
জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস ও পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন শনিবার ঢাকায় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে যৌথ প্রেস ব্রিফিং করেন। ছবি: পিআইডি
নির্বাচন আগে নাকি সংস্কার-এমন সমীকরণ সামনে রেখে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলগুলো বাংলাদেশ সফররত জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিয়েছে। শেষ পর্যন্ত টেবিলে সংস্কারই গুরুত্ব পায়। বড় দল বিএনপি ছাড়া বেশিরভাগ দল সংস্কারকে গুরুত্ব দিয়ে বক্তব্য রেখেছে। এজন্য কেউ কেউ জাতিসংঘের সহযোগিতাও চেয়েছে। বিএনপি বরাবরের মতোই দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের কথা বলেছে। গণ অভ্যুত্থান-পরবর্তী দেশের চলমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় সংকট উত্তরণে নির্বাচনকেই টেবিলের সামনে রেখেছে বিএনপি।
বৈঠকে অংশ নেওয়া নেতারা সময়ের আলোকে এসব কথা বলেন। শনিবার দুপুরে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বিএনপি, জামায়াত, নাগরিক ঐক্য, সিপিবি, এবি পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, এনসিপি এই সাতটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে গোলটেবিল বৈঠক করেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। জাতিসংঘ ঢাকা অফিসের উদ্যোগে এ গোলটেবিল বৈঠকটি হয়।
বৈঠকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ, জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের, সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি প্রমুখ অংশ নেন।
পরে মাহমুদুর রহমান মান্না সময়ের আলোকে বলেন, আমরা বেশিরভাগ দলই কার্যকর সংস্কারে গুরুত্বারোপ করেছি। টেকসই গণতন্ত্রের জন্য সংস্কারের বিকল্প নেই। এর পেছনে যুক্তি তুলে ধরা হয় জাতিসংঘ মহাসচিবের সামনে। দীর্ঘদিন ধরে দেশে গণতন্ত্র অনুপস্থিত ছিল। গণতন্ত্রকে স্থায়ী রূপ দিতে সংস্কার জরুরি। রাজনীতিতে বড় সংস্কার আনতে হবে। জনগণকে গ্রহণযোগ্য ভোট উপহার দিতে হলে বিভিন্ন খাতে সংস্কার করতে হবে। যদিও বিএনপি নির্বাচনটাই গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে বক্তব্য রেখেছে। তারা সবসময় নির্বাচনের কথা বলে আসছে। বৈঠকে তাই বলেছে। জামায়াত সংস্কারকে অগ্রাধিকার দিয়েছে।
তিনি জানান, বৈঠকে সবাই দুই-তিন মিনিট করে বক্তব্য রাখেন। প্রত্যেক দলের পক্ষে একজন কথা বলেন। তবে কেউ সংস্কার বিএনপি ছাড়া বেশিরভাগ দল সংস্কার আগে চাইল ও নির্বাচনের জন্য সময়সীমা নিয়ে কথা বলেননি। জাতিসংঘ মহাসচিব সবার কথা শুনেছেন। সবশেষে তিনি বক্তব্য রাখেন। তবে সুনির্দিষ্ট কারোর মতামত নিয়ে মহাসচিব বক্তব্য দেননি।
বৈঠকের পর বিএনপি মহাসচিব সাংবাদিকদের বলেন, মূলত এখানে সংস্কারের জন্য যে কমিশনগুলো করা হয়েছে সে সম্পর্কে জাতিসংঘের মহাসচিবকে অবহিত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা সংস্কারের কথা আগেই বলেছি সেই সংস্কার অবশ্যই করতে হবে। কিন্তু সংস্কারটা যত দ্রুত করা যায়। আমরা যেটা বলেছি, মূলত নির্বাচনকেন্দ্রিক যে সংস্কারগুলো আছে সেগুলো করে ফেলা এবং দ্রুত নির্বাচন করে বাকিগুলো সংসদের মাধ্যমে করে ফেলা। সংস্কারগুলো চলমান প্রক্রিয়া, সেই বিষয়গুলো আমরা বলেছি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ওখানে টাইম ফ্রেম নিয়ে কথা বলার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ এটা তো আমাদের সম্পূর্ণ অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। জাতিসংঘের মহাসচিবকে আমরা টাইম ফ্রেম দিতে যাব কেন?
পরে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ সময়ের আলোকে বলেন, আমরা নির্বাচনকে গুরুত্ব দিয়েছি। দেশের এ অবস্থায় নির্বাচন জরুরি। এ জন্য দ্রুত প্রয়োজনীয় সংস্কার কাজ শেষ করতে হবে। অন্য দলগুলো তাদের নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করেছে।
এনসিপির প্রধান নাহিদ ইসলাম বলেন, আলোচনায় ৫ আগস্ট-পরবর্তী যে বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের যে গণতন্ত্র একটা রিফর্ম প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সে বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। রিফর্ম কমিশনের প্রধানরা তাদের নিজ নিজ কমিশনের সংস্কারের সারসংক্ষেপ তুলে ধরেছেন এবং রাজনৈতিক দলগুলো তাদের দলীয় অবস্থান তুলে ধরেছে।
নাহিদ আরও বলেন, এনপিসির সংস্কার বিষয়ে আমাদের যে অবস্থান আমরা মনে করি, গণঅভ্যুত্থান পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী সময়ে যে সরকার গঠিত হয়েছে, সংস্কার ও বিচার হলো অন্যতম কমিটমেন্ট জনগণের কাছে। ফলে মৌলিক সংস্কারের ভিত্তি এ সরকারের সময়ে তৈরি করতে হবে এবং সব রাজনৈতিক দল মিলে যে একটা ঐকমত্য পোষণ করতে হবে যেটা জুলাই সনদের কথা বলা হচ্ছে সেই জুলাই সনদে স্বাক্ষরের মাধ্যমে। আমরা জুলাই সনদের দ্রুত বাস্তবায়নের কথা বলেছি।
জামায়াতের গোলাম পরওয়ার বলেন, আমরা সংস্কার, সুষ্ঠু নির্বাচন, টেকসই গণতন্ত্র ও জাতীয় ঐক্য নিয়ে কথা বলেছি। জাতিসংঘের মহাসচিব সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
নির্বাচন সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে নাহিদ বলেন, সংস্কারবিহীন নির্বাচন কোনো কাজে দেবে না। অন্য সব রাজনৈতিক দলও এটার সঙ্গে একমত পোষণ করে। এখানে মতপার্থক্যগুলো হচ্ছে কোন সংস্কার কখন হবে, নির্বাচনের আগে কতটুকু হবে নির্বাচনের পরে কতটুকু হবে, এটা নিয়ে। সেটা আমরা মনে করি যে, জুলাই সনদের মধ্যে সেটা বাস্তবায়ন হলে মতপার্থক্যগুলো কেটে যাবে এবং আমরা একটা ঐকমত্যে আসতে পারব।
বৈঠকে জাতিসংঘের মহাসচিব বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলো যাতে নিজেরাই সমঝোতায় আসে, একটা ঐকমত্যে আসে সে ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি বলেন, গণতন্ত্রের যে উত্তরণ সেটাকে মাথায় রেখে যাতে আমরা একসঙ্গে কাজ করি, একটা ইউনিটিতে আসতে পারি সেটা তিনি তার জায়গা থেকে প্রত্যাশা করেছেন।
জাতিসংঘে হাসিনা পরিবারের ৩ জন সদস্য কর্মরত। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে জাতিসংঘের মহাসচিবকে অনুরোধ করেছেন এবি পার্টির আসাদুজ্জামান ফুয়াদ। তিনি জানান, শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, যিনি বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থায় কর্মরত; শেখ রেহানার ছেলে ববি, যিনি ইউএনডিপিতে সুশাসন উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং শেখ রেহানার পুত্রবধূ, যিনি ব্যাংককভিত্তিক আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থায় (আইওএম) কাজ করছেন।
গোলটেবিল এ বৈঠকে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার বিষয়ক কমিশনের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার, পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।
আরও ছিলেন অন্তবর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল, তথ্য উপদেষ্টা মাহবুব আলম, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মুনির হায়দার।
জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক গোয়েন লুইস, ইউএনএইটসিআরের আবাসিক প্রতিনিধি সুম্বুল রিজভী, আইনএলওর কান্ট্রি ডাইরেক্টের টুমো পুটিআইনেন, ডব্লিউএফপির আবাসিক প্রতিনিধি ডমিনিকো স্কেলপেনি, ইউএনডিপির আবাসিক প্রতিনিধি স্টেফান লিলার, ডব্লিউএইচওর আবাসিক প্রতিনিধি বর্ধন জং রানা, ইউএনওপিএসের আবাসিক প্রতিনিধি সুধীর মুরলীধরন, আইওএমর মিশন প্রধান ল্যানস বনেউ, ইউনেস্কোর প্রধান নির্বাহী পরিচালক ও ইউনিসেফের আবাসিক প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।