ই-পেপার রবিবার ১৬ মার্চ ২০২৫
রবিবার ১৬ মার্চ ২০২৫
ই-পেপার

রবিবার ১৬ মার্চ ২০২৫

ফ্যাসিজম অভ্যুত্থান সংস্কার
রাষ্ট্র-রাজনীতির গণতান্ত্রিক রূপান্তর
প্রকাশ: রবিবার, ১৬ মার্চ, ২০২৫, ৬:৫২ পিএম আপডেট: ১৬.০৩.২০২৫ ৭:২৩ পিএম  (ভিজিট : ৪৭)
ছবি: সময়ের আলো

ছবি: সময়ের আলো

কোনো জ্ঞানী সেই বিষয়ে ইতিহাসের জ্ঞান ছাড়া পর্যাপ্ত ও কার্যোপযোগী হয় না। আমাদের দেশেও রাজনীতি নিয়ে যেসব সমস্যা আলোচিত হয়, সেগুলোর জন্য বর্তমান বাস্তবতা ও তার ঐতিহাসিক পটভূমি জানা একান্ত দরকার। কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে আমাদের দেশে যারা রাজনীতিতে সক্রিয় তারা এ বিষয়ে জানার এবং কাজে লাগানোার উদ্যোগ রাজনৈতিক মহলে অতি অল্পই আছে।

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এবং বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে চিন্তাচর্চার উল্লেখযোগ্য কোনো কেন্দ্র খুঁজে পাওয়া যায় না। আমাদের রাজনৈতিক সংকটের নানা কারণের মধ্যে এটিও একটি বড় কারণ। সব কাজের জন্যই শিক্ষা অপরিহার্য। আমাদের দেশে সব কাজের জন্য শিক্ষা অর্জন করতে হয়। কিন্তু এই দেশে রাজনীতি করার জন্য কোনো শিক্ষা দরকার হয় না। এই পরিবেশে বাংলাদেশে এখন কোনো রাজনৈতিক নেতার সন্ধান পাওয়া যায় না। আসলেই কি বাংলাদেশে এখন কোনো রাজনৈতিক নেতা আছেন? যারা এখন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে কাজ করছেন, তারা কি আসলেই রাজনৈতিক নেতা?

আমাদের দেশে শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। তাদের তুল্য নেতা অনেক অনুসন্ধান করেও পাওয়া যাচ্ছে না। রাজনীতি সম্পর্কিত ধারণাও এখন বিকারপ্রাপ্ত। আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা আন্দোলন, আওয়ামী লীগের ছয় দফা আন্দোলন, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০-এর নির্বাচনের পর পহেলা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত জনগণের মধ্যে যে জাগ্রত মন ছিল, বর্তমানে তার সমকক্ষ মন-মানসিকতা নেই। ১৯০৫ থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের এক দশকের রাজনীতিতেও তা থাকেনি।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে তা নিয়ে আলোচনা চলছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরই রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দেয়। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ ঢাকায় এসে রমনা রেসকোর্স ময়দানে এবং পরের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে বক্তৃতা দেন। তার মধ্যে তিনি বলেছিলেন, ‘Urdu and only Urdu shall be the state language of Pakistan’। তখনকার পরিবেশে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল কায়েদে আজম বলে অভিহিত জিন্নাহর বক্তব্যের প্রতিবাদে ক্ষীণ কণ্ঠে হলেও ছাত্রদের থেকে ‘N0...N0’ এই কথাটি বলা হয়েছিল। দুই সভাতেই জিন্নাহ বুঝতে পেরেছিলেন যে পূর্ব বাংলা উচ্চ শিক্ষা পর্যায়ের ছাত্রদের এবং বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে রাষ্ট্রভাষা বিষয়ে তার সিদ্ধান্ত সমর্থন পাচ্ছে না।

জিন্নাহ তখন রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে আর কোনো বক্তব্য দেননি। ঢাকার ওই সভার পর তিনি আর এক বছরও বাঁচতে পারেননি। ১৯৪৮ সালের ২৫ ডিসেম্বর তার মৃত্যু হয়। রাষ্ট্রভাষা কেবল উর্দুই হবে, উর্দুর পাশাপাশি বাংলা থাকবে, মুসলিম লীগের নেতাদের এর বাইরে কোনো বক্তব্যকেই সংবিধানে স্থান দেওয়ার মানসিকতা ছিল না। এর ফলে পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্র কাঠামোতে রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি প্রবল থেকে প্রবলতর হতে থাকে।

পরে রাষ্ট্রভাষার দাবির সঙ্গে পূর্ব বাংলার বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি যুক্ত হয়। প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি উদযাপনকালে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার বাঙালি জাতীয়তাবাদের দাবি প্রবল থেকে প্রবলতর হতে থাকে। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ, পরে ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে থাকলে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার বাঙালি জাতীয়তাবাদের দাবি প্রবল হতে থাকে। এই বাস্তবতার মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদকে সঙ্গে নিয়ে ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন।

এই দাবি নিয়েই সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের এবং নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি হন। সোহরাওয়ার্দী পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি সমর্থন করতেন না। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা মুখ্য বিষয় হয়ে ওঠে এবং পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ সৃষ্টির প্রচেষ্টার বিরোধিতা করে পূর্ব বাংলার বাঙালি জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠে। পাকিস্তান আন্দোলনের সময়ে এবং তার আগে হিন্দু-মুসলমান বিরোধ তীব্র হয়। এই বিরোধকে কেন্দ্র করে বছরের পর বছর ধরে দাঙ্গা হয়। এমনকি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরও অন্তত ১০ বছর হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দাঙ্গা চলমান থাকে। এসব সম্পর্কে আমাদের কর্তব্য পর্যাপ্ত জ্ঞান অর্জন করা।

আজকের বাংলাদেশের যে অবস্থা তাতে বাংলা ভাষার উন্নতির জন্য সরকার থেকে নতুন কর্মসূচি নির্ধারণ করা, জনগণের চেতনাকে জাগ্রত করা এবং আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সর্বাঙ্গীণ দৃষ্টিভঙ্গি, পরিকল্পনা ও কার্যক্রম দরকার। আধুনিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলের কোনো বিকল্প নেই। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনৈতিক দল অপরিহার্য। বর্তমানে যে উপদেষ্টা পরিষদের মাধ্যমে আমাদের রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে, তারা রাষ্ট্রব্যবস্থা সংস্কারের জন্য যে কার্যক্রম অবলম্বন করছেন, দেশের শিক্ষিত লোকেরা কৌতূহলের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছেন। সংস্কার সাধন করতে হলে সংস্কারের পরিকল্পনা ও কার্যক্রমের সঙ্গে জনসাধারণকে সঙ্গে নিতে হয়। রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার অপরিহার্য। দেশের রাজনৈতিক দলগুলো এবং রাজনৈতিক নেতারা এই ধারায় কোনো মত প্রকাশ করেননি। এর জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব দরকার।

উপদেষ্টা পরিষদ অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে সংস্কারের যে কার্যক্রম চালাচ্ছেন তার পরিকল্পনা ও কার্যক্রম স্পষ্টভাবে জনসাধারণের মধ্যে প্রচার করে, রাজনৈতিক দল গঠন করে রাষ্ট্র ক্ষমতায় গিয়ে সেই ধারাটিকে বিকশিত করতে হবে। বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)- এই ধারার চিন্তাকে এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল অবলম্বন করে কাজ করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গ বাংলাদেশ নিয়ে তাদের নানা মত প্রকাশ করছে। সেগুলো বাংলাদেশে আমাদের জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের এবং জনজীবনের সমস্যাবলি সমাধানের প্রতিকূল। রাষ্ট্রভাষা বাংলা এবং রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ পরস্পর সম্পৃক্ত। বাংলা ছেড়ে ইংরেজিকে রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি গ্রহণ করা হলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিপর্যস্ত হবে।

গণতন্ত্রের জন্য গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল গঠন অপরিহার্য। জাতীয়তাবোধ, সর্বজনীন কল্যাণের বোধ এবং সাহসী কার্যক্রম দরকার। রাজনীতির প্রতি সদর্থক দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তা দরকার। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের চেতনা এখনও আমাদের জন্য উদ্দীপক। পরবর্তী যেসব আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা এগিয়েছি এবং ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি, তার মধ্যে সবসময় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের চিন্তা-চেতনা ভেতর থেকে আমাদেরকে প্রগতিশীল চিন্তার এবং সাহসী কার্যক্রম চালাতে উদ্বুদ্ধ করেছে।

লেখক : সভাপতি, বাংলা একাডেমি

অনুলিখন : মো. অলিউল ইসলাম




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ। নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।
ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close