ই-পেপার মঙ্গলবার ১৮ মার্চ ২০২৫
মঙ্গলবার ১৮ মার্চ ২০২৫
ই-পেপার

মঙ্গলবার ১৮ মার্চ ২০২৫

যৌন হয়রানি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ, ২০২৫, ৩:৪৫ এএম  (ভিজিট : ১১৪)
ছবি: সময়ের আলো

ছবি: সময়ের আলো

সম্প্রতি ৮ বছরের শিশু আছিয়া নিকটাত্মীয়দের দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে। মর্মান্তিক এ ঘটনায় যৌন নির্যাতন প্রতিরোধ বিষয়ে নতুন করে সচেতন সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে। আজকাল প্রায়ই গণমাধ্যমে যৌন হয়রানির খবর প্রকাশ হতে দেখা যায়। পরিবারে, রাস্তাঘাটে, গণপরিবহনে নারীরা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, বিশ্ববিদ্যালয়—কোথায়ও নারী নিরাপদ নয়। 

কখনো পরিবার বা নিকটাত্মীয়-স্বজন, কখনো বন্ধু-সহপাঠী, কখনো শিক্ষক বা সহকর্মীর দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে নারীরা। এ ব্যাপারে প্রণীত সব আইন যেন অকার্যকর হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একের পর এক যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটছে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, যৌন হয়রানির সব ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশ হয় না। সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় হয়রানির শিকার নারী নিজেই তা প্রকাশ করেন না। হাতেগোনা কিছু ঘটনা প্রকাশ হয়। দুঃখজনক বিষয় হলো প্রকাশিত সব ঘটনার যথাযথ বিচার হয় না। সেগুলো নিয়ে কয়েক দিন আলোচনা চলে। 

আবার নতুন ঘটনা ঘটলে পুরোনো ঘটনা চাপা পড়ে যায়। এ বাস্তবতা থেকেই যৌন হয়রানির শিকার অনেক নারী প্রকাশ্যে মুখ খোলেন না। যারা সাহস করে মুখ খোলেন তারাও সামাজিক অমর্যাদার শিকার হন। তার মানে বিদ্যমান সমাজব্যবস্থাও নির্যাতিত নারীর পক্ষে নয়। আছিয়ার মৃত্যুর পর প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের মুখে নির্যাতনকারীকে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। দ্রুততম সময়ে বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে যৌন হয়রানির অপসংস্কৃতি চর্চার একটি বড় ক্ষেত্র হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণের সেঞ্চুরি করার ইতিহাস আমরা জানি। 

গত বছর ময়মনসিংহের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শিক্ষার্থী শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করে প্রথমে পাত্তা পায়নি। পরে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করলে অভিযুক্তদের শাস্তির আওতায় আনা হয়। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটেছে একই ঘটনা। প্রথমে গুরুত্ব পায়নি বিষয়টি। তারপর তদন্ত ও বিচারের দাবিতে বিভাগের শিক্ষার্থীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলে এবং সব ধরনের একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দিলে অভিযুক্ত শিক্ষককে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। রাজধানীর একটি সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে দেখা গেছে, যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের তুমুল বিক্ষোভ। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এ রকম অসংখ্য যৌন হয়রানির উদাহরণ দেওয়া যাবেযেগুলো বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যৌন নির্যাতনের আখড়ায় পরিণত হতে চলেছে। এ ব্যাপারে সচেতন মহলের উদ্বেগ হলো, রাজনৈতিক বিবেচনা ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান নিয়োগ ও তাদের পকেট কমিটির দ্বারা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নৈতিক অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ছে।

নারীর প্রতি সহিংসতা ও যৌন হয়রানির নানা দিক নিয়ে নারীবাদী সংগঠনগুলো গবেষণা করে থাকে। যেসব গবেষণা থেকে জানা যায় নারীর প্রতি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের চিত্র। সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আবদুল আলীম ‘বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পুরুষতান্ত্রিক ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধের কৌশল’ শীর্ষক একটি গবেষণা পরিচালনা করেন। গবেষণায় তিনি ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ২০০ নারী শিক্ষার্থীর সাক্ষাৎকার নেন। ওই গবেষণার ফলাফল থেকে জানা যায়, ৫৬ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী তাদের সহপাঠীদের দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়। ২৪ শতাংশ সিনিয়র ও জুনিয়রদের দ্বারা, ১১ শতাংশ বহিরাগত ও ৯ শতাংশ শিক্ষকদের দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়। ওই গবেষণা থেকে আরও জানা যায়, যৌন হয়রানির ঘটনায় মাত্র ১০ শতাংশ ছাত্রী অভিযোগ করেন। ৯০ শতাংশ ছাত্রী ন্যায়বিচার না পাওয়া ও অধিক নির্যাতনের শিকার হতে পারেন ভেবে কোনো অভিযোগ করেন না। এ বিষয়ে গবেষক অধ্যাপক আবদুল আলীম বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে গবেষণাটি হলেও একই সময়ে আমি আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেছি। কথা বলে জানতে পেরেছি অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা একই রকম।


কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা আরও খারাপ। দিন দিন পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকেই যাচ্ছে। অধ্যাপক আলীমের কথায় জানা গেছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যারা যৌন হয়রানির সঙ্গে জড়িত তারা রাজনৈতিকভাবে কিংবা অন্য কোনোভাবে প্রভাবশালী। ফলে তাদের রক্ষার জন্য রাজনৈতিক দলের কিংবা প্রভাবশালী মহলের চাপ থাকে। এতে করে অনেক ঘটনাই ধামাচাপা পড়ে যায়। অনেক ঘটনার বিচার হয় না। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যদি মেয়েরা যৌন হয়রানির শিকার হয়ে মুখ খুলতে না পারে তা হলে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের চিত্র আরও ভয়াবহ হওয়াই স্বাভাবিক। তা হলে কোন দিকে যাচ্ছে সমাজ? নারীর ক্ষমতায়ন কি নারীকে নিরাপত্তা দিতে পারছে না? নাকি পুরুষতন্ত্রের নৈতিক অবক্ষয় এতটাই তলানিতে নেমে গেছে যে, সেখানে নীতি-আদর্শের কোনো আলোই নেই।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শুধু ডিগ্রি বা সার্টিফিকেট দেবে না, শিক্ষার্থীর আদর্শিক ও মানবিক মূল্যবোধেরও বিকাশ ঘটাবেÑএটি সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সে আদর্শিক অবস্থানে দেখা যাচ্ছে না। নীতি-আদর্শ, মূল্যবোধ ও সৃজনশীলতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যে যেভাবে পারে যৌনতার সহিংসতার মরিয়া হয়ে উঠছে। সবচেয়ে লজ্জার বিষয় হলো, যিনি শিক্ষক তিনি নিজেও তার ছাত্রীর প্রতি যৌন হয়রানিমূলক আচরণ করছেন। একজন শিক্ষক যখন যৌন হয়রানিমূলক আচরণ করেন তখন তিনি আর শিক্ষক থাকেন না। তখন তিনি যৌন নিপীড়ক এক ঘৃণ্য অপরাধীতে পরিণত হন। ফলে তার শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি হয়ে পড়ে। কিন্তু বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় যৌন হয়রানির শিকার নারীরাই নানাভাবে শাস্তি পেয়ে যায়। যৌন হয়রানির শিকার নারীর গায়ে চরিত্রহীনতার তকমা লাগিয়ে দেওয়া হয়। তখন ওই নারী শুধু শারীরিক নির্যাতন নয়; সামাজিক ও মানসিক নির্যাতনও ভোগ করেন। যারা সাহসী তারা প্রতিবাদ করে। বাকিরা নীরবে সয়ে যায় কিংবা আত্মহননের পথ বেছে নেয়। আত্মহত্যার পর অনেক শিক্ষার্থীর সুইসাইড নোট থেকে জানা যায়, সে দিনের পর দিন যৌন হয়রানি ও মানসিক নির্যাতন শিকার হচ্ছিল।

বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি বিষয়ে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ ২০২১ সালে ‘চ্যালেঞ্জিং ফিয়ার অব ভায়োলেন্স’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, জনসমাগমের মধ্যে ৮১ ভাগ নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহপাঠী ও শিক্ষকদের দ্বারা শারীরিক ও নানা ধরনের মানসিক নির্যাতনের শিকার হয় ৭৪ শতাংশ নারী। ভয়াবহ এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজে বের করা জরুরি। বিদ্যমান আইনগত ব্যবস্থা কার্যকর করা এবং যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। এ ব্যাপারে জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি বাদী হয়ে ২০০৮ সালের ৭ আগস্ট একটি জনস্বার্থমূলক মামলা করেছিল। 

মামলার বিষয় ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ। মামলার শুনানি শেষে ২০০৯ সালের ১৪ মে মহামান্য হাইকোর্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধসহ নারীর সার্বিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিতকরণ এবং নারী-পুরুষ সমতা প্রতিষ্ঠায় একটি যুগান্তকারী রায় দেন। হাইকোর্টের সে রায়ের পর সময় পেরিয়ে গেছে দেড় দশক। কোর্টের নির্দেশনা মোতাবেক মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর ২০১৯ সালের ২৭ মে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠনের নির্দেশ প্রদান করেছিল। আইনগত এসব পদক্ষেপ সত্ত্বেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি বেড়েই চলেছে। বিষয়টি একদিকে নারীর প্রতি সহিংসতা বা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন অন্যদিকে চরম সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের চিত্র।

সে কারণে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে আইনের যথাযথ প্রয়োগ যেমন জরুরি তেমনি মনোজাগতিক পরিবর্তন জরুরি। মানসিক পরিবর্তনের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের কাউন্সেলিং করতে হবে। শিক্ষক নিয়োগ ও ছাত্র ভর্তির ব্যাপারে আরও সতর্ক হতে হবে। শিক্ষক নিয়োগ ও শিক্ষার্থীদের ভর্তি পরবর্তী সময়ে এমন কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে যাতে তাদের এ বিষয়ে সচেতন করে তোলা যায়। আর একটি বিষয় হলো যৌন হয়রানিমূলক প্রতিটি ঘটনার বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। জাতি গঠনের প্রধান ক্ষেত্র হিসেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যদি নৈতিক, মানবিক ও নিজ নিজ ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে ওঠে তা হলে সমাজেও তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। সুশিক্ষার মাধ্যমে নতুন মানবিক সমাজ গঠিত হলে আছিয়ার মতো আর কোনো শিশু এমন পাশবিক যৌন নির্যাতনের শিকার হবে না।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, শহিদ জিয়া মহিলা কলেজ, ভূঞাপুর, টাঙ্গাইল




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ। নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।
ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close