ই-পেপার রবিবার ১৬ মার্চ ২০২৫
রবিবার ১৬ মার্চ ২০২৫
ই-পেপার

রবিবার ১৬ মার্চ ২০২৫

মীর মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে আলাপচারিতা
কী বলতে চেয়েছিল মুগ্ধ
প্রকাশ: রবিবার, ১৬ মার্চ, ২০২৫, ৭:৩৮ পিএম  (ভিজিট : ৫২)
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

‘পানি লাগবে, পানি?’ গণঅভ্যুত্থানের দিনগুলোতে মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধের মুখে উচ্চারিত এই শব্দগুলো আরও শানিত বিদ্রোহের বারতা নিয়ে হাজির হয়। বাবা মীর মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, গুলিবিদ্ধ হওয়ার আগের দিন যখন মুগ্ধর সঙ্গে শেষ দেখা হয়, তখন কী যেন বলতে চেয়েছিল মুগ্ধ।

বাবা জানান, ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি ফুটবল খেলোয়াড়, গায়ক ও দক্ষ সংগঠক হিসেবে বেশ সুনাম ছিল তার। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই ছিল স্কাউট গ্রুপের ইউনিট লিডার। সারা দেশের স্কাউট গ্রুপের সদস্য ছিল। বননীর অগ্নিকাণ্ডে বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছিল। আর  শ্রেষ্ঠ সংগঠক হিসেবে বাংলাদেশ স্কাউটস থেকে ‘ন্যাশনাল সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছিল। ফলে ছোটবেলা থেকেই মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা এবং সামাজিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিল।

বাবার ভাষ্য অনুযায়ী, এ আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকেই মানুষকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে আসছিল। তারই ধারাবাহিকতায় গত ১৮ জুলাই রাজধানীর উত্তরা আজমপুর এলাকায় মুগ্ধ ক্লান্ত শিক্ষার্থীদের মাঝে পানি ও বিস্কুট বিতরণ করছিল। স্নিগ্ধ-মুগ্ধ যমজ দুই ভাই সেই ছোটবেলা থেকেই সবসময় মানুষের কষ্টে পাশে থাকার চেষ্টা করত। পরিবার থেকেও তাদের এ কাজকে সবসময় সাপোর্ট দেওয়া হতো। তার বাবা বলেন, ‘তেমনিভাবে এই আন্দোলনেও আমরা তাদের সমর্থন দিয়েছিলাম। আমাদের পারিবারিক আলোচনায় আমার ও তার মায়ের সঙ্গে আন্দোলনের যৌক্তিকতা নিয়েও কথা বলেছেন।’

মুগ্ধ উত্তরার একটি স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে। পরে এইচএসসি পাস করে ২০২৩ সালে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতে স্নাতক শেষ করেন। ঢাকায় ফিরে মার্চ মাসে ভর্তি হয়েছিলেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে (বিইউপি)। প্রফেশনাল এমবিএ করছিলেন। পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিং করতেন তিনি। তাতে আয়ও বেশ হতো। অনেক স্বপ্ন ছিল তার কিন্তু সেই স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে উত্তরার আজমপুরে সংঘর্ষের মধ্যে ১৮ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় মুগ্ধ। 

মুগ্ধের মৃত্যুর খবর কখন শুনলেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তার বাবা বলেন, ১৭ জুলাই পরিবারের অন্য সদস্যরা কক্সবাজারে গিয়েছিলাম আমি তার মা ও মুগ্ধের বড় ভাই মাহমুদুর রহমান। তখন মুগ্ধকে আমাদের গাড়িতে তুলে দেয়। সেটাই ছিল আমাদের শেষ দেখা ছিল। গাড়িতে তুলে দিয়ে ফিরে আসার সময় বারবার আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। মনে হয় কিছু একটা বলতে চেয়েছিল। কিন্তু পরে আর বলেনি। আমি তেমন কিছু বলিনি। সেই তাকিয়ে থাকার দৃশ্যটা এখন খুব মনে পড়ে। 

মুগ্ধর বাবা বলেন, আমরা কক্সবাজারের যাওয়ার সময় বড় ছেলে মোবাইল নিয়ে যায়। কারণ আন্দোলন চলছে কী জানি হয়। তাই কোনো কিছুর খবর পায়নি। পরে স্নিগ্ধ ১৮ জুলাই সন্ধ্যায় মুগ্ধ গুলিবিদ্ধ হয়েছে এ খবর আমাকে জানানো হয়। মারা গেছে এটা জানানো হয়নি। পরদিন সকালে আমরা বিমানে করে কক্সবাজার থেকে ফিরে আসি। পরে তার উত্তরা এলাকায় জানাজা হয়। সেখানে আমি দেখি ছেলের নিথর দেহ পড়ে আছে। হাজারো মানুষ ছিল তার জানাজায়। অনেক কষ্ট করে মরদেহ দাফনের ব্যবস্থা করি। আমরা চেয়েছিলাম গ্রামের বাড়ি  ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে কবর দিই। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন হুমকি দেওয়া হয়েছিল। উত্তরার চার নম্বর সেক্টর এবং বাসার পাশে অনেক জায়গায় চেষ্টা করি কিন্তু মরদেহ দাফন করতে সম্ভব হচ্ছিল না। পরে আমাদের এক আত্মীয় সেনা অফিসারের সহায়তায় ১০ নম্বর সেক্টরে মুগ্ধকে দাফন করা হয়। 

মুগ্ধের বিভিন্ন স্মৃতিচারণ করে মীর মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মৃত্যুর সময় সে লেমিনেটিং করা বিইউপির আইডি কার্ড (পরিচয়পত্র) গলায় ঝুলিয়ে রেখেছিল। গুলি লাগার পর আইডি কার্ডের ভেতরে রক্ত ঢুকেছিল। আমরা সেই রক্তমাখা কার্ডটি সেভাবেই রেখে দিয়েছি। তার পড়ার টেবিল, চেয়ারও সেভাবেই পড়ে আছে। মুগ্ধর অনুপস্থিতিতে তার যমজ বড় ভাই মীর মাহবুবুর রহমান (স্নিগ্ধ) একা হয়ে গেছে। কারণ দুই ভাই জন্মের পর ২৫ বছর ৯ মাস ১৪তম দিনও একসঙ্গে কাটিয়েছেন। যমজদের মধ্যে আলাদা একটা কানেকশন থাকে। তাই একজন কষ্ট পেলে অন্যজনও কষ্ট পেত। জন্মের হিসাবে বয়সে স্নিগ্ধ বড়। মুগ্ধর ডান চোখের নিচে একটি কালো তিল আর স্নিগ্ধের একটু স্বাস্থ্য ভালো- এ দুটি ছাড়া তাদের আলাদা করা কঠিন ছিল। বাসায় পড়াতে আসা শিক্ষককেও বিভিন্ন সময় ফাঁকি দিয়েছে তারা। পাসপোর্ট করাতে গেলেও ঝামেলা হয়েছে একই ব্যক্তির দুই নাম কি না, তা নিয়ে। পরে পাসপোর্টের বড় কর্মকর্তার সামনে দুজনকে হাজিরা দিতে হয়েছে। দুই ভাই সবসময় একসঙ্গেই বিভিন্ন জায়গায় যেত, আড্ডা দিত।

সন্তান হত্যার বিচার প্রসঙ্গে মীর মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘মুগ্ধ আন্দোলনকারীদের কষ্ট সহ্য করতে পারছিল না। সে সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে আন্দোলনে গিয়েছিল। কোটা আন্দোলন নিয়ে আমার অভিমত কী, তা জানতে চেয়ে সে কৌশলে আমার আর তার মায়ের কাছ থেকে সেখানে যাওয়ার অনুমতি নিয়েছিল। নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকে সে আন্দোলনে গিয়েছিল। যদিও মুগ্ধ কোনো রাজনীতি করত না তবে আমি কিন্তু বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে দীর্ঘদিন যুক্ত ছিলাম। ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে বিএনপির  বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলাম। কিন্তু এখন আর সম্পৃক্ত নই। দেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতার জন্য মুগ্ধ শহিদ হয়েছে। তার অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। দেশের মানুষের কাছে সে অমর হয়ে থাকবে। তবে আমি শুধু মুগ্ধ নয়, ২৪-এর আন্দোলনে নিহতদের প্রত্যেকের হত্যার বিচার চাই। একই সঙ্গে বিচারে যেকোনো নিরপরাধ ব্যক্তি যাতে শাস্তি না পায় এটাই প্রত্যাশা করি।’




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ। নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।
ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close