
যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা প্রধান তুলসী গ্যাবার্ড। ছবি: সংগৃহীত
প্রকৃত ঘটনা না জানলেও দিল্লি সফরে এসে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা প্রধান তুলসী গ্যাবার্ড বাংলাদেশ নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। মূলত তুলসী গ্যাবার্ড তার ব্যক্তিগত দর্শন ও চর্চা এবং ভারতীয় মিডিয়ার অতি উৎসাহের কারণেই এমন মন্তব্য করেছেন বলে কূটনীতিকরা বলছেন।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, গত ৫ আগস্ট ঢাকার পটপরিবর্তনের পরপরই ধারাবাহিকভাবে ভারতীয় মিডিয়া বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে। এর মধ্যে তুলসী গ্যাবার্ড গত ১৭ মার্চ একাধিক ভারতীয় মিডিয়ায় বাংলাদেশ সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য করেন এবং এমন মন্তব্য প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা প্রধানের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে বিবৃতি প্রকাশ করে। তুলসী গ্যাবার্ড ১৯৮১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামোয়ার প্রধান দ্বীপ তুতুইলার লেলোলোয়া, মাওপুতাসি কাউন্টিতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা আমেরিকান, মা ভারতীয়Ñকিন্তু বড় হয়েছেন মিসিগানে। তুলসী শৈশবেই হিন্দুধর্মে দীক্ষা নেন এবং তিনি ইসকনের অনুসারী।
হিন্দুধর্মের প্রতি তুলসীর কিশোর বয়স থেকেই বিশেষ অনুরাগ রয়েছে। যে কারণে তুলসী বাংলাদেশ নিয়ে ভারতীয় মিডিয়ার প্রচার করা সংখ্যালঘু নির্যাতন সম্পর্কের তথ্য-উপাত্তগুলোর কোনো বাছ-বিচার না করেই বিশ্বাস করে বক্তব্য দিয়েছেন। ঢাকার কূটনীতিকরা বলছেন, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতীয় মিডিয়ার এমন মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর বিষয়টি এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে একাধিক সময়ে বিভিন্ন মাধ্যমে জানিয়েছে বাংলাদেশ।
মোট কতটি কী কী বিষয়ে ভারতীয় মিডিয়াগুলো বাংলাদেশ নিয়ে মিথ্যা তথ্য প্রচার করছে তার পরিসংখ্যানও প্রকাশ করা হয়েছে। ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান রিউমার স্ক্যানারের জানুয়ারি মাসের তথ্য বলছে, ভারতীয় গণমাধ্যম এবং ভারত থেকে পরিচালিত বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যাকাউন্ট থেকে বাংলাদেশকে জড়িয়ে ২৭১টি ভুয়া তথ্য প্রচারের প্রমাণ মিলেছে। যার মধ্যে তথ্যভিত্তিক ভুল ছিল ১১৫টি, ছবিকেন্দ্রিক ভুল ছিল ৫৪টি এবং ভিডিওকেন্দ্রিক ভুল ছিল ১০২টি। শনাক্ত হওয়া এসব ভুল তথ্যগুলোর মধ্যে মিথ্যা হিসেবে ১৭৫টি, বিভ্রান্তিকর হিসেবে ৬৫টি এবং বিকৃত হিসেবে ৩১টি ঘটনাকে সাব্যস্ত করা হয়েছে।
ভারতীয় মিডিয়ার প্রকাশিত এসব অপতথ্য সম্পর্কে ঢাকার কূটনীতিকরা এরই মধ্যে ওয়াশিংটনের কূটনীতিকদের অবগত করেছেন। ওয়াশিংটনের কূটনীতিকরাও ঢাকার কূটনীতিকদের বলেছেন যে বিষয়টি তারাও বোঝে। এরই মধ্যে তুলসী গ্যাবার্ডের মন্তব্যে অবাক হয়েছেন ঢাকার কূটনীতিকরা। তুলসী গ্যাবার্ড নিজেই বলেছেন যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ক্যাবিনেটের সদ্য দায়িত্ব নেওয়া সদস্যদের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের কথাবার্তা মাত্র শুরু হয়েছে। আবার একই সঙ্গে তিনি প্রকৃত ঘটনা না জেনে-বুঝেই বাংলাদেশ নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেন। অর্থাৎ এখানে তিনি তার লালিত দর্শন বা চর্চা থেকেই মন্তব্য করেন। এরই মধ্যে গত ১৮ আগস্ট মার্চ ঢাকায় সফররত মার্কিন সিনেটরকে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন যে ধর্মীয় সম্প্রীতির প্রকৃত তথ্য জানতে দেশটি সফর করার জন্য অন্যান্য মার্কিন রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক এবং কর্মীদের আমন্ত্রণ জানাই।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম দৈনিক সময়ের আলোকে বলেন, বাংলাদেশ গত ৭-৮ মাস ধরে জটিল পরিস্থিতির মোকাবিলা করছে। স্বৈরাচার সরকার পতনের পর বাংলাদেশের নতুন সরকার কাঠামো গঠন করা হয়েছে এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সংস্কার করা হচ্ছে। এখানে অনেক গ্যাপ বা ঘাটতি রয়েছে। এই ঘাটতির সুযোগ নিয়ে কিছু কিছু গোষ্ঠী সবকিছু ঘোলা করার চেষ্টা করছে। যাই হোক আমেরিকা বাংলাদেশের জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক তেমনি ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে বাংলাদেশও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসনের সময়েও একই বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে ওঠা-নামা ছিল।
গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশের পটপরিবর্তনের যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ছিল কি না তা জানি না। তবে ৫ আগস্টের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র খুশি হয়েছে এবং পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহকে স্বাগত জানিয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্ব নেওয়ার পর তাদের ফরেন পলিসি রিভিজিট শুরু করেছে। তবে সেটি কেমন হবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। আবার আমেরিকার ফরেন পলিসি অন্যান্য দেশের মতো রাজনৈতিক দল কর্তৃক নির্ধারিত হয় না। আমেরিকার ফরেন পলিসি তাদের সংস্থাগুলো কর্তৃক ঠিক করা হয়। তাই তুলসী গ্যাবার্ডের মন্তব্য বা মনোভাব বাংলাদেশের জন্য ভবিষ্যতে নেতিবাচক দিকে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। যেমনটি অনেকেই ট্রাম্প-মোদি বৈঠকের পর প্রেস কনফারেন্সে অনেকেই ভেবেছিলেন যে ট্রাম্প এমন মন্তব্য করবেন যাতে বাংলাদেশ বিপাকে পড়বে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ট্রাম্প কিন্তু এমন কিছু করেনি। তুলসীর বক্তব্য থেকে দুটি বার্তা আছে, এক. ভারতের চোখ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে দেখছে না। দুই. তুলসীর বক্তব্যে তার জীবন দর্শন ও চর্চারই প্রকাশ পেয়েছে। এই জায়গা থেকে এটিই প্রত্যাশিত যে তুলসী এমন মন্তব্যই করবেন। ভারতের সঙ্গে তুলসীর যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সে জায়গা থেকেই তিনি এমন মন্তব্য করেছেন।
ভারতের জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এবং আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক শ্রী রাধা দত্ত দৈনিক সময়ের আলোকে বলেন, এর আগেও বাংলাদেশে নির্বাচনকেন্দ্রিক বিভিন্ন সময়ে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার পেছনে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী রয়েছে। এই গোষ্ঠীটি এসব উসকে দিচ্ছে। অন্যদিকে ভারতীয় মিডিয়া এসব নিয়ে উত্তেজিত। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের মূলে ধর্মীয় নয় রাজনৈতিক বিষয় রয়েছে। আর একটি বিষয় তুলসী গ্যাবার্ড কিন্তু তার বক্তব্যে ইসলামিক খেলাফত ইস্যুতে বাংলাদেশ নিয়ে কিছু বলেননি।
তুলসী ইসলামিক খেলাফত ইস্যুতে পুরো এশিয়ার চিত্র উপস্থাপন করেছেন। এখানে বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত করার কোনো অবকাশ নেই। বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র দুই পক্ষের মধ্যেই সফর ও বাণিজ্যসহ সবকিছুই হচ্ছে। মাঝে বাংলাদেশের পোশাক খাতে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের আগ্রহ কম ছিল, যা এখন আবার ঠিক হয়ে গেছে। তার মানে হচ্ছে, তুলসীর এমন বক্তব্যে দুই দেশের সম্পর্কে কোনো প্রভাব ফেলবে না। পুরো বিষয়টার মধ্যে অনেক কিছুর গ্যাপ আছে। এখানে মিডিয়ার কারসাজি রয়েছে এবং রাজনীতিসহ অনেক বিষয় আছে।