
ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্র কি একটি সাংবিধানিক সংকটে জড়িয়ে পড়েছে? পরিস্থিতি বিবেচনা করুন। কংগ্রেস কার্যত বাজেট সংক্রান্ত ক্ষমতা একটি অনির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্টের হাতে তুলে দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট একতরফা নির্বাহী ক্ষমতা ঘোষণা করেছেন, যা এতটাই শক্তিশালী যে এটি আমেরিকার রাজনৈতিক ব্যবস্থার গণতান্ত্রিক চরিত্রকে হুমকির মুখে ফেলেছে। সেই একই প্রেসিডেন্ট এমন পদক্ষেপ নিয়েছেন নির্লজ্জভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করে। কিন্তু ‘সংকট’ ধারণার সমালোচকরা উল্লেখ করেন, আইনের লঙ্ঘন, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং সীমা অতিক্রম করা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট এখনও এমন পদক্ষেপ নেননি যা স্পষ্টভাবে সাংবিধানিক সংকটের চিহ্ন বহন করে।
তবে একটি বিষয় পরিষ্কার, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রচণ্ড চাপে রয়েছে। এই চাপ যদি সাংবিধানিক শৃঙ্খলার অখণ্ডতাকে হুমকির মুখে ফেলে, তবে তা এই কারণে যে আমেরিকান ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে গভীর অবক্ষয়ের মধ্যে রয়েছে। একটি সংকট তখনই ঘটে যখন একটি সংবিধান তার প্রধান কাজ, অর্থাৎ রাজনৈতিক মতপার্থক্যকে সাধারণ রাজনীতির মধ্যে প্রবাহিত করার লক্ষ্য ব্যর্থ হয়। যখন মতপার্থক্য সহিংসতায় পরিণত হয় তখনই সাংবিধানিক সংকটের সৃষ্টি হয়।
এখান থেকে দুই রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ বালকিন এবং লেভিনসন, গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক সংকটের একটি শ্রেণিবিভাগ উপস্থাপন করেন। এর মধ্যে প্রথম সংকট হলো, যেখানে রাজনৈতিক নেতারা প্রকাশ্যে সমাজের সামগ্রিক শৃঙ্খলা রক্ষার এবং মুহূর্তের জরুরি পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য সংবিধানের নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য স্থগিত করার অধিকার দাবি করেন। এই ধরনের সংকটে, একজন প্রেসিডেন্ট কার্যত সার্বভৌম ক্ষমতা দাবি করেন।
কোনো প্রেসিডেন্ট কখনো সংবিধানের বাইরে কাজ করার অধিকার দাবি করেননি। বরং যারা তাদের ক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করেছেন, তারা তাদের কর্মকাণ্ডকে বৈধ কর্তৃত্বের প্রয়োজনীয় অনুশীলন হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। যেমন-আমেরিকার গৃহযুদ্ধের শুরুতে আব্রাহাম লিঙ্কন বা আরও সাম্প্রতিককালে, ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার পর জর্জ ডব্লিউ বুশ।
দ্বিতীয় সংকটে, রাজনৈতিক নেতারা সংবিধানকে পুরোপুরি ত্যাগ করেন না, বরং একটি ব্যর্থ সাংবিধানিক ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে অস্বীকৃতি জানান। ‘যদি প্রথম সংকটে এমন অভিনেতারা থাকেন যারা প্রকাশ্যে সংবিধানের প্রতি আনুগত্য ত্যাগ করেন’, বালকিন এবং লেভিনসন লেখেন, ‘তবে দ্বিতীয় সংকট আসে অতিরিক্ত আনুগত্য থেকে, যেখানে রাজনৈতিক নেতারা তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করেন, এমনকি আকাশ ভেঙে পড়লেও।’ এই ধরনের সংকটের একটি আদর্শ উদাহরণ ১৮৬০ থেকে ১৮৬১ সালের শুরুর বিচ্ছিন্নতাবাদী সংকটে, যখন প্রেসিডেন্ট জেমস বুকানন চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন, আর দক্ষিণের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ফেডারেল অস্ত্রাগার দখল করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
বালকিন এবং লেভিনসনের আলোচনায় সাংবিধানিক সংকটের তৃতীয় ও চূড়ান্ত বিভাগটি এমন একটি পরিস্থিতি বোঝায়, যেখানে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ তাদের সাংবিধানিক আনুগত্য ঘোষণা করে কিন্তু সংবিধান কী দাবি করে এবং কার কাছে যথাযথ ক্ষমতা রয়েছে সে বিষয়ে মতভেদ হয়। সাধারণ মতবিরোধ থেকে একে আলাদা করে এমন বিষয় হলো, বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য সাধারণ রাজনৈতিক পথের বাইরে গিয়ে, এমনকি সহিংসতার পথেও যাওয়ার ইচ্ছা।
সাংবিধানিক সংকট বারাক ওবামার উত্থানের সময় একটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ যুক্তি বলে মনে হয়েছিল, যার প্রেসিডেন্সি ভবিষ্যতের প্রতি আশাবাদ এবং প্রতিশ্রুতি নিয়ে শুরু হয়েছিল। তবে পরিস্থিতি এবং মনোভাব আরও উপযুক্ত হয়ে ওঠে আট বছর পরে, যখন ট্রাম্প প্রশাসনের শুরুর সময় বালকিন এই সংবিধানিক সংকটের বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে ‘সাংবিধানিক পচন’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন।
সাংবিধানিক গণতন্ত্রের টিকে থাকার জন্য নীতিমালাগুলোর ওপর নির্ভর করতে হয়। একটি সফল প্রজাতন্ত্রের ভিত্তি হলো সুস্থভাবে কার্যকরী প্রতিষ্ঠান। এটি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং সাধারণ নাগরিকদের কাছ থেকে সংযমের একটি নির্দিষ্ট মাত্রা দাবি করে, যখন ক্ষমতার ব্যবহার প্রশ্নে আসে।
সাংবিধানিক গণতন্ত্রের জন্য জনকল্যাণের প্রতি ব্যাপক প্রতিশ্রুতি প্রয়োজন, যাকে আমরা নাগরিক গুণাবলি বলতে পারি, যা যুক্তরাষ্ট্রের বিপ্লবী প্রজন্মের একটি বিশেষ আবেগ। এর মধ্যে রয়েছে সাধারণ জনগণ, যাদের দায়িত্ব হলো নিজেদের তথ্যপূর্ণ ও সম্পৃক্ত রাখা এবং নির্বাচিত কর্মকর্তারা, যাদের জনকল্যাণের প্রতি দায়বদ্ধতা রয়েছে এবং যাদের উচিত সংকীর্ণ স্বার্থ বা তাদের সহযোগীদের স্বার্থের চেয়ে সাধারণ কল্যাণকে অগ্রাধিকার দেওয়া। এমনকি আমাদের ব্যবস্থাও, যা উচ্চাকাক্সক্ষাকে কাজে লাগানোর জন্য ডিজাইন করা হয়েছে, যেখানে মানুষের স্বার্থ স্থানীয় সাংবিধানিক অধিকারের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে, তা নির্ভর করে জনসেবার জন্য বেছে নেওয়া ব্যক্তিদের নির্দিষ্ট মাত্রার নিঃস্বার্থতার ওপর।
সাংবিধানিক পচন তখন ঘটে, যখন এ সবকিছু ক্ষয়প্রাপ্ত হতে শুরু করে। যখন সরকারি কর্মকর্তারা জনকল্যাণের পরিবর্তে তাদের সমর্থক ও আর্থিক পৃষ্ঠপোষকদের ব্যক্তিগত স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেন; যখন প্রতিষ্ঠানগুলো জনসাধারণের সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হয়; যখন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা এমন এক নৈরাজ্যবাদী মনোভাব গ্রহণ করেন, যেখানে জয়লাভই একমাত্র লক্ষ্য, তা রাজনৈতিক ব্যবস্থার সামগ্রিক স্বাস্থ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করলেও এবং যখন রাজনীতিবিদরা ক্ষমতা ব্যবহারের যেকোনো সীমাবদ্ধতা প্রত্যাখ্যান করেন এবং নিজেদের গণতান্ত্রিক বা অন্য যেকোনো ধরনের জবাবদিহিতা থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেন।
এই প্রতিটি গতিশীলতা সাংবিধানিক সরকারের ভিত্তিকে ধ্বংস করে এবং এটি পুরোনো বাড়ির কাঠামোতে পচনের মতো, যা যদি বেড়ে উঠতে এবং পচতে দেওয়া হয়, তবে পুরো কাঠামোটি ধসে পড়বে।
যদি আমরা বলকিন এবং লেভিনসনের নির্ধারিত শ্রেণিবিন্যাস অনুসরণ করি, তবে বলা একটু কঠিন যে যুক্তরাষ্ট্র একটি সাংবিধানিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যদিও ডোনাল্ড ট্রাম্প তার দ্বিতীয় মেয়াদকে নির্বাহী ক্ষমতার চরম দাবি দিয়ে কেন্দ্রবিন্দু করেছেন, তবু তিনি সংবিধানের ঊর্ধ্বে বা বাইরে থাকার দাবি করেননি। তার ধারণা, প্রকৃতপক্ষে তিনি একটি অনুচ্ছেদ ২ পেয়েছেন যেখানে আমি প্রেসিডেন্ট হিসেবে যা চাই তা করতে পারি। (এটি অবশ্যই ভুল, তবে এটি এখনও গুরুত্বপূর্ণ যে হোয়াইট হাউস তার দাবিগুলোকে বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে ভিত্তি স্থাপন করার চেষ্টা করছে।)
সংবিধানও এই মুহূর্তে কোনো রাজনৈতিক, সামাজিক বা অর্থনৈতিক সংকটের কারণে ভেঙে পড়ছে না এবং আমাদের রাজনৈতিক নেতারা তাদের দ্ব›দ্ব সমাধানের জন্য সংবিধানের বাইরে গিয়ে কিছু করছেন না।
বুদ্ধিমান মানুষরা এই বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন যে বর্তমান পরিস্থিতি সাংবিধানিক সংকট কি না। তবে এটা অস্বীকার করা অত্যন্ত কঠিন যে সাংবিধানিক শৃঙ্খলা ভেতর থেকে পচে যাচ্ছে।
আপনি এটি দেখতে পাবেন জনগণের চাহিদা ও সরকারের ক্ষমতা সরবরাহের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ব্যবধানে। আপনি এটি দেখতে পাবেন ওয়াশিংটনে স্বাভাবিক আচরণ হিসেবে প্রচলিত অশ্লীল প্রভাব বিস্তার এবং সরাসরি লুটপাটে। আপনি এটি দেখতে পাবেন উভয় রাজনৈতিক দলের বিপর্যয়কর দুর্বলতায়।
আপনি এটি দেখতে পাবেন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক শ্রেণির ৬ জানুয়ারির ক্যাপিটল হামলার মোকাবিলা করতে ব্যর্থতায়। যা সাংবিধানিক সরকারের জন্য একটি পদ্ধতিগত হুমকি ছিল, অথচ মূল পরিকল্পনাকারী তৃতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট পদে লড়াই করার সুযোগ পেয়েছে। এ ছাড়া প্রেসিডেন্টের মতো ক্ষমতা নিয়ে ইলন মাস্কের ফেডারেল প্রোগ্রাম বাতিলের ঘটনায়, কংগ্রেসের অধিকাংশ সদস্য একটিও শব্দ উচ্চারণ করেনি, এটি সাংবিধানিক পচনের লক্ষণ। কংগ্রেসে রিপাবলিকানরা মাস্কের করুণা ভিক্ষা করার পরিবর্তে তাদের প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হচ্ছে, এটিও সাংবিধানিক পচনের আরেকটি প্রমাণ এবং আমেরিকার বহু প্রতিষ্ঠান ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশগুলোকে আইন হিসেবে বিবেচনা করছে। তার ইচ্ছার প্রতি নতিস্বীকার করছে, যেন তিনি একজন রাজা।
সাংবিধানিক পচন সাংবিধানিক সংকটে রূপ নিতে পারে। তবে প্রতিটি বাড়ি যে ভেতর থেকে পচে গেলে ধসে পড়ে, তা নয়। কিছু বাড়ি বাইরে থেকে ঠিকঠাক দেখালেও বসবাসের অযোগ্য হয়ে যায়। গণতন্ত্রের ক্ষেত্রেও তাই। আমরা হয়তো সাংবিধানিক গণতন্ত্রের বাহ্যিক চেহারা ধরে রাখতে পারি, কিন্তু পচন আমাদের স্বাধীনতা ও মূল্যবোধকে ধ্বংস করে দিচ্ছে, যা এই গণতন্ত্রের প্রকৃত অর্থ বহন করে।
যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যেই এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে শাসকগোষ্ঠী তাদের সবচেয়ে স্পষ্টভাষী এবং দুর্বল সমালোচককে দেশ থেকে নির্বাসিত করার চেষ্টা করছে। একটি বাড়ির ক্ষেত্রে, পচন দূর করার একমাত্র উপায় হলো পচা অংশ সরিয়ে ফেলা। যদি রাজনৈতিক ব্যবস্থা, সাংবিধানিক শৃঙ্খলা, স্বাধীনতা, সমতা এবং মুক্তির আশীর্বাদ নিশ্চিত করার জন্য খুব বেশি পচে যায়, তা হলে হয়তো আমেরিকান গণতন্ত্র থেকে মানুষ কী চায়, তা পুনর্বিবেচনার সময় এসেছে।