
প্রতীকী ছবি
পৃথিবীতে যত নবী এবং উম্মতের আগমন হয়েছে, তন্মধ্যে শ্রেষ্ঠ হচ্ছেন শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং উম্মতে মুহাম্মদি। তুলনামূলকভাবে অন্যান্য উম্মত থেকে উম্মতে মুহাম্মদির আয়ুষ্কাল কম হলেও বরকতময় সৌভাগ্য অনেক বেশি। আল্লাহ তায়ালা উম্মতে মুহাম্মদির জন্য ইবাদতের এমন কিছু মৌসুম দিয়েছেন যখন অল্প ইবাদতে অনেক বেশি ফজিলত পাওয়া যায়। এটা আল্লাহ তায়ালার একটা বিশেষ অনুগ্রহ। রাসুলুল্লাহ (সা.) এটাকে খুব সুন্দর একটা উদাহরণের মাধ্যমে বুঝিয়েছেন।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে তিনি বলেন, তোমরা এবং উভয় আহলে কিতাবের (ইহুদি-খ্রিস্টান) উদাহরণ হলো এমন এক ব্যক্তির মতো, যে কয়েকজন শ্রমিককে কাজে নিয়োগ করে বলল, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এক কিরাত (নির্দিষ্ট পরিমাণ) পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কাজ কে করবে? তখন ইহুদি কাজ করে দিল। তারপর সে ব্যক্তি বলল, দুপুর থেকে আসর পর্যন্ত এক কিরাত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে আমার কাজ কে করে দেবে? তখন খ্রিস্টান কাজ করে দিল। তারপর সে পুনরায় বলল, আসর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দুই কিরাত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কে কাজ করে দেবে? আর তোমরাই (মুসলমানরা) হলে তারা (যারা অল্প পরিশ্রমে অধিক পারিশ্রমিক লাভ করলে)। তাতে ইহুদি-খ্রিস্টানরা রাগান্বিত হলো এবং বলল, এটা কেমন কথা? আমরা কাজ করলাম বেশি আর পারিশ্রমিক পেলাম কম! তখন সে ব্যক্তি (নিয়োগকর্তা) বলল, আমি কি তোমাদের পারিশ্রমিক কম দিয়েছি? তারা বলল, না। তখন সে বলল, এটা আমার অনুগ্রহ। যাকে ইচ্ছা তা দান করি। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২২৬৮)
উম্মতে মুহাম্মদির সুসংবাদের বাহন হচ্ছে পবিত্র কুরআন। আর এই কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে পবিত্র মাহে রমজানে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘রমজানই হলো সে মাস, যাতে অবতীর্ণ করা হয়েছে কুরআন। যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং এমন সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলি সংবলিত, যা সঠিক পথ দেখায় এবং (সত্য মিথ্যার মধ্যে) চূড়ান্ত ফায়সালা করে দেয়’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৫)। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আমি একে (কুরআন) অবতীর্ণ করেছি এক বরকতময় রজনিতে, নিশ্চয় আমি সতর্ককারী’ (সুরা দুখান, আয়াত : ০৩)। মুফাসসিরিনে কেরামের ব্যাখ্যা অনুযায়ী ‘বরকতময় রজনি’ দ্বারা শবে কদর উদ্দেশ্য নেওয়া হয়েছে, যা রমজানের শেষ দশকেরই কোনো একটা রাত। এ রাতেই কুরআনুল করিমকে লাওহে মাহফুজ থেকে দুনিয়ার আকাশে অবতীর্ণ করা হয়। এরপর এখান থেকে অল্প অল্প করে প্রয়োজন অনুসারে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর অবতীর্ণ হতে থাকে। এ কথাটি আল্লাহ তায়ালা সুরা কদরে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘নিশ্চয় আমি এটা (কুরআন) শবে কদরে অবতীর্ণ করেছি।’ (সুরা কদর, আয়াত : ১)
এ মাস রহমত, মাগফিরাত (ক্ষমা) ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির মাস।
এর শুরুতে রহমত, মাঝখানে মাগফিরাত এবং শেষে রয়েছে জাহান্নাম থেকে মুক্তির প্রতিশ্রুতি। হজরত সালমান ফারসি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) একবার শাবান মাসের শেষ তারিখে ভাষণ দিলেন। তিনি বললেন, হে লোক সব! একটি মহান পুণ্যময় মাস তোমাদের ওপর ছায়াপাত করছে। এই মাসে হাজার মাসের চেয়ে উত্তম একটি রাত রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা এ মাসের রোজাকে ফরজ এবং রাতের নামাজকে নফল বানিয়েছেন। এ মাসে যে একটি নফল আদায় করল, সে যেন অন্য মাসের একটি ফরজ আদায় করল এবং যে একটি ফরজ আদায় করল, সে যেন অন্য মাসের সত্তরটি ফরজ আদায় করল। এটি ধৈর্যের মাস। ধৈর্যের বিনিময় জান্নাত। এটি সহমর্মিতা ও মুমিনের রিজিক বৃদ্ধির মাস।
যে ব্যক্তি এ মাসে একজন রোজাদারকে ইফতার করাল, সে মাগফিরাত এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করল। আর রোজাদারের পুণ্যে কোনো কমতি ছাড়াই তার সমপরিমাণ পুণ্য সে লাভ করল। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমাদের সবার তো রোজাদারকে ইফতার করানোর সামর্থ্য নেই। রাসুল (সা.) তখন বললেন, এই পুণ্য তো আল্লাহ তায়ালা ওই ব্যক্তিকে দান করবেন, যে একটি খেজুর, সামান্য একটু পানি অথবা এক ঢোক দুধমিশ্রিত পানি দিয়ে ইফতার করাল। এটি এমন মাস যার প্রথম অংশে রহমত, দ্বিতীয় অংশে মাগফিরাত (ক্ষমা) এবং শেষ অংশে রয়েছে জাহান্নাম থেকে মুক্তি। যে ব্যক্তি এ মাসে চাকর-বাকরের বোঝা হালকা করে দেবে, আল্লাহ তায়ালা তাকে ক্ষমা করবেন এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেবেন। তোমরা এ মাসে চারটি কাজ বেশি বেশি করবে। দুটি কাজ দ্বারা তোমরা স্বীয় প্রতিপালককে খুশি করতে পারবে আর দুটি কাজ ছাড়া তোমাদের গত্যন্তর নেই।
যে দুটি কাজ দ্বারা প্রতিপালককে খুশি করতে পারবে সেগুলো হলো লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর সাক্ষ্যদান ও ইস্তিগফার। আর যে দুটি কাজ ছাড়া তোমাদের গত্যন্তর নেই সেগুলো হলো আল্লাহ তায়ালার কাছে জান্নাত প্রার্থনা এবং জাহান্নাম থেকে আশ্রয় কামনা করবে।
যে ব্যক্তি রোজাদারকে পানি পান করাবে আল্লাহ তায়ালা তাকে হাউসে কাউসার থেকে এমন পানীয় পান করাবেন, জান্নাতে প্রবেশ না করা পর্যন্ত সে আর তৃষ্ণার্ত হবে না। (আত তারগিব ওয়াত তারহিব, হাদিস: ১৪৮৯)
লেখক
মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া দারুস সুন্নাহ
রাজাবাড়ী, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা