প্রকাশ: মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ, ২০২৫, ৩:২৪ এএম (ভিজিট : ১১০)

ছবি: সময়ের আলো
ফুটপাথ। পায়ে চলার পথ। রাস্তায় গাড়ি চলে। ফুটপাথে চলে মানুষ। মানুষের চলাফেরার যেন কোনো সমস্যা না হয়, তাই সড়ক থেকে সামান্য উঁচুতে থাকে ফুটপাথ। ঢাকা শহরে অসংখ্য ফুটপাথ আছে। তবে চোখে দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই যে রাস্তার পাশ ঘেঁষে ফুটপাথ আছে। এর মূল কারণ অধিকাংশ ফুটপাথই হকারদের দখলে। ফুটপাথ দখল করে তারা চায়ের টং, পানের দোকান, শিঙাড়া-পুরির দোকান, জামা-কাপড়ের দোকান, বইয়ের দোকান, ফ্ল্যাক্সি লোডের দোকান, সবজির দোকানসহ হাজারো দোকান বসিয়েছে। ঈদ উপলক্ষে বসেছে নতুন নতুন শত শত জামা-কাপড়ের দোকান। ফলে পথচারীরা হয়ে পড়েছে অপাঙক্তেয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় ফুটপাথ যেন হকারদের পৈতৃক স্থান। পথচারীরা তাদের করুণার পাত্র। তারা কোথা দিয়ে হাঁটবে, রিকশা কিংবা বাসের সঙ্গে ধাক্কা খাবে কি না তা তাদের ব্যাপার।
দোকানিরা ফুটপাথগুলো এমনভাবে দখল করে আছে যে একজন মানুষ হাঁটলে আরেকজন পাস হতে পারে না। প্রশ্ন হচ্ছে মানুষ যাবে কোথায়? তারা কি ফুটপাথে হাঁটবে না? তাদের পায়ে চলার পথ না থাকলে তারা কি চলাফেরা করবে না? জীবন চালাবে না? হকারের কাছে কি তারা সারা জীবনই জিম্মি হয়ে থাকবে? নিশ্চয়ই না। সাধারণ জনগণের কথা চিন্তা করেই ঈদ এলে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন অভিযান শুরু করেন ঢাকা শহরের ফুটপাথ হকারদের দখলমুক্ত করার। এবার মেয়র সাহেবরা পলাতক। তা হলে ফুটপাথ দখলমুক্ত করার অভিযানের কী হবে?
ফুটপাথ দখলমুক্ত করার অভিযানের শুরুতেই আসে নানা বাধা। হকাররা একজোট হয়ে শুরু করে দৌড়ঝাঁপ-আন্দোলন-সংগ্রাম। দুই নগরপতিই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকেন ফুটপাথ অভিযানে। এবার নগরপতিরা নেই। কারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হবেন ফুটপাথ দখলমুক্ত করার?
ঈদকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েক দিনের অভিযানে ঢাকা শহরের অনেক এলাকার ফুটপাথই হকারমুক্ত হয়। কয়েক দিন থাকে হকারমুক্ত। মানুষ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে শুরু করে। রাস্তায় চলাফেরা করা মানুষের চেহেরায় ফুটেওঠে আনন্দ আনন্দ ভাব। তারা যেন মুক্তস্বাধীন রাস্তায় চলছেন। স্বাধীন রাস্তায় স্বাধীনভাবে, নির্বিঘ্নে চলার আনন্দটাই অন্যরকম। কিন্তু সে আনন্দ সাধারণ মানুষের কপালে সইল না। কিছুদিন পরই আবার যেই লাউ সেই কুদু।
ফাঁকা মাঠে আস্তে আস্তে ফুটপাথে অবস্থান নিতে থাকে নানা রকম দোকানি। ছোট-বড়-মাঝারি আকারের দোকান দখল করতে থাকে মানুষের পায়ে চলার পথ। সাধারণ মানুষ এতটুকু প্রতিবাদ করতে পারে না। প্রতিবাদ করলেই মান-সম্মান নিয়ে টানাটানি শুরু হয়। দোকানিরা সব তেড়ে আসে। যেন তাদের বাপদাদার সম্পদে সাধারণ মানুষ ভাগ বসাচ্ছে এমন একটা ভাব। ক্ষেত্রবিশেষে বেশ কয়েকজন ফুটপাথ দখলকারী একসঙ্গে প্রতিবাদকারীর দিকে তেড়ে যায়। বাধ্য হয়ে সাধারণ পথচারীরা কোনো প্রতিবাদ কওে না। তারা লোহা খেয়ে হজম করে। মাথা নিচু করে এঁকে বেঁকে কোনোরকম নিজেকে বাঁচিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাসায় ফিরে।
ফুটপাথে হাঁটা মানে যুদ্ধক্ষেত্রে হাঁটা। এমন অভিজ্ঞতা ঢাকা শহরের অধিকাংশ পথচারীর। যুদ্ধ করার জন্য যেমন নানা কৌশল শিখতে হয়, জানতে হয় তেমনি ফুটপাথে হাঁটার জন্য বিশেষ একধরনের কৌশল। নতুন করে হাঁটা শিখতে হয়। ফুটপাথের দোকান, দোকানদার, ক্রেতা, চা পানে মগ্ন মানুষজন সবকিছুকে অতিক্রম করে সাপের মতো এঁকে বেঁকে হাঁটা আসলেই দুরূহ। আর এ দুরূহ কাজটিই প্রতিদিন প্রতিনিয়ত করতে হয় ঢাকাবাসীদের। কর্তৃপক্ষ মাঝেমধ্যে ক্ষিপ্ত হয়, আবার থেমে যায়। এভাবে ফুটপাথ দখলকারী ও কর্তৃপক্ষের মধ্যে চলে লুকোচুরি খেলা। এই খেলার কঠিন শিকার সাধারণ মানুষ। সেদিন সকালে এক বাবা তার ছেলেকে নিয়ে স্কুলে যাচ্ছেন। স্কুলব্যাগটি তার কাঁধে। ব্যাগটি বেশ ভারী। ব্যাগ কাঁধে তিনি একটু বাঁকা হয়ে হাঁটছেন। সময় কম বলে একটু দ্রুত হাঁটতে হচ্ছে। স্কয়ার হাসপাতাল পাড় হয়ে ৩২ নম্বরের দিকে যাচ্ছেন। ফুটপাথে বেশ কটি চা বিস্কুট সিগারেটের দোকান। একটি শিঙাড়া-পুরির দোকানও আছে। সকাল বেলা তাই সবাই শিঙাড়া-পুরি খেয়ে নাশতা সারছে।
তারা সবাই এমনভাবে রাস্তা দখল করে শিঙাড়া-পুরি-চা খাচ্ছে যে একজন মানুষ অতিক্রম করার জায়গা নেই। ছেলে নিয়ে স্কুলে যাওয়া লোকটি অতি সাবধানে ধীরগতিতে এঁকে বেঁকে পাড় হচ্ছে। একজন মানুষের গায়ে স্কুলব্যাগটা লাগতেই তিনি সবরকম ভদ্রতা ভুলে চিৎকার শুরু করেন। বারবার বলেই চললেন, দেখে হাঁটতে পারেন না। তিনি বললেন দুঃখিত। বলে যেই পা বাড়িয়েছেন সেই পেছন থেকে একটা থাপ্পড়ের শব্দ। তাকাতেই দেখেন একজন পথচারী একজন ফুটপাথের দোকানদারকে মারছে। সময় স্বল্পতার কারণে মারার কারণটি জানতে পারেননি। ছেলেকে স্কুলে দিয়ে বাসায় ফেরার পথে জানলেন ভদ্রলোক ধবধবে সাদা জামা পরে অফিসে যাচ্ছিলেন। ফুটপাথের চা বিক্রেতা একজন ক্রেতাকে চায়ের কাপ দিতে গিয়ে পুরো চা ফেলে দেয় অফিসগামী ভদ্রলোকটির গায়ে। বেচারার জামাকাপড় এতটাই নষ্ট হয়েছে যে তাকে বাসায় গিয়ে তা পরিবর্তন করে আসতে হবে। এদিকে তার হাতে সময়ও কম। তিনি দোকানদারকে শুধু বললেন, এমন একটা কাজ করলে, একটু দুঃখ প্রকাশ কর। ফুটপাথের চা বিক্রেতা দুঃখ প্রকাশ না করে ভদ্রলোককে গালমন্দ করল। ভদ্রলোক ওখানকার স্থানীয়। কোনো কথা না বলে শুরু করলেন-চড়থাপ্পড়। পরে নাকি ঘটনাটা আরও অনেকদূর গড়িয়েছে, যার কারণে ওই ভদ্রলোককে সেদিন তিন চার ঘণ্টা দেরি করে অফিসে যেতে হয়েছে।
অফিসগামী এ লোকটির সকাল বেলার এই বিড়ম্বনার দায়ভার কে নেবে? সিটি করপোরেশন, অন্যকোনো কর্তৃপক্ষ, নাকি ফুটপাথের চা দোকানদার? কাকেইবা করা হবে এই প্রশ্ন? সবাই যে আজকাল সবরকম প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। শুধু সাধারণ মানুষ সবার নিচে (!) হয়তো একেই বলে নিয়তি। একেই বলে অরাজকতা। একেই বলে জোর যার মুল্লুক তার।
তা না হলে অবৈধ দখলদার একজন ফুটপাথের চা দোকানদার কীভাবে একজন পথচারীকে হেনস্থা করে? ঘটনাটির আরও গভীরে ঢুকে জানা গেল ফুটপাথের এই দোকানদার প্রতিদিন সন্ধ্যায় বেশ কয়েকজনকে টাকা প্রদান করে। বিনিময়ে ফুটপাথে দোকান চালানোর নিশ্চিয়তা পায়। হয়তো সে কারণেই অপরাধী হয়েও তার গলা এত উঁচুতে। মানুষের চলাচলে সমস্যা সৃষ্টি করেও সে বড় বড় কথা বলে। গলা উঁচিয়ে চিৎকার করে। পথচারীকে ধমক দেয়। তার সেই বোধ-বুদ্ধি থাকলে হয়তো টাকার বিনিময়ে ফুটপাথে দোকানদারি করে সাধারণ মানুষের চলাচলে বাধা সৃষ্টি করত না। সে ভাবে শুধু নিজের কথা। তার কারণে দশজন মানুষের চলাচলে সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে তাতে তার কিচ্ছু যাচ্ছে আসছে না। সে অনেকটা বনের অত্যাচারী পশুর মতোই। পার্থক্য একটাই, বনের পশুটির আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা অন্য একটি পশু আর তার আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা একজন কি দুজন মানুষ। যাক সে কথা। কর্তৃপক্ষের ওয়াদা থাকে ফুটপাথ দখলমুক্ত করে সাধারণ মানুষের চলাচল নির্বিঘ্ন করা। তারা সময় সময় তা রক্ষা করতে পারছেন। সময় সময় ব্যর্থ হচ্ছেন।
জানা যায়, ফুটপাথকে কেন্দ্র করে একটা বড় সিন্ডিকেট আছে। এই সিন্ডিকেটই নাকি নিয়ন্ত্রণ করে সারা ঢাকা শহরের ফুটপাথ। এতে তাদের মুনাফার পরিমাণও নিতান্ত কম নয়। টাকার অঙ্কে হিসাব করলে নাকি হাজার কোটি টাকা। এত টাকার লোভ কজনইবা সামলাতে পারে? হয়তো সে কারণেই সাধারণ মানুষের দিকে নজর দেওয়ার মতো সময় কিংবা প্রয়োজনীয়তা কোনোটাই নেই সিন্ডিকেটের। তাই ফুটপাথ দখল-বেদখল নিয়ে সারা বছর ধরে চলে ইঁদুর-বিড়াল খেলা। তা না হলে সাধারণ মানুষ তাদের ন্যূনতম নাগরিক অধিকারটুকু ভোগ করে নির্বিঘ্নে চলাফেরা করতে পারছে না জেনেও কেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নীবর?
রাজধানী ঢাকার পুরোনো বিমানবন্দর পাড় হলেই ঢাকা সেনানিবাস এলাকা। ওই এলাকার ফুটপাথ এতটাই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আর মানুষ চলাচলের উপযোগী যে হাঁটলে মনে হয় উন্নত বিশ্বের কোনো ভিআইপি এলাকার ফুটপাথে হাঁটছি। অথচ আধা কিলোমিটার ব্যবধানে কী বেহাল দশা!
নগর কর্তৃপক্ষ এর কী উত্তর দেবে! সত্যিই কি তারা ফুটপাথ দখলমুক্ত করে সাধারণ মানুষের পথচলা নির্বিঘ্ন করতে পারবেন? নাকি তারাও পূর্বের কর্তৃপক্ষের মতো ফুটপাথ দখলকারীদের কাছে নতিস্বীকার করবেন? দেখা যাক কী হয়!
লেখক: প্রাবন্ধিক