ই-পেপার রবিবার ১৬ মার্চ ২০২৫
রবিবার ১৬ মার্চ ২০২৫
ই-পেপার

রবিবার ১৬ মার্চ ২০২৫

শিবির সন্দেহ ছাড়াও যেসব কারণে আবরারকে হত্যা করে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ
প্রকাশ: রবিবার, ১৬ মার্চ, ২০২৫, ১:১০ পিএম  (ভিজিট : ২২৪)
আবরার ফাহাদকে নির্যাতন করে হত্যার পর লাশ গুমের চেষ্টা করে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ কর্মীরা। ছবি: সংগৃহীত

আবরার ফাহাদকে নির্যাতন করে হত্যার পর লাশ গুমের চেষ্টা করে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ কর্মীরা। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যায় জড়িতরা ক্যাম্পাসে ভয়ের রাজত্ব গড়তে চাচ্ছিলেন। একজনকে মেরে অন্যজনকে শিক্ষা দিতে এবং জুনিয়রদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াতে দীর্ঘদিন ধরে র‌্যাগিংয়ের নামে নির্যাতন চালিয়ে আসছিলেন তারা। যার আচরণ অপছন্দ হতো, তাকেই ডেকে এনে নানা নির্যাতন করা হতো।

আবরারের খুনিরা রাজনৈতিক পরিচয়কে শেল্টার হিসেবে ব্যবহার করে এসব নির্যাতন চালাতো। আবরারকে হত্যার কোনো একক কারণ ছিল না। শিবির সন্দেহসহ একাধিক কারণে টার্গেট করা হয়েছিল তাকে। 

আবরার হত্যাকাণ্ডে দায়ের করা মামলায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তৎকালীন তদন্তে উঠে আসে এসব তথ্য। এ তথ্যের ভিত্তিতেই এ মামলার রায় দেয় বিচারিক আদালত, যা আজ হাইকোর্ট বহাল রেখেছে।

আবরার হত্যাকাণ্ডের পর এর কারণ নিয়ে সহপাঠীরা বলেছিল, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী হাসিনার ভারত সফর নিয়ে ফেসবুকে আপত্তিকর স্ট্যাটাস এবং শিবির সন্দেহে আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করেছে ছাত্রলীগ। 

অবশ্য চাঞ্চল্যকর ওই মামলার চার্জশিট জমা দেয়ার পর তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, একক কোনো কারণে ওই হত্যাকাণ্ড ঘটেনি। আসামিদের বেশির ভাগের রাজনৈতিক পরিচয় থাকলেও সেটা শুধু ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডে রাজনৈতিক কোনো কারণও নেই। 

২০২৯ সালের ১৩ নভেম্বর মিন্টো রোডে এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, 'কোনো একক কারণে আবরার ফাহাদকে হত্যা করা হয়নি। আবরার শিবির করে কি-না, হত্যার পেছনে এটি একটি মাত্র কারণ। স্ট্যাটাসও হত্যাকাণ্ডের কারণ নয়। মূলত যারা তাকে হত্যা করেছে, তারা উচ্ছৃঙ্খল আচরণে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। সমষ্টিগত কারণে আবরারকে শায়েস্তা করতে গিয়েই নৃশংস ঘটনাটি ঘটিয়েছে তারা। অনেক কারণের মধ্যে আসামিদের ধারণা ছিল, আবরার শিবির করতে পারে, হিযবুত তাহ্‌রীর করতে পারে।'

মনিরুল ইসলাম বলেছিলেন, 'তারা র‌্যাগিংয়ের নামে আতঙ্কজনক পরিস্থিতি তৈরি করে রাখত। কেউ হয়তো সালাম দেয়নি, দেখে হয়তো কেউ হেসেছে, এজন্যও অনেককে পিটিয়েছে তারা। এ ধরনের রুক্ষ আচরণ করতে করতে আবরার হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে নৃশংস ঘটনাটি ঘটিয়েছে। আসামিরা অছাত্রসুলভ জীবনধারণে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। তারা কর্তৃত্ববাদী আচরণ প্রতিষ্ঠা করতে রাজনৈতিক পরিচয়টা ব্যবহার করত।'

যে কারণে হত্যা  

আসামিদের কাছ থেকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য ও তদন্তে পাওয়া তথ্য উল্লেখ করে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম ওই সময় বলেন, 'আসামিরা মনে করত আবরারের আচরণগত সমস্যা ছিল। বড় ভাইদের দেখলে সালাম দেয় না। ডাইনিং রুমেও বড়দের দেখলে তির্যক মন্তব্য করত। অভিযুক্তরা মনে করেছে, আবরার এসব তাদের উদ্দেশ্যেই করেছে।'

তিনি বলেন, 'আসামিরা মনে করেছে আবরার তাদের অবজ্ঞা করে, তাদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করছে না। কারণ এই আসামিরা বিভিন্ন সময়ই ছাত্র হলে অরাজকতা করেছে। তাদের যেন সবাই ভয় করে, আনুগত্য প্রকাশ করে, এজন্য বিভিন্ন সময় অনেককে এরা পিটিয়েছে। নতুন ব্যাচের ছাত্রদের দেখানোর জন্যও জুনিয়র কোনো ছাত্রকে ধরে এনে সামান্য কারণেও পেটাত তারা। মূলত এসব কারণের সমষ্টিতেই আবরার হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।'

মনিরুল বলেন, যে কারণেই হত্যাকাণ্ড হোক, জড়িত সবাইকে আসামি করা হয়েছে। অনেকে ঘটনাস্থলে ছিল না; কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে ছিল। তদন্তে সম্পৃক্ততা পেয়ে তাদেরও চার্জশিটভুক্ত করা হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তারা আশা করছেন, এই তদন্তে প্রত্যেক আসামিই সর্বোচ্চ শাস্তি পাবে। যারা সম্ভাব্য অপরাধী, যারা উচ্ছৃঙ্খলতা করে, তাদের কাছেও এই তদন্ত, এই চার্জশিট মেসেজ হিসেবে কাজ করবে। সামাজিক অবস্থান, রাজনৈতিক অবস্থান, ধর্মীয় বা লিঙ্গভিত্তিক অবস্থান, যার যেটাই হোক, আইন অমান্য করলে, অপরাধ করলে আইনের আওতায় আসতেই হবে। এটা ভবিষ্যতের শিক্ষণীয় বিষয় হিসেবে কাজ করবে।

বিশ্ববিদ্যালয় ও হল প্রশাসনের ব্যর্থতা দেখেছিল পুলিশ 

তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, বুয়েটের প্রশাসন ও শেরেবাংলা হলের প্রশাসন যদি সতর্ক থাকত, আগে থেকে মনিটর করত, তাহলে হয়তো এমন নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড ঘটত না। তারা আবরার হত্যাকাণ্ড তদন্ত করতে গিয়ে দেখেছেন, এই আসামিরা রাজনীতিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে ক্যাম্পাস ও হলগুলোতে নানা অপরাধ করেছে। কিন্তু হল প্রশাসন বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তা প্রতিরোধ করতে পারেনি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অভিযোগ করেনি বা সহায়তাও চায়নি।

ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম আরও বলেছিলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সতর্ক হলে হয়তো এমন নৃশংস ঘটনা ঘটত না। যদিও এটা হত্যা মামলার তদন্তের অংশ ছিল না। তবুও সার্বিক বিবেচনায় হল কর্তৃপক্ষের এক ধরনের ব্যর্থতা দেখেছি।' তিনি বলেন, এই ব্যর্থতার বিষয়ে হয়তো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দেখবে, ব্যবস্থা নেবে।

তিনি জানান, তদন্তে তারা জানতে পেরেছেন, রাত ১০টার পর থেকে আবরারের ওপর নির্যাতন শুরু হয়। ২টা ৫০ মিনিটের দিকে ডাক্তার তাকে দেখে মৃত ঘোষণা করেন। দীর্ঘ সময় ধরে পেটানো হচ্ছিল তাকে। আবরারকে হয়তো একটু আগে হাসপাতালে নিয়ে গেলে এমন নৃশংস পরিণতি হতো না। পুলিশ খবর পেয়েছিল ৩টার পর। ঘটনাস্থলে গেলেও বলা হয়েছে, সব ঠিক আছে। তার আগেই আবরার মারা যায়। পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, 'আবরার হত্যাকাে র ক্ষেত্রে তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন, তদন্ত সহায়ক দল ছিল, সিসিটিভি ফুটেজ, পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য-প্রমাণ, ফেসবুক মেসেঞ্জার গ্রুপের তথ্য রয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি থেকে পাওয়া তথ্যের বিশ্লেষণ, পাশাপাশি আট আসামির জবানবন্দিও হত্যাকাণ্ডের অনেক বিষয় প্রমাণ করে। যদিও এ ধরনের ঘটনায় চাক্ষুষ সাক্ষী থাকলেও সাক্ষ্য দিতে এগিয়ে আসে না। কিন্তু তারা যেভাবে চার্জশিট প্রস্তুত করেছেন, তাতে সবার সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত হবে বলে আশা করছেন।

ভয়াবহ নির্যাতন

তদন্তে উঠে আসে, আবরারকে ভয়াবহ নির্যাতন করা হয়েছিল। হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের একটি গ্রুপ ৪ অক্টোবর শেরেবাংলা হলের ক্যান্টিনে একটি মিটিং করে। এরপর হলের গেস্টরুমে আবরার ইস্যুতে মিটিংয়ে বসে তারা। ৬ অক্টোবর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে 'বড় ভাইদের' নির্দেশে ১০১১ নম্বর কক্ষ থেকে আবরারকে ডেকে নেয় বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের দুই সদস্য মুনতাসিরুল আল জেমি ও এহতেশামুল রাব্বি তানিম। মেঝেতে বসিয়ে ২০১১ নম্বর কক্ষে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। হলে কেউ বিতর্কিত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত কি-না তার কাছে জানতে চাওয়া হয়। 

একপর্যায়ে আবরারের ওপর চালানো হয় নিষ্ঠুর নির্যাতন। এক পর্যায়ে আবরার বমি করতে থাকে। তখন তাকে নেওয়া হয় ২০০৫ নম্বর কক্ষে। তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে নিচতলায় নামানোর চেষ্টা করা হয়। একপর্যায়ে সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ের কাছে ফেলে রাখা হয়। পরে বুয়েটের চিকিৎসক এসে হলের করিডোরে মৃত ঘোষণা করেন তাকে। আবরারের ওপর নির্যাতনে বড় ভূমিকা ছিল অনিক সরকারের। তাকে স্টাম্প দিয়ে এলোপাতাড়ি পেটায় সে। তার সঙ্গে অন্যরা যোগ দেয়। স্কিপিং রোপ দিয়ে কয়েক ঘণ্টা ধরে বেধড়ক পেটানো হয়েছিল। সেই ভয়ংকর বিবরণ উঠে এসেছে অনেকের জবানবন্দিতে।




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ। নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।
ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close