খেত থেকে মরিচ তুলে শুকাচ্ছেন একজন চাষি। ছবি : সময়ের আলো
ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা ও যমুনা নদ-নদী বেষ্টিত গাইবান্ধার চার উপজেলার ১৬৫টি চর ও দ্বীপ রাঙাচ্ছে লাল মরিচ। চরের বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে মরিচের খেত। চরে মসুর ডাল, মাষকলাই, ভুট্টাসহ অন্য ফসল চাষ হলেও, এবার মরিচের ব্যাপক ফলন হয়েছে।
অনেকে অন্যের জমি চুক্তি (লিজ) নিয়েও মরিচ আবাদ করেছেন। ভালো ফলন পেয়ে খুশি চরাঞ্চলের মরিচ চাষিরা। চৈত্রের খরতাপে মরিচ পাকছে বেশি। প্রতিদিনই মরিচ তোলা ও শুকাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা। এ মরিচ বিক্রির টাকায় অনেক কৃষকের সারা বছরের সংসারের খরচ জোগাড় হয়ে যায়। তবে তাদের অভিযোগ, ফড়িয়া-ব্যাপারীরা ‘সিন্ডিকেট’ তৈরি করে চর থেকে কম দামে মরিচ কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। এতে লাভের বড় অংশই যাচ্ছে ব্যাপারীদের পকেটে।
গাইবান্ধা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. খোরশেদ আলম জানান, গাইবান্ধায় বরাবরই মরিচের ভালো ফলন হয়। এখানকার যে লাল মরিচ উৎপাদিত হয় তা অন্যান্য জেলার চেয়ে মানে ভালো। সে কারণে মরিচের ভালো দাম পান গাইবান্ধার কৃষকরা। জেলার সাতটি উপজেলায় যে পরিমাণ মরিচের চাষ হয় তার অর্ধেকের বেশি উৎপন্ন হয় ফুলছড়ি উপজেলায়। আবহাওয়া ও চরের উর্বর মাটিতে দিনদিন মরিচ চাষের পরিমাণ বাড়ছে। কৃষি বিভাগ কৃষকদের পরামর্শসহ সব ধরনের কারিগরি সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে।
সম্প্রতি সরেজমিন গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলায় ব্রহ্মপুত্র নদের বিভিন্ন চরে দেখা গেছে, মাঠের পর মাঠ সবুজ খেত। তার ভেতর উঁকি দিচ্ছে লাল-সবুজ-কালচে মরিচ। মরিচ পাকতে শুরু করেছে। চাষিরা বেছে বেছে লাল টুকটুকে পাকা মরিচ তুলছেন। পুরুষের সঙ্গে এ কাজে হাত লাগিয়েছেন নারীরাও। ভালো ফলনে মরিচের সেই লাল আভা যেন ছড়িয়ে পড়ছে তাদের চোখে-মুখে। মরিচ-চাষিদের মুখে হাসির ঝিলিক। খেত থেকে মরিচ তুলে দিচ্ছেন শ্রমিকেরা। প্রতি কেজি মরিচ তুলে তারা পান ১০-১২ টাকা। ফাঁকা মাঠ, রাস্তার ধার, বাড়ির উঠান, ছাদসহ বিভিন্ন জায়গায় মরিচ শুকানো হচ্ছে। সবমিলিয়ে চরের চাষিরা ব্যস্ত সময় পার করছেন মরিচ তোলা আর শুকানোর কাজে। লাল মরিচে রঙিন এখন চরের চাষিদের আঙিনা।
চাষিরা জানান, কার্তিক মাসে মরিচের জমি তৈরি করেন তারা। অগ্রহায়ণ মাসে লাগান বীজ। চৈত্র মাস থেকে শুরু হয় মরিচ তোলা। এ সময় কাঁচা মরিচ বিক্রির পর, পাকা মরিচগুলো শুকানো হয়। শুকনো মরিচ সংরক্ষণ করে বছরের যেকোনো সময় বিক্রি করা যায়। কম পুঁজিতে বেশি লাভের কারণে চরে মরিচ চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। একজন কৃষক চার বিঘা জমিতে মরিচ চাষ করতে পারলে, পরিবারের সারা বছরের সব ধরনের খরচের টাকা উঠে যায়।
কৃষিবিদরা বলছেন, সাধারণত বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরই চরের পলিমাটিতে বীজ ছিটিয়ে দিয়ে এরপর দু’তিনবার নিড়ানি দিলেই বিনা সারে বিস্তর ফলন হয় মরিচের। রোদে শুকানোর পর এই মরিচ হাট-বাজার হয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চাহিদা পূরণ করে থাকে। গাইবান্ধায় সারা বছর মরিচের চাষ হলেও অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত যে মরিচ চাষ হয়ে থাকে তা শুকিয়ে বাছাই করা হয়। বছরের অন্য মাসে যে মরিচ উৎপাদন হয় তা সাধারণত কাঁচা মরিচ হিসেবে বাজারজাত হয়। তাই বর্তমানে ওঠা লাল মরিচে সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখছেন চরাঞ্চলের কৃষকরা। এরই মধ্যে চাষিরা কেউ চরের বালু পথে হেঁটে, কেউবা ঘোড়ার গাড়িতে করে হাটে মরিচ বিক্রি করতে নিয়ে যেতে শুরু করেছেন।
গাইবান্ধা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, এ বছর ৩ হাজার ৮১৩ মেট্রিক টন শুকনা মরিচ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে জেলার ৭ উপজেলায় ২ হাজার ৯৬৭ হেক্টর জমিতে মরিচের আবাদ হয়েছে। এর ৮০ শতাংশই চাষ হয়েছে ফুলছড়ির চরাঞ্চলে। এর বাজার মূল্য আনুমানিক ১১০ থেকে ১১৫ কোটি টাকা।
২৫ বছরের বেশি সময় ধরে মরিচ চাষ করে আসছেন ফুলছড়ি উপজেলার এ্যারেন্ডাবাড়ী ইউনিয়নের আলগারচরের মোন্নাফ গাজী। তিনি এ বছরও চার বিঘা জমিতে মরিচের চাষ করেছেন। প্রতি বিঘা জমিতে মরিচ চাষে খরচ হয়েছে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। এবার কাঁচা অবস্থায় প্রতি বিঘা জমিতে গড়ে ৩০-৪০ মণ করে মরিচের ফলন হয়েছে। শুকানোর পর বিঘাপ্রতি ফলন টিকছে ১০ থেকে ১২ মণ। প্রতি মণ শুকনো মরিচ ১২ হাজার টাকা দরে বিক্রি করে খরচ বাদে বিঘাপ্রতি কৃষক পাচ্ছেন ৭৫ হাজার থেকে এক লাখ টাকা।
ফুলছড়ি উপজেলার ফজলুপুর ইউনিয়নে ব্রহ্মপুত্রের চরগ্রাম খাটিয়ামারীর কৃষক আবুল হোসেন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে মরিচ তুলছিলেন। তিনি জানালেন, এবার সোয়া বিঘা জমিতে মরিচ চাষ করেছেন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ফলন ভালো হয়েছে। সোয়া বিঘা জমিতে প্রায় ১৫-১৬ মণ শুকনো মরিচ হবে। এরই মধ্যে এক মণ শুকনো মরিচ বিক্রি করেছেন তিনি। বর্তমানে প্রতি মণ মরিচ ১০ হাজার ৫০০ থেকে ১১ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে বিঘা চুক্তিতে কেউ কেউ মরিচসহ ফড়িয়া-ব্যাপারীদের কাছে খেত বিক্রি করছেন। ফড়িয়া-ব্যাপারীরা সিন্ডিকেট তৈরি করে খেত থেকে কম দামে মরিচ কিনছে। কৃষকের লাভ, ব্যাপারীরা চুষে খাচ্ছে।
কাবিলপুর চরের মরিচ-চাষি আব্দুল মজিদ জানান, লাল মরিচ গাছ থেকে সংগ্রহ করছে মসলা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। লাল মরিচ কৃষকের আঙিনায় শুকিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ফ্যাক্টরিতে নিয়ে যাচ্ছে।
ফুলছড়ি উপজেলায় মরিচ চাষ বেশি হওয়ায় এখানে জেলার একমাত্র মরিচের হাট বসে। গজারিয়া ইউনিয়নে ব্রহ্মপুত্র সংলগ্ন হাটে বিভিন্ন চর থেকে প্রচুর মরিচ আসে। ‘ফুলছড়ি হাট’ নামে পরিচিত এই হাট এখন লাল মরিচের আমদানিতে জমজমাট। গাইবান্ধা সদর, ফুলছড়ি, সাঘাটা ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলার চরাঞ্চল এবং জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জের কয়েকটি চর থেকে কৃষক ও পাইকাররা মরিচ বিক্রি করতে আসেন জেলার বৃহৎ এই মরিচের হাটে। আর বগুড়া জেলা থেকে মরিচ কিনতে আসছেন ব্যাপারীরা। সপ্তাহের শনিবার ও মঙ্গলবার দুই দিন সকাল সাতটা থেকে হাট বসে। প্রতি হাটে ২ হাজার মনের বেশি মরিচ বিক্রি হয় বলে জানান হাটের ইজারাদার।
ফুলছড়ি হাটের পাইকার সিরাজুল ইসলাম ব্যাপারী জানান, চরের জমির মরিচের গুণ-মান ভালো। বিভিন্ন মসলা উৎপাদনকারী কোম্পানির কাছে এর চাহিদা বেশি। তিনি এই হাট থেকে শুকনো মরিচ কিনে বিভিন্ন কোম্পানির কাছে বিক্রি করেন।