
ছবি: সময়ের আলো
২০২১ সালে হয়ে যাওয়া একটি ধর্ষণ মামলার রায় দিয়েছে ঢাকার একটি নিম্ন আদালত। রায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। একজন গৃহশিক্ষকের অপরাধের সাজা হিসেবে এই রায় প্রদান করা হয়েছে। রায় দেওয়া হলো এমন একসময়ে যখন মাগুরার শিশুটিকে নিয়ে সংঘটিত হায়েনার হিংস্র ছোবলের বিচারের দাবি ঐকমত্যে পরিণত হয়েছে।
মসজিদে, সমাজে, পথে-ঘাটে সর্বত্র এর বিচারের দাবি উঠেছে। জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে হায়েনাদের বাড়ি ভস্মীভূত করেছে। প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে আদালতের কাছে এরা স্বীকারোক্তিও দিয়েছে। বিষয়টি ভাবার। কারণ সমাজ কোন স্তরে পৌঁছলে পিতা-পুত্র মিলে একটি শিশুর ওপর এ ধরনের পশুর চেয়েও অধম অপকর্মে লিপ্ত হতে পারে। বলা দরকার পশুপাখিও কখনো অনাচারের নিয়মভঙ্গ করে না যা এসব দ্বিপদী পশুরা করেছে।
ভাবার রয়েছে, এ কারণে যে এটি মূলত এখন কঠিন সংক্রমণে পরিণত হয়েছে। সময়-কাল উল্লেখ করে এর পরিসংখ্যান তুলে ধরে কোনো লাভ নেই। শুধু অলোচিত দুই-চারটি ঘটনা মনে করিয়ে দেওয়া যায় মাত্র। কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় মজনুর হাতে পাশবিক লাঞ্ছিত হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী। ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের কয়েক দিন আগে পরকীয়া নিয়ে পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তা ও বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বিরোধ প্রকাশ্য বিবাদের সৃষ্টি করেছিল। রাজনৈতিক সুবিধা লাভে বিগত আমলে মেয়েদের বাধ্যকরণের খবরও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এসব নিয়ে নানা কথা ক্ষমতার বৃত্তবলয়ের নানা জারিজুরির কথা বলা হয়েছিল।
ব্যাপারগুলো শুধু এখানেই সীমাবদ্ধতা নয়। ঘরে-বাইরে, রাস্তায়, পথে-ঘাটে, বাসাবাড়িতে প্রায়শই এসব ঘটছে যার খুব সামান্যই প্রকাশিত হচ্ছে। কেন এমনটা হচ্ছে বা হতে পারছে। যে কেউ স্বীকার করবেন আমাদের সমাজে এ ধরনের প্রবণতা অনুপস্থিত ছিল। আমরা মূলত মূল্যবোধভিত্তিক সমাজে বিশ্বাসী। আমাদের পরিবার, সমাজ বিন্যস্ত হয়েছে মূল্যবোধের ভিত্তিতে। আমরা পারিবারিক জীবনে অভ্যস্ত। তা হলে কেন এবং কি কারণে এই সংক্রমণের বিষবাষ্প তাণ্ডবে রূপ নিয়েছে। মাগুরার ঘটনার পর আইনমন্ত্রী পর্ণোগ্রাফির প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। আইন করে পর্নোগ্রাফি বন্ধের ঘোষণা দিয়েছেন। বলা ভালো এ কথা নতুন নয়। এর আগেও এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আসলে তাতে কাজ যে খুব একটা হয়েছে তা নয়। সুতরাং ভাবতে হবে সমস্যার গভীরে। আমরা কাউকে দায়ী করে নিজেকে দায়মুক্ত হওয়ার বা ভাবার কোনো সুযোগ নেই। আমরা ধসে যাচ্ছি কেন? কোথায় আমরা হেরে যাচ্ছি সেটি নিয়েই কথা।
সমাজের মাথা হচ্ছে রাজনীতিকরা। রাজনীতিবিদরাই সমাজ পরিচালনা করেন। তাদের প্রবর্তিত নিয়মই সর্বত্র বিস্তৃত হয়। সমাজে ব্যভিচার, ধর্ষণ নিরোধ নিয়ে আমাদের রাজনৈতিক চর্চায় কতটা ঐকমত্য রয়েছে সেটি অবশ্যই বিবেচিত। মাগুরার ঘটনার মতো আরেকটি ঘটনা ছিল ইয়াসমিনের ঘটনা। এর সঙ্গে দায়ী ছিল টহলরত পুলিশ। পুলিশ মেডিকেল সেন্টারে খোঁজ নিলে দেখা যাবে সিফিলিজ গনোরিয়ায় আক্রান্ত বহু পুলিশ। এদের বারবার সতর্ক করার পরও পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি বা হয় না। এক রিপোর্টে বলা হয়েছে রাতে যেসব পুলিশ দায়িত্ব পালন করে তাদের একটি অংশ কথিত ভবঘুরে মেয়েদের সঙ্গে বিনে পয়সায় এসব ঘটনা ঘটিয়ে থাকে। ব্যতিক্রমও রয়েছে। আবার ওপরের নির্র্দেশে নিয়ে যাওয়ারও ব্যবস্থা করা ফুর্তির জন্য। অবশ্যই ভেবে দেখার বিষয়Ñরাতে যদি পুলিশ প্রহরা না রাখা হয় তা হলে অরক্ষিত নগরের অবস্থা কি দাঁড়াবে, আবার যাদের ডিউটি দেওয়া হয় তাদের অবস্থা যদি এ রকম হয় তা হলে ডিউটি দিয়েই লাভ কি? এর অর্থ হচ্ছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মধ্যেই আইনের প্রতি তোয়াক্কা না করার নজির রয়েছে।
দেখা যাবে খবর প্রকাশিত হোক বা না হোক সমাজের সর্বত্রই ব্যভিচারমূলক নিপীড়নের নজির রয়েছে। তা হলে আইন করে পর্নোগ্রাফি বন্ধ করার মধ্য দিয়ে আমরা কতটা সুফল লাভ করতে সক্ষম হব। এর অর্থ এই নয় যে পর্নোগ্রফি বন্ধ করা যাবে না। অবশ্যই এ ব্যাপারে কঠোর নীতি অবলম্বন করতে হবে। পুরোনো খবর অনুযায়ী পুরো রাজধানীর বিভিন্ন বিপণিবিতানে গোপনে এসব পর্নোগ্রাফির ভিডিও পাওয়া যায়।
এসব বিক্রির জন্য কোনো কোনো সংস্থাকে অবৈধ ঘুষও প্রদানের অভিযোগ রয়েছে। সমাজের বহু মানুষ পেন ড্রাইভে এসব পর্ণো নিয়ে ঘুরে। ইতিপূর্বেকার প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছিল বিশ্বে এক নাম্বার ব্যবসা হচ্ছে পর্নোগ্রাফি। অথচ বিশ্বে যারা মানবতা ফেরি করে বিক্রি করে তারাই মানুষকে দিয়ে অসামাজিক এই কথিত ব্যবসা পরিচালনা করছে। বলতে দুঃখ লাগলেও এ কথা সত্যি ধর্মীয় মূল্যবোধের শিক্ষা দেওয়া হয় যেসব প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ মাদরাসা এমনকি মসজিদের কোনো কোনো ইমামও এখন এসব ঘৃণ্য প্রবণতায় যুক্ত হয়ে আছে।
সংক্রমণের প্রতিশোধক না দিলে তা ছড়িয়ে পরে। ক্রমশ গ্রাস করে। একসময় পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে তখন আর করার কিছুই থাকে না। শিক্ষক, ইমাম অপ্রাপ্তবয়স্ক ছাত্রছাত্রী, আমলা, পুলিশ থেকে শুরু করে সব শ্রেণি-পেশার একশ্রেণির দুষ্কৃতকারীর মধ্যে এই প্রবণতা ছড়িয়ে পড়ার যে প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে তাতে প্রতিরোধ হতে হবে কার্যকর। এখানে বলা ভালো, আমাদের রাষ্ট্রীয় আচারে এই অপপ্রবণতার প্রচলন হয়েছিল।
গণঅভ্যুত্থানে পতন হওয়া সামরিক স্বৈরাচার এরশাদের কথা বিবেচনায় আনুন। রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যবহার করা হতো বিদেশি এবং দেশি নারী ব্যবহারের উৎসাহিত করতে। আবার শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কথা বিবেচনায় আনুন। দেখা যাবে তার হাতে এ দেশে প্রকৃত নারীর জাগরণ হয়েছিল। অথচ তার ব্যক্তিগত জীবন ছিল নিষ্কলুষ। আমাদের রাজনৈতিক চর্চায় ব্যভিচারের বিষয়টি প্রায় অনালোচিত। কেউ পদোন্নতির অপচেষ্টায়, কেউ ভিন্ন সুবিধা লাভের প্রয়াসে এসব অপকর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
কয়েক দিন আগে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের আগে যশোরের যে আলোচিত-কথিত এমপি খুন হয়েছিল ভারতের কলকাতায় সেখানেও এসব বিষয়ের সম্পৃক্ততা রয়েছে। আমাদের বার সোসাইটি ক্লাবে অপকালচারের নামে যা ঘটছে তার বিবরণ তো আমাদের সবারই জানা। আমাদের সমাজের এক বিরাট অংশ নারী।
সমাজে শিক্ষায় চাকরিতে যদি তাদের অধিকার নিশ্চিত করা না যায় তা হলে সমাজ এগোবে না। বেগম রোকেয়ার ভাষায় কোনো গাড়ির একটি চাকা খুব ছোট আরেকটি চাকা বড় হলে গাড়িটি চলবে না ঘুরবে। সমাজের চাকা ঘোরাতে হলে সমমর্যাদায় এগোতে হবে। এই এগোবার জন্যই সমাজকে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ কায়েম করতে হবে। এই সমাজ কায়েমের দায়িত্ব একার নয়। এটি সবার। আজকে আমরা যারা অনুভব করছি সমাজ ভেঙেছে বা সমাজ অরক্ষিত হয়ে পড়েছে তারা কি সমাজ সংশোধনের কথা ভাবছে। সংশোধনের পদ্ধতি হচ্ছে আত্মসংশোধন।
নিজে সংশোধিত না হলে যেমনি আত্মসংশোধন অসম্ভব তেমনি নিজে সংশোধিত না হলে পরিবার সংশোধিত হবে না। পরিবার সংশোধিত না হলে সমাজ পরিবর্তিত হবে না। সমাজ পরিবর্তিত না হলে রাষ্ট্রের পরিবর্তন আশা করা কল্পনাবিলাস। ধর্ষণ-ব্যভিচার আমরা যাই বলি না কেন এখানে একটি বিষয় বলার রয়েছে। বিদ্যমান আইনে আপসের বিষয় বলে যে বিধান রয়েছে সেটি মূলত ধর্ষণকে উসকে দিয়ে থাকতে পারে।
সমাজের সাধারণ মানুষ মাগুরার ঘটনায় যে ঘৃণা রোষ প্রকাশ করেছে তাকে খাটো করে দেখা সুযোগ নেই বরং এক গভীর অনুভূতি এবং অনুভবে নিয়ে এর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। সমাজে যারা জনমত গঠনে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন তাদের এর বিরুদ্ধে জনমত গঠন কতে হবে। ধর্মীয় চর্চার সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের কঠিনভাবে সতর্ক হতে হবে।
এটি মনে রাখা জরুরি যে, একটি বা দুটি মামলার রায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো বা তা যদি কার্যকরও হয় তাতে এসবের অবসান হবে না, হতে পারে না। তার প্রমাণ ইতিমধ্যেই দেখা যাচ্ছে। মাগুরার ঘটনায় যখন সারা দেশে তোলপাড়
চলছে তখনও কিন্তু দুর্বৃত্তরা থেমে নেই। একটার পর একটা ঘটেই চলছে। এ যেন এক নতুন চ্যালেঞ্জ। বিচার হতে হবে দৃষ্টান্তমূলক ও নিরপেক্ষ। আমাদের মতো সমাজে যদি মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ করা না যায় তা হলে কার্যত সমাজ, রাষ্ট্র রক্ষা কঠিন হয়ে পড়তে পারে। আমরা গণতন্ত্র বা যাই বলি না কেন সমাজ ঠিক না থাকলে সবাই গড়ল ভেল।