
তারাবি নামাজ আদায় করছেন মুসল্লিরা। ছবি: সময়ের আলো
আজকের তারাবিতে পবিত্র কোরআনের ২০তম পারা তেলাওয়াত করা হবে। সুরা নামলের ৬০ থেকে সুরা কাসাস ও সুরা আনকাবুতের ১ থেকে ৪৪ নম্বর আয়াত পর্যন্ত। মৃত্যু-পরবর্তী জীবন, রিজিক, দুই নদীর মাঝখানে পার্থক্যরেখা, আল্লাহর কুদরত, আসমান-জমিন সৃষ্টি, আল্লাহর ক্ষমতা, ঈমানদারের পরীক্ষা, মুসা (আ.) ও ফেরাউনের কাহিনি, কারুনের ঘটনা, মুসলমানদের দুঃখ-কষ্ট, সত্য-মিথ্যার পার্থক্য, কোরআন আঁকড়ে ধরা, হেদায়েত আল্লাহর হাতে, সবুজ-শ্যামল বাগান সৃষ্টি, মিঠা পানি ও লবণাক্ত পানির দরিয়া ইত্যাদি বিষয়ের বিবরণ রয়েছে।
দুই নদীর পানি একসঙ্গে মিশে না
আল্লাহ তাআলা পানি থেকে সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। ভূপৃষ্ঠের তিন ভাগের দুই ভাগই সাগরের পানিতে ঢাকা। এখানে আছে সাগর-মহাসাগর, নদী-নালা ও খাল-বিল। এক সাগরের সঙ্গে লেগে আছে আরেক সাগর, নদীর সঙ্গে নদী। কিন্তু দুই সাগরের পানি একসঙ্গে মিশে না। নদী ও সাগরের মিষ্টি ও লবণাক্ত পানি একত্রে মিশ্রণ হয় না। এটা আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন। আল্লাহ বলেন, ‘তিনি সেই সত্তা, যিনি দুই সাগরের মাঝে অন্তরায় সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা নামল, আয়াত : ৬১) পৃথিবীর বেশ কয়েকটি জায়গায় পাশাপাশি প্রবাহিত সমুদ্র বা নদীর পানির মধ্যে স্পষ্ট ব্যবধান খুঁজে পাওয়া যায়। পাশাপাশি প্রবাহিত হলেও দুই সমুদ্রের পানির রঙ ও গঠন আলাদা এবং একটি অন্যটির সঙ্গে মিশছে না। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘তিনিই সমান্তরালে দুই সমুদ্র প্রবাহিত করেছেন, একটি সুমিষ্ট, তৃষ্ণা নিবারক ও আরেকটি লোনা, বিস্বাদ; উভয়ের মাঝখানে রেখেছেন একটি অন্তরায়, একটি দুর্ভেদ্য আড়াল।’ (সুরা ফুরকান, আয়াত : ৫৩)
ভালো কাজের প্রতিদান
আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যে ব্যক্তি কাজ করে, মানুষের কল্যাণে কাজ করে, মানুষের পাশে দাঁড়ায়, তার জন্য আল্লাহর কাছে উচ্চ মর্যাদা ও সম্মান রয়েছে। আল্লাহ তাকে মহব্বত, নৈকট্য ও অনুগ্রহের দ্বারা সম্মানিত করবেন। তার আকাঙ্ক্ষার চেয়ে উত্তম প্রতিদান দেবেন। তার অস্থিরতা দূর করবেন। বর্তমানে মানুষ নানা অস্থিরতার মধ্য দিয়ে সময় পার করছে, এক বাঁধনহীন উড়াল জীবন বয়ে বেড়াচ্ছে প্রায় মানুষ; কোথাও যেন শান্তি নেই, মানুষের এই অস্থিরতা কাটাতে পারে তাদের ভালো কাজ। ভালো কাজ ভয়াবহ সেই কিয়ামতের দিনেও মানুষের জন্য আলো হয়ে দাঁড়াবে। আল্লাহ বলেন, ‘যে কেউ সৎকর্ম নিয়ে আসবে, সে উৎকৃষ্টতর প্রতিদান পাবে এবং সেদিন তারা গুরুতর অস্থিরতা থেকে নিরাপদ থাকবে।’ (সুরা নামল, আয়াত : ৮৯)
ঘটনায় গাঁথা সুরা কাসাস
সুরা কাসাস মক্কায় অবতীর্ণ। এ সুরার আয়াত সংখ্যা ৮৮। কোরআনের ২৮ তম সুরা এটি। কাসাস অর্থ ধারাবাহিকভাবে ঘটনার বর্ণনা। এ সুরায় বিস্তারিতভাবে মুসা (আ.)-এর ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, তাই এটিকে সুরা কাসাস বলা হয়।
শত্রুর ঘরে যেভাবে বেড়ে উঠেন মুসা (আ.)
দ্বিতীয় রামেসিস বা ফেরাউন স্বপ্নের ব্যাখ্যায় জানতে পারলেন, বনি ইসরায়েলের এক পুত্রসন্তান তাকে হত্যা করবে। ফেরাউন বনি ইসরায়েলের সব পুত্রসন্তানকে হত্যার নির্দেশ দেন। বনি ইসরায়েল ভেঙে পড়লেন এই নির্দেশ শুনে। এদিকে মুসা (আ.)-এর মা তাঁকে প্রসব করলেন। মুসার মা চিন্তায় পড়ে গেলেন। আল্লাহ মায়ের অন্তরে মুসাকে রক্ষার যাবতীয় কৌশল ঢেলে দিলেন। মা সিন্দুক বানালেন। একদিন শিশু মুসাকে সিন্দুকে বসিয়ে দরিয়ায় ভাসিয়ে দিলেন। মুসার বোন চললেন সিন্দুকের গতির পথ ধরে। সেই সিন্দুক ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে গেল ফেরাউনের ঘাটে। শিশু মুসা গেল ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়ার কোলে। ফেরাউন দেখে তাকে হত্যা করতে উদ্যত হলো। আসিয়া দাঁড়ালেন বাধা হয়ে।
এবার তবে ক্ষুধার্ত শিশু মুসাকে দুধ খাওয়াতে হয়। দুগ্ধবতী কয়েকজন নারী চেষ্টা করলেন। কাজ হলো না। মুসার বোন সব ঘটনা কাছ থেকে দেখছিলেন। তিনি আসিয়াকে বনি ইসরায়েলের এক নারীর খবর দেন, যার দুধ এই বাচ্চা পান করতে পারে। ডাকা হয় সেই নারীকে। সেই নারী মুসার মা। (তাফসিরে রুহুল মায়ানি, খণ্ড: ২০, পৃষ্ঠা: ৩-৫) শত্রুর ঘরে মায়ের আদরে মুসা বড় হতে থাকেন। যৌবনে পদার্পণ করেন। ঘটনাচক্রে মুসার হাতে এক কিবতির হত্যা হয়। ফেরাউন মুসাকে হত্যার নির্দেশ দিলে এক ব্যক্তির পরামর্শে শহর ছেড়ে মাদায়েনে চলে যান তিনি। মুসা (আ.)-এর জীবনের এসব ঘটনার বিবরণ রয়েছে সুরা কাসাসের ৩ থেকে ৫০ নম্বর আয়াতে।
কারুনের ধ্বংস হওয়ার কাহিনি
সুরা কাসাসের ৭৬ থেকে ৮২ নম্বর আয়াতে সম্পদশালী কারুনের দম্ভ, অবাধ্যতা ও ধ্বংসের কাহিনির বর্ণনা রয়েছে। মুসা (আ.)-এর সময়ের এক অহংকারী ও দুষ্ট লোক কারুন। সে ছিল অঢেল সম্পত্তি। বাইবেল ও তালমুদে কারুনের নাম পাওয়া যায় কোরহ। আবদুল্লাহ ইবন আব্বাসের (রা.) মতে, ‘কারুন ছিল মুসা (আ.)-এর চাচাতো ভাই। মুসা (আ.) বনি ইসরাইলের এক অঞ্চলের নেতৃত্ব দিতেন এবং কারুন নেতৃত্ব দিত অন্য অঞ্চলের।’
কারুনের ধনভান্ডারের চাবিগুলো বহন করত একদল শক্তিশালী বাহিনী। তাদের পক্ষে ব্যাপারটি ছিল কষ্টসাধ্য। সম্পদের প্রাচুর্য তাকে ধোঁকায় ফেলে দিয়েছিল। সে অহংকার করত। কাউকে দান করত না। আল্লাহকে ভয় করত না। মুসা (আ.) তাকে বোঝালেন। আল্লাহর ভয় দেখালেন।
কারুন মুসা (আ.)-এর কথা শুনল না। সে অহংকার দেখিয়ে চলল। অবশেষে আল্লাহ তাআলা কারুনকে তার বাড়িঘরসহ জমিনে ধসিয়ে দেন। মিসরের ফায়ুম শহরে ‘কারুন হ্রদ’ নামে একটি জায়গা রয়েছে। রাজধানী কায়রো থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এখন লোকে চেনে ‘বিরকেত কারুন’ নামে।
যা আছে সুরা আনকাবুতে
মক্কায় অবতীর্ণ সুরা আনকাবুত কোরআনের ২৯তম সুরা। এতে আয়াত আছে ৬৯টি। এ সুরার আজকের অংশে অংশে অত্যাচার ও বিপদের মধ্যে পড়া, বিশ্বাসী-অবিশ্বাসীদের মধ্যে পার্থক্য, নুহ (আ.), ইবরাহিম (আ.), লুত (আ.), শুআইব (আ.)-এর কষ্ট ও ত্যাগ, আদ ও সামুদ জাতি, কারুন, ফেরাউন ও হামানদের ধ্বংসের কাহিনি, তাওহিদ, রিসালাত, আখেরাত, মক্কার জীবনে মুসলমানদের কষ্ট এবং সত্যবাদীর জন্য আল্লাহর পরীক্ষার বর্ণনা রয়েছে।
কারা মাকড়সার মতো
নবী-রাসুলগণ একত্ববাদের দাওয়াত দিতে গিয়ে কষ্ট করেছেন। জীবন দিয়েছেন। এদিকে পৃথিবীর শক্তিশালী জাতি ও ব্যক্তি—যারা আল্লাহর অবাধ্যতা করেছে, কেউই বাঁচতে পারেনি। আল্লাহর আজাব থেকে তাদের কেউ রক্ষা করতে পারেনি। এমনকি তাদের কথিত প্রভুরাও। আল্লাহ বলেন, ‘যারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যদের অভিভাবকরূপে গ্রহণ করেছে, তাদের দৃষ্টান্ত হলো মাকড়সার মতো। সে ঘর বানায়, আর ঘরের মধ্যে মাকড়সার ঘরই সবচেয়ে দুর্বল; যদি তারা জানত।’ (সুরা আনকাবুত, আয়াত : ৪১)
লেখক: আলেম ও সাংবাদিক