ই-পেপার বৃহস্পতিবার ২০ মার্চ ২০২৫
বৃহস্পতিবার ২০ মার্চ ২০২৫
ই-পেপার

বৃহস্পতিবার ২০ মার্চ ২০২৫

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জাতিসংঘের ভূমিকা দরকার
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ, ২০২৫, ৩:০৭ এএম  (ভিজিট : ১৫০)
মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ আর কে চৌধুরী

মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ আর কে চৌধুরী

মানবিক কারণে আশ্রয় দেওয়া রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে। জাতিগত ও ধর্মীয় কারণে মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত এসব অধিবাসী বহু বছর ধরে বাংলাদেশে এসেছে। বড় জনঢল নেমেছে দুবার। তাদের সংখ্যা এখন ১২ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এদের নিয়ে ত্রিমুখী চাপে পড়েছে বাংলাদেশ। প্রকৃতি ও পরিবেশে ব্যাপক বিরূপ প্রভাব পড়েছে রোহিঙ্গাদের কারণে। উন্নয়ন সহযোগী আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো প্রতিশ্রুতি সহায়তা অব্যাহত না রাখায় এদের পেছনে আনুষঙ্গিক ব্যয় মেটাতে সরকারকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। শুরু থেকেই নিরাপত্তারক্ষীদের ফাঁকি দিয়ে, কাজের খোঁজে শিবির থেকে বেরিয়ে রোহিঙ্গারা জনগণের মূল স্রোতে মিশে যেতে চেষ্টা করছে। 

জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অপরাধে। ক্যাম্পের ভেতরেও মাদক চোরাচালান ও কারবার, খুনখারাবির মতো ভয়ংকর অপরাধ নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এদের অনেকে কৌশলে পাসপোর্ট সংগ্রহ করে বিভিন্ন দেশে গিয়েও নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। তার ওপর আগামী মাস থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য সহায়তা কমিয়ে মাথাপিছু ৬ ডলারে নামানোর চিঠি দিয়েছে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি। এতে সরকারের ওপর অসহনীয় চাপ পড়বে।

গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তৃতীয় কোনো দেশ বা অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নিতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্র্বর্তী সরকারকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে কোনো গতিই নেই। এই যখন সার্বিক বাস্তব অবস্থা, তখন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনে গিয়ে সেখানে প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে ইফতার করেন। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসও উপস্থিতি ছিলেন। জাতিসংঘ মহাসচিব, প্রধান উপদেষ্টা এবং তাদের সঙ্গে থাকা দেশি-বিদেশি বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী ও অংশীজনদের সরেজমিন পরিদর্শন এ ক্ষেত্রে কল্যাণকর ফলাফল বয়ে আনবে বলে আশা করা যায়। তাদের প্রাজ্ঞ চোখে পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞ-বিজ্ঞ বিশ্লেষণ রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের পথ খুলে দিক প্রত্যাশা করে বাংলাদেশ।

জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস মনে করেন নিরাপদে, স্বেচ্ছায় এবং মর্যাদাপূর্ণভাবে ফিরে যাওয়াই এই সংকটের প্রাথমিক সমাধান। কক্সবাজারে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি দেখে মিয়ানমারের সব পক্ষের প্রতি সর্বোচ্চ সংযম অনুশীলন করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। আন্তর্জাাতিক মানবিক আইন অনুসারে বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দিতে এবং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও সহিংসতার আরও উসকানি রোধ করে গণতন্ত্রের পথ প্রশস্ত করতে বলেছেন। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, রোহিঙ্গাদের নিয়ে বিশ্ব একটি গভীর সংকটের দ্বারপ্রান্তে।

কারণ আর্থিক সহায়তা কমার ফলে ২০২৪ সালে মানবিক সহায়তার তুলনায় ২০২৫ সালে সহায়তা নাটকীয়ভাবে ৪০ শতাংশে নেমে আসার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এটি একটি নিরবচ্ছিন্ন বিপর্যয় হবে। মানুষ কষ্ট পাবে এবং মানুষ মারা যাবে। বাংলাদেশে আশ্রিত ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গার জন্য বিশ্বের সাহায্য-সমর্থন প্রয়োজন।
জাতিসংঘ মহাসচিব বলেছেন, ‘রোহিঙ্গা শরণার্থীরা এখানে এসেছে। তারা তাদের সুক্ষার, পরিবারের জন্য মর্যাদা, নিরাপত্তা চায়।’ 

তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গা শিবির ও রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া স্থানীয় সম্প্রদায়গুলো জলবায়ু সংকটের ঝুঁকিতে প্রথম সারিতে আছে। এটি ঠিক যে কক্সবাজার অঞ্চলের স্থানীয় মানুষের জীবন রীতিমতো দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। একটি জেলার একটি অংশে ১২ লাখ অতিরিক্ত মানুষ আশ্রয় নেওয়ায় তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

ওদিকে রোহিঙ্গাদের মধ্যে নানা ধরনের উগ্র ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠী জন্ম নিয়েছে। স্বাভাবিক আয়-রোজগারের সুযোগ কম থাকায় রোহিঙ্গারা মাদক, অস্ত্র চোরাচালানসহ নানা ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ডে যুক্ত হচ্ছে। স্থানীয় লোকজনকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করছে। আশ্রয়শিবিরগুলোতে প্রায়ই খুনখারাবির ঘটনা ঘটছে। স্থানীয় সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে তাদের যোগাযোগ বাড়ছে। আর সবমিলিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও হুমকির সৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশ এই অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে।

গত শুক্রবার ঢাকায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। বৈঠক প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানিয়েছে, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে এক বৈঠকে ঢাকার সংস্কার এজেন্ডার প্রতি জাতিসংঘের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন এবং বিশ্বের ‘সবচেয়ে বৈষম্যের শিকার জনগোষ্ঠীর’ জন্য তার উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রতি জাতিসংঘের ‘ব্যাপক কৃতজ্ঞতা’ প্রকাশ করেছেন গুতেরেস। নিরাপদে, স্বেচ্ছায় এবং মর্যাদাপূর্ণভাবে ফিরে যাওয়াই রোহিঙ্গা সংকটের প্রাথমিক সমাধান এ বাপারে কোনো সন্দেহ নেই। 

তাই রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের প্রত্যাবাসনে জোর দিতে হবে। এই অঞ্চলের প্রতিটি দেশ ও আঞ্চলিক সংস্থাকে এ সংকট সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের সম্মানজনক প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে হবে। দ্রুত প্রত্যাবাসনের চেষ্টা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতার কোনো বিকল্প নেই। আমাদের প্রত্যাশা, জাতিসংঘ মহাসচিবের এই সফর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আন্তরিক ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বস্তুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার জন্য জাতিসংঘ ও বিশ্বনেতাদের কাছে এর আগে বহুবার জোরালো দাবি জানানো হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এর কোনো ফল পাওয়া যায়নি। দুঃখজনক হলো, বিশ্বনেতারা মিয়ানমারের ওপর কার্যকর চাপ প্রয়োগ করতে আগ্রহী হচ্ছেন না। সবাই শুধু আশার বাণী শুনিয়েছেন। এত সংখ্যক রোহিঙ্গার ভার বছরের পর বছর বহন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। জাতিসংঘের সহায়তা কমিয়ে দেওয়া হলে এ দেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের আরও অপরাধে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা প্রবল। তাই আমরা আশা করব, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন না হওয়া পর্যন্ত তাদের জন্য জাতিসংঘের পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তা অব্যাহত থাকবে। পাশাপাশি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনেও জোরালো উদ্যোগ নেওয়া হবে। জাতিসংঘ মহাসচিব এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন বলে আমরা আশাবাদী।

লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ। নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।
ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close