
প্রতীকী ছবি
বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ে লাগাম টানা যাচ্ছে না। প্রতি বছর এই ব্যয় বাড়ছে। গত তিন বছরে উৎপাদন ব্যয় অস্বাভাবিকহারে বেড়ে যাওয়ায় হিমশিম খাচ্ছে পিডিবি। ফলে পিডিবির লোকসানের বোঝা বাড়ার পাশাপাশি সরকারের ভর্তুকিও বাড়ছে। গত কয়েক বছরে দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েও লোকসানের বোঝা কমাতে পারেনি পিডিবি।
প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় প্রতি ইউনিট ১২ দশমিক ৩১ টাকায় উন্নীত হয়েছে, কিন্তু বাল্ক বিক্রিমূল্য ৭ দশমিক শূন্য ৪ টাকা অপরিবর্তিত থাকায় প্রতি ইউনিটে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ২৭ টাকা। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় ছিল ১১ দশমিক ৩৫ টাকা, বাল্ক বিক্রির মূল্য ছিল ৬ দশমিক ৯২ টাকা। গত অর্থবছরে ইউনিট প্রতি লোকসান ছিল ৪ দশমিক ৪৩ টাকা। চলতি অর্থবছরে চেয়ে উৎপাদন খরচ হয়েছে শূন্য দশমিক ৯৬ পয়সা বেশি। আর গত বছরের চেয়ে চলতি বছর ইউনিট প্রতি লস শূন্য দশমিক ৮৪ পয়সা বেশি হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই হিসাব বিদ্যুতের মোট (সরকারি, বেসরকারি, যৌথ হিসাব) উৎপাদনের ভিত্তিতে করা হয়েছে। শুধু বেসরকারি ও যৌথ উদ্যোগের বিদ্যুৎ উৎপাদনকে বিবেচনায় নিলে প্রতি ইউনিট ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে।
পিডিবির তথ্যানুযায়ী, গত পাঁচ অর্থবছরে বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে মাত্র ৩৫ শতাংশ। তবে এ সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় এক লাফে আড়াইগুণ হয়েছে। চলতি অর্থবছর তা আরও বাড়ছে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেশে বিদ্যুতের গড় উৎপাদন ব্যয় ছিল ২ টাকা ৫৩ পয়সা। পরের অর্থবছর তা সামান্য বেড়ে হয় ২ টাকা ৫৮ পয়সা। ২০১৮-১৯ অর্থবছর গড় উৎপাদন ব্যয় দাঁড়ায় ৬ টাকা ১ পয়সা। এরপর থেকে গড় ব্যয় দ্রুত বাড়তে শুরু করে।
মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ ও লসের যে হিসাব দেওয়া হয়েছে তাতে পিডিবি কয়েক বছরের তথ্য বিশ্লেষণে উৎপাদন খরচ ও লসের পরিমাণ বেশি দেখা গেছে।
পিডিবির পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৯-২০ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে ২ হাজার ৩৯৯ কোটি সাত লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা বা ৩৪ দশমিক ৫৬ শতাংশ। তবে এ সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ৬২ হাজার ৩৩৮ কোটি ২৬ লাখ টাকা বা ১৫৩ দশমিক ৬০ শতাংশ। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় বেড়েছে ৫ টাকা ১৭ পয়সা বা ৮৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ। পিডিবির তথ্য মতে, (২০২১-২২ অর্থবছর) দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ২২ হাজার ২২৯ মেগাওয়াট।
ওই অর্থবছর দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছিল (আমদানিসহ) ৮ হাজার ৩৯৩ কোটি ৩৩ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এ বিদ্যুৎ উৎপাদনে পিডিবির মোট ব্যয় হয়েছিল ৭২ হাজার ৯২৮ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ সে বছর বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় পড়েছিল ৮ টাকা ৬৯ পয়সা।
২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ২৪ হাজার ৯১১ মেগাওয়াট। ওই সময় দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল (আমদানিসহ) ৮ হাজার ৭০৩ কোটি ৯৬ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এ বিদ্যুৎ উৎপাদনে পিডিবির মোট ব্যয় হয়েছিল ৯৬ হাজার ৮৪ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় পড়েছিল ১১ টাকা শূন্য ৪ পয়সা।
২০২৩-২৪ অর্থবছর জুন শেষে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় ২৬ হাজার ২৬২ মেগাওয়াট। ওই সময় দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল (আমদানিসহ) ৯ হাজার ৩৪০ কোটি ২২ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এ বিদ্যুৎ উৎপাদনে পিডিবির ব্যয় হয় ১ লাখ ২ হাজার ৯২৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় পড়েছে ১১ টাকা শূন্য ২ পয়সা।
আর চলতি অর্থবছরে গড় উৎপাদন ব্যয় প্রতি ইউনিট ১২ দশমিক ৩১ টাকায় উন্নীত হয়েছে, ফলে প্রতি ইউনিটে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ২৭ টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, উৎপাদন ব্যয় হ্রাস এবং সিস্টেম লস কমানো আগামী বছরগুলোতে সরকারের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে। সিস্টেম লস কমে ১০ দশমিক ৩ শতাংশে নেমেছে। তবে সামগ্রিক সিস্টেম লস কমলেও ট্রান্সমিশন লস ২ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩ দশমিক ১ শতাংশে পৌঁছেছে। আগামী তিন অর্থবছরের মধ্যে সিস্টেম লস ১০ দশমিক ৮৩ শতাংশে দাঁড়াতে পারে, এমন পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া চাহিদানুয়ায়ী গ্যাস সরবরাহ করতে না পারায় অনেক বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র উচ্চমূল্যের জ্বালানি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে নির্ভরশীল হচ্ছে, যা বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বাড়ানোর অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া না হলে এই ব্যয় আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
জানা গেছে, আসন্ন বাজেটে ভর্তুকি কমিয়ে বরাদ্দ ৫৫ শতাংশ কমানোর প্রস্তাব করা হতে পারে। বিগত কয়েক দফা বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরও সরকার গত অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতে ৩৩ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে, যার বেশিরভাগ নেওয়া হয়েছে বন্ড থেকে। চলতি অর্থবছরে ১৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও সংশোধিত বাজেটে বিদ্যুৎ খাতে মোট ভর্তুকি বরাদ্দ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬২ হাজার কোটি টাকা।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার গত বছর আইএমএফকে জানায়, বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকির চাপ সামলাতে বছরে চারবার বিদ্যুতের মূল্য সমন্বয় করবে সরকার। এভাবে আগামী তিন বছরে মোট ১২ দফায় বিদ্যুতের দাম উৎপাদন খরচের সমান বা কাছাকাছি পর্যায়ে নিয়ে আসা হবে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর আইএমএফের চাপ সত্ত্বেও একবারও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করেনি। পাশাপাশি বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুতি কমাতে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়ে সাশ্রয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ, সরবরাহ ও অপ্রয়োজনীয় ব্যয় এবং বিদ্যুৎ সংস্থাগুলোর ব্যয় কমিয়ে ভর্তুকি কমানো হবে। এর মধ্যেই এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমাতে অপ্রয়োজনীয় ব্যয়, চুরি ও অপচয় রোধ করতে হবে। বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি কোনো সমাধান নয়।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম সময়ের আলোকে বলেন, বিদ্যুৎ খাতের দুর্নীতি, সিস্টেম লস ও অনিয়ম বন্ধে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না সরকার। এখানে (বিদ্যুৎ খাতে) প্রকৃত ব্যয় অপেক্ষা অতিরিক্ত ব্যয়; আমরা যেটাকে লুণ্ঠনমূলক ব্যয় বলছি, সেটি অনেক বেশি। বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়েও বিদ্যুৎ খাতের অনিয়ম-অপচয় রোধ করে উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনার মাধ্যমে ভর্তুকি কমানো কিংবা সমন্বয় করা সম্ভব।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ কমানোর জন্য বিদ্যুৎ খাতে অপচয়, সিস্টেম লস কমানো এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে জোর দিতে হবে।
প্রসঙ্গত বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয়ের তিনটি অংশ রয়েছে। এগুলো হলো জ্বালানি ব্যয়, স্থায়ী ব্যয়-ক্যাপাসিটি চার্জ এবং পরিবর্তনশীল (ভেরিয়েবল) ব্যয় তথা পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়। আর গড় উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে তিন শতাংশ সঞ্চালন লোকসান ও ১৫ পয়সা বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন তহবিলের অংশ যোগ করে নির্ধারণ করা হয় বিদ্যুতের গড় সরবরাহ ব্যয়। ফলে উৎপাদন ব্যয় যে হারে বাড়ে, বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যয়ও একই হারে বৃদ্ধি পায়।