুলোতেও দেওয়া হবে। তবে কিছু কারখানার মালিকের অর্থ সংকট রয়েছে, আমরা চেষ্টা করছি সেগুলোর সমস্যার সমাধান করতে। আশা করছি, এবার ঈদের আগে বেতন-বোনাস নিয়ে পোশাক শিল্পে কোনো অস্থিরতা হবে না।’
এদিকে শ্রমিক নেতা তৌহিদুর রহমান বেতন-বোনাস পরিশোধ বিষয়ে সময়ের আলোকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত সামগ্রিকভাবে গার্মেন্টস শিল্পে বেতন-বোনাস দেওয়ার পরিস্থিতি ভালো। কিছু কারখানায় সমস্যা রয়েছে, এগুলো সমাধান করা দরকার। আমরা চাইব না, বেতন-বোনাস ছাড়া একজন শ্রমিকও ঈদ করতে পরিবার-পরিজনের কাছে যাক। সার্বিক পরিস্থিতি আমরাও পর্যবেক্ষণ করছি। আশা করছি- ঈদের আগে খারাপ কোনো পরিস্থিতি হবে না।’