ই-পেপার রবিবার ২৩ মার্চ ২০২৫
রবিবার ২৩ মার্চ ২০২৫
ই-পেপার

রবিবার ২৩ মার্চ ২০২৫

জীবন্ত সত্তা হিসেবে আমাদের নদ-নদী
প্রকাশ: শুক্রবার, ২১ মার্চ, ২০২৫, ৩:২৬ এএম  (ভিজিট : ৩৫৪)
ছবি: সময়ের আলো

ছবি: সময়ের আলো

এ বিশ্বের ছোট বড় মিলে ২৭টি সভ্যতার মধ্যে প্রায় প্রতিটি সভ্যতাই গড়ে উঠেছে নদ-নদীকে ঘিরে। বস্তুত মানবসভ্যতা ও নদী পরস্পর সম্পর্কিত এবং অনেক ক্ষেত্রে পরিপূরক বললে ভুল হবে না। কেননা নদীকে কেন্দ্র করেই মানবসভ্যতার উৎপত্তি, বিকাশ ও বিস্তার ঘটেছে। নদী বিভিন্ন আঙ্গিকে অফুরন্ত অবদান দিয়ে তার তীরবর্তী মানবসভ্যতার উৎকর্ষ সাধন করেছে। 

মূলত নদীর মাধ্যমে জীবিকা অর্জন করে মানুষ গড়ে তুলেছে শহর, বন্দর ও ব্যবসাকেন্দ্র। তাই নদীর প্রতিপালন ও রক্ষণাবেক্ষণে সব দেশেই রাষ্ট্রীয়ভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু ধান শালিকের এই বাংলাদেশে নদ-নদীর যে এত অবদান এবং প্রাণ বৈচিত্র্য সমাহারের কেন্দ্রবিন্দু; সেই নদ-নদী আজ আক্রান্ত এবং দিনে দিনে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। একসময় বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হিসেবে বিশ্বব্যাপী সুপরিচিতসহ ধন-ধান্যে পুষ্প ভরা ছিল। আজ সেই নদ-নদী চরম সংকটাপন্ন। দূষণ আর দখলে নদীগুলো হারাতে শুরু করেছে তার অস্তিত্ব। 

পাঁচ দশক আগেও হাজার নদীর (অর্থাৎ ১০০৮টি) তরুরাজি ঘেরা এই দেশের তকমা হারিয়ে এখন বাংলাদেশের নদীর সংখ্যা কমতে কমতে ঠেকেছে মাত্র ৩১০টিতে। সংখ্যা ও নাব্যতা দুই-ই হ্রাসের কারণে এদের অবস্থান সঙ্গিন। এমনকি দেশের প্রধান নদ-নদী পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র রীতিমতো হুমকির মুখে। এমনই পরিস্থিতিতে দেশের নদ-নদীগুলোকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছে আইনের হাত উঁচু করে দেশের মহামান্য সর্বোচ্চ আদালত। কেননা নদ-নদীকে বাঁচাতে তথা রক্ষা করতে হাইকোর্ট ইতিমধ্যে নদ-নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা’ হিসেবে ঘোষণা করেছেন।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, নদীর কি জীবন আছে এবং কীভাবে জীবন্ত সত্তা হতে পারে? যার জীবন আছে, সেটাই ‘জীবন্ত সত্তা’। আর জীবন থাকার সুবাদে তার বেঁচে থাকার কতিপয় মৌলিক অধিকার স্বীকৃতি লাভ করে। তাই এ বিষয়টি যদি ঘুরিয়ে বলি, তা হলে এটা দাঁড়ায়Ñযেসব ব্যক্তি বা বস্তুর আইনি স্বীকৃতসহ কতিপয় অধিকার ও সুবিধা নির্দিষ্ট করা থাকে, তাকে বলা হয় ‘জীবন্ত সত্তা’। এ ক্ষেত্রে খ্যাতনামা কর্নেল ল’র সংজ্ঞানুযায়ীÑ‘জীবন্ত সত্তা হলো সেই ব্যক্তি বা বস্তু, যাকে ব্যক্তি হিসেবে কতিপয় অধিকার প্রদান করা হয়’। ওই আইনে বর্ণিত সুবিধা কিংবা অধিকার থেকে বঞ্চিত হলে ওই ব্যক্তি বা বস্তু আদালতে তার প্রতিকার চাইতে পারেন। সেহেতু মানুষ বা অন্যান্য প্রাণীর মতো নদীও তার বেঁচে থাকার জন্য আদালত কর্তৃক কতিপয় মৌলিক অধিকার লাভ করে। এ ক্ষেত্রে বস্তুগত কোনো সম্পত্তিকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করা হলে; সে ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তি ওই বস্তুর পক্ষে আদালতের দ্বারস্থ হতে পারবেন। 

আর আদালত সেই ব্যক্তি বা বস্তুর বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশনা দেবেন। তাই এ ব্যাপারে সহজে বলতে পারি যে, আদালত কর্তৃক কতিপয় মৌলিক অধিকার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা বিধানই হলো জীবন্ত সত্তার প্রতিভূ। এ ক্ষেত্রে সেই বস্তু তথা নদী মনুষ্যজীবের মতো অধিকার নিয়ে মাথা উঁচু করে থাকতে পারে। 

সংগত কারণেই নদ-নদীর জীবন্ত সত্তার ব্যাপারে ইতিহাস থেকে সংগৃহীত তথ্যাদির আলোকে কিছুটা আলোচনা করা যাক। ২০১৬ সালে সর্বপ্রথম কলম্বিয়ার সাংবিধানিক আদালত চকো রাজ্যের কৃষ্টি ও সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা রক্ষার উদ্দেশ্যে আত্রাই নদীকে ‘স্বাধীন সত্তা’ হিসেবে ঘোষণা করেন। এদিকে ২০১৭ সালের ২০ মার্চ ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের হাইকোর্ট হিন্দু সম্প্রদায়ের উপাসনার জন্য পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত গঙ্গা নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে ঘোষণা করেন। বস্তুত হিন্দু সম্প্রদায় এ নদীকে ‘গঙ্গা মাতা’ বলে অভিহিত করে থাকেন। 

তবে পরবর্তী সময়ে আদালতের এ ঘোষণা বাতিল হয়ে যায়। আর ২০১৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি বিশ্বের তৃতীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উচ্চ আদালত তুরাগ নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা’ ঘোষণা করে রায় প্রদান করেন। এ ব্যাপারে ২৮৩ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালের ১ জুলাই। ঐতিহাসিক এ রায়ে তুরাগসহ বাংলাদেশের মধ্যে ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহমান সব নদ-নদীকে আইনি ব্যক্তি বা আইনি সত্তা বা জীবন্ত সত্তা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। একই সঙ্গে দেশের সব নদ-নদীকে দূষণ ও দখলমুক্ত করে সুরক্ষা, সংরক্ষণ এবং উন্নয়নের নিমিত্তে নদী রক্ষা কমিশনকে আইনানুগ অভিভাবক ঘোষণা করা হয়। অন্যদিকে আইনসভায় আইন পাসের মাধ্যমে নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা’ ঘোষণাকারী বিশ্বের প্রথম দেশ হলো নিউজিল্যান্ড। ২০১৭ সালের ১৫ মার্চ নিউজিল্যান্ডের আইনসভায় ‘হোয়াংগানুই’ নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা’ ঘোষণা করা হয়। আসলে দূষণ ও দখলের হাত থেকে রক্ষা করতেই নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করা হয়। কোনো নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করা হলে, সে নদী মানুষ ও প্রাণীর মতো কতিপয় আইনি অধিকার লাভ করে। এর মাধ্যমে মানুষের মতো নদীরও কতিপয় মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা পায় এবং যুগপৎ তা রক্ষার আইনি ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।

অসংখ্য নদ-নদী বাংলাদেশকে জালের মতো জড়িয়ে রেখেছে। শুধু তাই নয়, নদীর কলতান ও সৌন্দর্য বাংলাদেশকে আকর্ষণীয় রূপময় অবয়ব দান করেছে। বাংলাদেশের নদ-নদীর কতগুলো বিশেষত্ব ও বৈচিত্র্য রয়েছে। দেশে ২০০ কিলোমিটার বা তারচেয়ে বেশি দৈর্ঘ্যরে নদী আছে ১৪টি; যেমন পদ্মা, ইছামতী, সাঙ্গু/শঙ্খ, ধলেশ্বরী, কুশিয়ারা, সুরমা, ভৈরব, বংশাই, কপোতাক্ষ, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, পুনর্ভবা, মেঘনা, বাঙ্গালী ও নবগঙ্গা। আবার সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম নদী হলো ৩টি যেমন : গাঙ্গিনা, কলমদানী ও ইটবাড়িয়া। এদিকে মজার ব্যাপার হলো- ১১টি নদী আছে শুধু ইছামতী নামেই। আর বাংলাদেশে নদীপথ হলো ২২ হাজার কিলোমিটার। সবচেয়ে বেশি নদী প্রবাহিত জেলা সুনামগঞ্জ (৯৭টি নদী) আর সবচেয়ে বেশি জেলা দিয়ে প্রবাহিত নদী পদ্মা (১২টি জেলা)। এসব নদ-নদীর অপার সৌন্দর্য আমরা বাংলাদেশিদের মুগ্ধ করে। 

আর এসব নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে আবহমানকালের বাঙালি সংস্কৃতি। বাংলাদেশের নদ-নদীর সৃষ্টি ও বিস্তার নিয়ে আছে কিংবদন্তি ধর্মীয় পুরাণ ও লোকগাথা। বাংলাদেশের বড় বড় নদ-নদীগুলোর তর্জন-গর্জন ও প্রমত্ততা নিয়েও আছে নানা ইতিহাস। নদীকে উপজীব্য করে বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে। রচিত হয়েছে অসংখ্য উপন্যাস, নাটক, কবিতা, গান ও লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন ধারা। তাই নদ-নদী বাঙালি জাতির স্বকীয়তার ধারক ও বাহক বললে বেশি বলা হবে না। নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। 

কিন্তু ক্রমাগত দখল ও দূষণে বাংলাদেশের অনেক নদী আজ মৃতপ্রায়। শিল্প কারখানার বর্জ্য, বিষাক্ত কেমিক্যাল, ক্ষতিকর প্লাস্টিক, পলিথিন, জৈব, অজৈব ও গৃহস্থালি বর্জ্য নিক্ষেপ করে নদীকে দূষিত করা হচ্ছে। ফলে নদীগুলো এখন সেই নদীর রূপে নেই। 

শুধু তাই নয়, এসব নদীর তীরবর্তী অঞ্চল এখন চাষাবাদের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। অধিকন্তু এতদঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে নানারকম রোগব্যাধি। তথাকথিত প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দ্বারা নদী দখল এখন বাংলাদেশে এক ধরনের কালচারে পরিণত হয়েছে। আইন ও প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নদী দখল করে যাচ্ছে এই নদী খেকো দুর্বৃত্তরা। বর্তমানে বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো হুমকির সম্মুখীন এবং বলতে গেলে অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার পথে। সেই শহর বা জনপদ সবচেয়ে সৌভাগ্যবানÑযে শহর বা জনপদের পাশ কিংবা মধ্য দিয়ে নদী প্রবাহিত হয়। আর আমাদের দেশের রাজধানী ঢাকা শহরের পাশ দিয়ে একটি নয়, দুটি নয়, চার চারটি নদী প্রবাহমান। ঢাকার চারপাশের চারটি নদীর যথাযথ এবং সঠিক ব্যবস্থাপনা করতে পারলে ঢাকা বহু আগেই হংকং কিংবা সিঙ্গাপুরের চেয়েও সুন্দর এবং নান্দনিক নগরীতে পরিণত হতো। আমরা আমাদের সৌভাগ্যকে দুর্ভাগ্যে পরিণত করেছি ক্রমাগতভাবে নদী দখল এবং দূষণের মাধ্যমে। যেভাবেই বলি না কেন, নদীগুলো বাঁচা-মরার ওপর বাংলাদেশের অস্তিত্ব নির্ভর করে। মূলত নদী আমাদের বেঁচে থাকার ভরসা। 

আমাদের প্রকৃতি সুরক্ষা ও নান্দনিকতার জন্য বড় নিয়ামক। কিন্তু এভাবে নদ-নদী দূষণ ও দখল হলে তা এক দিন বিলীন হয়ে যাবে। আর নদ-নদী বিলীন হয়ে গেলে থাকবে না পানি। পানি না থাকলে থাকবে না মৎস্য সম্পদ, হবে না কৃষিকাজ এবং মানুষের পক্ষেও বেঁচে থাকা দুরূহ হয়ে উঠবে। সহজ ভাষায় যদি বলি তা হলে এই দাঁড়ায় যে, পানি না থাকলে থাকবে না জীবন অর্থাৎ আমরা বাংলাদেশিদের ব্যক্তি হিসেবে বেঁচে থাকার সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার হারিয়ে যাবে। তাই নদী রক্ষার দায়িত্ব যেমন রয়েছে রাষ্ট্রের, তেমনি সচেতন হতে হবে জনগণকে। 

নদী রক্ষার দায়িত্ব কেবল কোনো বিশেষ সংস্থা বা গোষ্ঠীর নয়। এটা আমাদের টিকে থাকার জাতীয় অপরিহার্য আন্দোলন। আর এ আন্দোলনে আমাদের সবাইকে আন্তরিকতা নিয়ে শরিক হতে হবে।




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ। নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।
ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close