
মসজিদে তারাবি নামাজ আদায় করছেন মুসল্লিরা। ছবি: হারামাইন
আজকের তারাবিতে সুরা মুমিনুন, সুরা নুর ও সুরা ফুরকানের ১ থেকে ২০ নম্বর আয়াত পড়া হবে। পারা হিসেবে কোরআনের ১৮তম পারা। মুমিনের গুণ, খাঁটি ঈমান, ব্যভিচার, ব্যভিচারের অপবাদ, অপপ্রচারের শাস্তি, আসমান-জমিন সৃষ্টি, আল্লাহর ভয়, দ্বীনের মূলনীতি, দৃষ্টির হেফাজত, ঘরে প্রবেশের অনুমতি, বিধবাদের বিয়ের ব্যবস্থা, কিয়ামতের ভয়াবহতা, হিসাবের পাল্লা, ক্ষমা প্রার্থনা, সমাজজীবনে শিষ্টাচার, কোরআনের শ্রেষ্ঠত্ব, নবী-রাসুলগণ মানুষ, পর্দা, বৃদ্ধা নারীর পর্দা ও দাস-দাসীদের ব্যাপারে নির্দেশনাসহ ইত্যাদি বিষয়ের বর্ণনা আছে এই অংশে।
সফল মুমিনের সাত গুণ
১১৮ আয়াত বিশিষ্ট সুরা মুমিনুন কোরআনের ২৩তম সুরা। এটি মক্কায় অবতীর্ণ। এ সুরায় মুমিন বান্দাদের সম্পর্কে আলোচনা রয়েছে। তাই এর নাম রাখা হয়েছে সুরা মুমিনুন। মুমিনদের সাতটি গুণের কথা বলা হয়েছে সুরা মুমিনের ২ থেকে ৯ নম্বর আয়াতে। যথা—
১. তারা নামাজে দাঁড়ায় বিনয়ী ও নম্র হয়ে।
২. অনর্থক কথাবার্তা বলেন না।
৩. জাকাত আদায় করেন।
৪. অবৈধ যৌনাচার থেকে বিরত থাকেন।
৫. নামাজের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতি যত্নবান থাকেন।
৬. প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন।
৭. আমানত ফিরিয়ে দেন।
বৃষ্টি আল্লাহর নেয়ামত
আল্লাহ পানির মাধ্যমে পৃথিবী সজীব রাখেন। পানি ছাড়া প্রাণ জীবন্ত থাকতে পারে না। তৃষিত মন শীতল হয় না। সেই পানি জোগানের জন্য আল্লাহ প্রথমে সূর্যের তপ্ত আগুনকে নিক্ষিপ্ত করেন বিশাল সমুদ্রে। সেখান থেকে পানি বাষ্প হয়ে ওপরে উঠে যায়। সেখানে মেঘের সৃষ্টি হয়। সেই মেঘ বৃষ্টি হয়ে নামে পৃথিবীতে। মৃত জলাধার ফিরে পায় সোনালি যৌবন। সবুজ হয়ে ওঠে মাঠের পর মাঠ। বৃষ্টির পানি পান করে মিষ্টি ও সুস্বাদু হয় আম, আঙুর, খেজুর ইত্যাদি। এই পানি করলার ফুল বুকে ধারণ করে হয় তিতা। সাপের মুখে পড়লে হয় বিষ। হরিণের উদরে গিয়ে হয় মৃগনাভি। একই পানি প্রয়োজনের সীমা পার করলে হয়ে ওঠে মরণ। পানি ফুরিয়ে গেলে দেখা দেয় আকাল। আল্লাহ বলেন, ‘আমি আকাশ থেকে পরিমিত বৃষ্টি বর্ষণ করি, আমি তা জমিনে সংরক্ষণ করি...। এরপর আমি তা দিয়ে তোমাদের জন্য খেজুর ও আঙুরের বাগান সৃষ্টি করি...।’ (সুরা মুমিনুন, আয়াত : ১৮-১৯)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বৃষ্টিতে ভিজতেন। তিনি বৃষ্টি পছন্দ করতেন। আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন, ‘আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে ছিলাম, এমন সময় আমাদের ওপর বৃষ্টি নামল। রাসুলুল্লাহ (সা.) শরীরের ওপরিভাগ থেকে কাপড় সরিয়ে দিলেন। ফলে তাঁর শরীর বৃষ্টিতে ভিজে গেল। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসুল, আপনি কেন এমন করলেন? তিনি উত্তরে বললেন, যেহেতু তা মহান প্রভুর পক্ষ থেকে সদ্য আগত, তাই আমি বরকতের জন্য শরীরে লাগিয়ে নিলাম।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৮৯৮)
কল্যাণকামীদের চার গুণ
আল্লাহর কাছ থেকে দ্রুত কল্যাণ অর্জনকারী ও তাতে অগ্রগামী মানুষের চারটি গুণের কথা বলা হয়েছে এ সুরার ৫৮ থেকে ৫৯ নম্বর আয়াতে। চারটি গুণ হলো—
১. তারা আল্লাহর শাস্তির ভয় করেন।
২. আল্লাহর কথার ওপর বিশ্বাস রাখেন।
৩. আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করেন না।
৪. আল্লাহর কাছে নেক আমল কবুল হচ্ছে কি না, এ ভয়ে থাকেন।
ক্ষমা প্রার্থনা
কিয়ামতের দিন অবিশ্বাসীরা পড়বে মহাবিপদে। তাদের আমলের পাল্লা হবে হালকা। সেদিন জাগতিক কোনো সম্পর্ক কাজে আসবে না। মানুষ একা হয়ে যাবে। আল্লাহর কাছে নিজের কাজকর্ম নিয়ে একা দাঁড়াতে হবে। সুরা মুমিনের শেষ আয়াতে আল্লাহ এসব বিষয়ের বর্ণনা দিয়ে মানুষকে তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার শিক্ষা দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘বলুন (নবি), হে আমার পালনকর্তা, ক্ষমা করুন এবং রহম করুন। রহমকারীদের মধ্যে আপনি শ্রেষ্ঠ রহমকারী।’ (সুরা মুমিনুন, আয়াত : ১১৮)
পবিত্রতা রক্ষার কথা সুরা নুরে
মদিনায় অবতীর্ণ সুরা নুর কোরআনের ২৪তম সুরা। এর আয়াতের সংখ্যা ৬৪। এ সুরায় নুর শব্দটি থাকায় এর নামকরণ করা হয়েছে সুরা নুর। এ সুরায় নারী, নারীর পবিত্রতা রক্ষা ও পর্দা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে।
আয়েশা (রা.)-এর পবিত্রতায় ১০ আয়াত
বনি মুসতালিকের যুদ্ধে আয়েশা (রা.)-কে সঙ্গে নিয়ে গেলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)। যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে তিনি মদিনায় ফিরছিলেন। ফেরার পথে যাত্রাবিরতিতে আয়েশা (রা.) প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে হাওদা থেকে বের হলেন। ব্যাপারটি কারও চোখে পড়েনি। তাকে ছাড়াই কাফেলা এগিয়ে যায়। তার ওজন কম থাকায় হাওদা বহনকারীদের মনে হয়নি যে, তিনি হাওদায় নেই। আয়েশা (রা.) ফিরে এসে কাউকে পেলেন না। অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা ও স্থিরচিত্ততার সঙ্গে চাদর মুড়িয়ে শুয়ে পড়লেন উন্মুক্ত মাঠে। সফরের ক্লান্তিতে তলিয়ে যান ঘুমের গভীরে। সাহাবি সাফওয়ান বিন মুয়াত্তাল (রা.)—যাকে রাসুলুল্লাহ (সা.) ফেলে যাওয়া আসবাবপত্র কুড়িয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন—সৈন্যদল চলে যাওয়ার পর তিনি সেখানে ছিলেন। সাফওয়ান একজন ঘুমন্ত মানুষ দেখে এগিয়ে এলেন। আয়েশা (রা.)-কে দেখা মাত্রই চিনলেন। কারণ তিনি তাঁকে পর্দার বিধান নাজিল হওয়ার আগে দেখেছিলেন। তিনি তখন ‘ইন্নালিল্লাহ’ পড়লেন। শব্দ শুনে আয়েশা (রা.)-এর ঘুম ভেঙে গেল। চাদর টেনে ভালোমতো চেহারা ঢেকে নিলেন তিনি। সাফওয়ান উটটি বসিয়ে ইশারায় আয়েশাকে উটের পিঠে উঠতে বলেন। সাফওয়ান উটের রশি ধরে আগে আগে হেঁটে মদিনার পথ ধরেন। (আর-রাওজুল উনুফ, খণ্ড : ৪, পৃষ্ঠা : ২৪)
মুনাফিকেরা আয়েশা (রা.)-এর বিরুদ্ধে ব্যভিচারের অপবাদ দিল। নবীজি (সা.) কষ্ট পেলেন। স্ত্রীকে রেখে এলেন শ্বশুর আবু বকর (রা.)-এর ঘরে। আয়েশা (রা.) অপবাদের ব্যাপারটি জেনে ম্রিয়মাণ হয়ে থাকেন। খুব করে কাঁদেন আল্লাহর কাছে। টানা দুই রাত এক দিন কেটে যায় কাঁদতে কাঁদতে। এর মধ্যে নবীজি যখন তাঁর কাছে অভিযোগের ব্যাপারটি জানতে চান, তখন তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। অভিমানে অশ্রু শুকিয়ে আসে তাঁর। দীর্ঘ এক মাস পর আল্লাহ তাআলা আয়েশা (রা.)-এর পবিত্রতা ঘোষণা করে সুরা নুরে ১০টি আয়াত নাজিল করেন। নবীজি (সা.) আয়েশাকে ডেকে বললেন, ‘শোনো আয়েশা, আল্লাহ তোমাকে নির্দোষ ঘোষণা করেছেন। সচ্চরিত্রার সনদ দিয়েছেন।
আরও পড়ুন: ইয়াজুজ-মাজুজের গল্প ও মরিয়ম (আ.)-এর মৃত্যু কামনা
গোপনীয়তায় সুরক্ষিত
সুরা নুরের ২৭ থেকে ২৯ ও ৫৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তাআলা ঘরে প্রবেশের নীতিমালা বর্ণনা করেছেন। কারও ঘরে প্রবেশে অনুমতি নেওয়া আল্লাহর আদেশ ও মহানবি (সা.)-এর আদর্শ। সেটা স্ত্রী, মা-বাবা, সন্তান ও বন্ধু-বান্ধব—যেই হোক না কেন। ঘরে প্রবেশের ক্ষেত্রে দুটি কাজ করতে হবে—এক. অনুমতি নেওয়া। দুই. সালাম দেওয়া।
অপ্রাপ্তবয়স্করা বিশেষ তিন সময়ে অনুমতি নেবে—
এক. ফজর নামাজের আগে।
দুই. দুপুরে ঘুমানোর সময়।
তিন. এশার নামাজের পর।
এ সময়গুলোয় স্বামী-স্ত্রী নির্জনে সময় কাটানোর সম্ভাবনা বেশি থাকে। মানুষ তখন নিজের মতো করে ঘুমাতে যায়। অনুমতি ছাড়া ঘরে প্রবেশ করা অপরাধ। আল্লাহ তাআলা ঘরে প্রবেশে অনুমতি নেওয়া আবশ্যক করেছেন। তিনবার অনুমতি চাইতে হবে। বর্তমানে অনেক বাসায় কলিংবেলের ব্যবস্থা আছে। সেক্ষেত্রে কলিংবেল বাজানোই ভালো। অনুমতি না পেয়ে কিংবা ঘরের ভেতর থেকে সাড়া-শব্দ না পেয়ে উঁকি দেওয়া নিষেধ।
কোরআনের ২৫তম সুরা ফুরকান মক্কায় অবতীর্ণ। এর আয়াত সংখ্যা ৭৭টি। ফুরকান অর্থ আলাদা করা, পৃথক করা। এ সুরায় সত্য-মিথ্যার মধ্যে পার্থক্যের ব্যাপার আলোচনা হওয়ায় এর নাম রাখা হয়েছে সুরা ফুরকান। এ সুরার শুরুতে কোরআনের আলোচনা রয়েছে। অবিশ্বাসীরা কোরআনের আয়াত মিথ্যা সাব্যস্ত করেছিল। নানান কথা বলেছিল। আল্লাহ এসবের জবাব দিয়েছেন। মুহাম্মাদ (সা.)-কে নিয়েও তারা বিভিন্ন কথা বলত। তারাবির এই অংশে সেসবের জবাব আছে।
লেখক: আলেম ও সাংবাদিক