ই-পেপার শনিবার ১৫ মার্চ ২০২৫
শনিবার ১৫ মার্চ ২০২৫
ই-পেপার

শনিবার ১৫ মার্চ ২০২৫

বিশেষ চাহিদা কিংবা নির্বিশেষ স্থাপত্য
প্রকাশ: শনিবার, ১৫ মার্চ, ২০২৫, ৩:২৬ এএম আপডেট: ১৫.০৩.২০২৫ ৪:১৮ এএম  (ভিজিট : ৬৩)
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

সমাজে সব মানুষ এক নন। প্রতিটি মানুষের একটি সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের অধিকার থাকলেও ভাগ্যদোষে অনেকেই তা থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকেন। কেউ জন্মগতভাবে কেউ বা দুর্ঘটনার কবলে পড়ে চলচ্ছক্তিহীন হয়ে পড়েন। আবার অনেকেই আছেন যারা অসুস্থতার দরুন একজন সুস্থ-সবল মানুষের মতো করে চলাচলে অক্ষম হয়ে পড়েন। এ ছাড়া আছেন গর্ভবতী ও প্রসূতি নারী, বয়োবৃদ্ধ ও শিশুরা। এসব মানুষের চলাচল, ভবনে প্রবেশ ও বিচরণ, বিবিধ সেবা গ্রহণ ইত্যাদি অনেকটাই দুরূহ, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। অথচ তাদেরও আছে আশপাশের আর পাঁচটা সুস্থ মানুষের মতো বাধাহীনভাবে নিরাপদে চলাফেরার অধিকার। যেকোনো মানবিক রাষ্ট্রের স্থাপনা, পরিবহন ব্যবস্থা ও অন্যান্য সেবা এমনভাবে পরিকল্পনা ও তৈরি করা হয়ে থাকে যেন কোনোভাবেই একজন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তি নিজেকে সমাজের বোঝা মনে না করেন তথা অন্যের ওপর নির্ভর না করে নিজেই চলাফেরা করতে পারেন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে। এই যে নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ, সক্ষম-অক্ষম নির্বিশেষে মানুষের নির্বিঘ্নে চলাচলের ব্যবস্থা-একেই বলা হয় সর্বজনীনগম্যতা।

সব প্রকার স্থাপনা, রাস্তাঘাট, পায়ে চলার পথ, পদচারী পারাপারের স্থান, শৌচাগার, গণপরিবহন, বিনোদনকেন্দ্র-সবখানেই সর্বজনীনগম্যতা নিশ্চিত করা একান্ত আবশ্যক। বিশ্বের উন্নত ও উন্নয়নশীল অনেক দেশেই শারীরিক প্রতিবন্ধী, অসুস্থ ও দুর্বল ব্যক্তিদের সুবিধা ও গমনযোগ্যতার কথা বিবেচনা করে সে অনুযায়ী গণস্থাপনা, গণপরিবহন, সাধারণের চলার পথ থেকে শুরু করে সব স্থানের নকশা করা হয়। সে জন্য সেসব দেশে রয়েছে আলাদা নীতিমালা, আইন ও বিধিমালা। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও প্রতিবন্ধী ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষদের জন্য বর্তমানে কিছু নীতিমালা গ্রহণ করা হয়েছে, যেমন- প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সুরক্ষা আইন ২০১৩, প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা বিধিমালা ২০১৫ ইত্যাদি। এ ছাড়া বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড, ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮-এ সুস্পষ্টভাবে সর্বজনীনগম্যতা বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও বিধির উল্লেখ আছে। 

তবে আমাদের দেশের বাস্তবতায় দেখা যায় সর্বজনীনগম্যতার চিত্রটি খুব সুখকর নয়। আমাদের নগরগুলো তাদের জন্যই তৈরি করা হয় যারা সুস্থ-সবল, যারা যেকোনো ধরনের রাস্তা দিয়ে চলাচল করতে পারে, যেকোনো প্রবেশপথ বা সিঁড়ি দিয়ে ভবনে প্রবেশ করতে পারে। শুধু একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিই নন, একজন অন্তঃসত্ত¡া নারী, একজন মা, শিশু, বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি, অসুস্থ মানুষ সবাই এ নগরে চলার পথে প্রচণ্ড অসহায় বোধ করে। দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সমস্যা ভোগ করতে হলে তার চেয়ে হতাশাজনক আর কী থাকতে পারে? অথচ হওয়ার কথা ছিল পুরোপুরি উল্টোটা। দৃশ্যপট পুরোপুরি বদলে দিতে পারত আইন, নীতিমালা ও বিধিগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মোতাবেক বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ২.৪ শতাংশ মানুষ শারীরিক, মানসিক ইত্যাদি নানারকম প্রতিবন্ধকতার শিকার। সে হিসেবে এ দেশে প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা হলো ৪৭ দশমিক ৪২ লাখ। এ বিপুলসংখ্যক মানুষের জন্য পরিষেবাগুলোর ব্যবস্থা নিতান্তই অপ্রতুল। অথচ তাদের কর্মক্ষমতা ও স্বাভাবিক জীবনযাপন নিশ্চিত করতে প্রতিটা ক্ষেত্রে তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন। 

প্রতিবন্ধী ব্যক্তির নির্বিঘ্ন চলাচল নিশ্চিত করতে ব্যবহার ভেদে স্থাপনার ধরন অনুযায়ী স্থপনার বিভিন্ন অংশের আংশিক বা সম্পূর্ণ মাত্রায় বাধাহীন সর্বজনীনগম্যতা নিশ্চিত করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণস্বরূপ কিছু বিধি উল্লেখ করা যেতে পারে। ‘অ্যাপার্টমেন্ট বা ফ্ল্যাটবাড়ি’ জাতীয় ‘আবাসিক’ স্থাপনায়, পাবলিক ফুটপাথ থেকে প্রতিটি আবাসিক ইউনিট পর্যন্ত চলাচলের পথ, পার্কিং থেকে প্রতিটি আবাসিক ইউনিট পর্যন্ত চলাচলের পথ, পার্কিং, স্থাপনার প্রতিটি সামাজিক মিলনস্থল এবং প্রতিটি আবাসিক ইউনিটে অন্তত একটি টয়লেট সর্বজনীনগম্য হতে হবে।

এভাবে মেস, বোর্ডিং, ডরমেটরি, আবাসিক হোটেল, শিক্ষাকেন্দ্র, হাসপাতাল ও অন্যান্য সেবাকেন্দ্র, অফিস-আদালত, বিনোদনকেন্দ্র ইত্যাদি সব স্থাপনার গণব্যবহার উপযোগী সব অংশ, ফুটপাথ, স্থাপনার ভেতরে ও বাইরে (স্থাপনা থেকে পার্কিং পর্যন্ত) চলাচলের পথ এবং পার্কিং সর্বজনীনগম্য হতে হবে। এ ছাড়া ‘অপরিহার্য সেবা’ জাতীয় ব্যবসায়িক স্থাপনা, টার্মিনাল ইত্যাদির ক্ষেত্রেও সর্বজনীনগম্যতার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। ধরণ ও ব্যবহারের প্রকারভেদে সব স্থাপনার বিএনবিসিতে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও বিধানের উল্লেখ করা আছে। 

এ ছাড়া সমাবেশস্থলে প্রতি ১৫০ বা তার কমসংখ্যক আসনের মধ্যে অন্তত একটি আসনের স্থান হুইল চেয়ার ব্যবহারকারীর জন্য উন্মুক্ত থাকতে হবে। স্থায়ী আসন আছে এমন খাবারের স্থানগুলোতে প্রতি ১০টি আসনের মধ্যে ন্যূনতম একটি আসন সংরক্ষিত রাখতে হবে একজন হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী ব্যক্তির জন্য। উপরন্তু সব সর্বজনীন স্থাপনায় প্রতি ১০০ টয়লেটের মধ্যে ন্যূনতম ৫টি টয়লেট হতে হবে সর্বজনীনগম্য এবং স্থাপনার প্রতি তলায় অন্তত একটি সর্বজনীন টয়লেট নিশ্চিত করতে হবে। 

একজন সুস্থ মানুষ টানা যতক্ষণ হাঁটতে পারে একজন অন্তঃসত্ত্বা নারী, বৃদ্ধ ব্যক্তি, সন্তান কোলে নিয়ে চলাফেরা করছেন এমন ব্যক্তি। সর্বোপরি হুইল চেয়ারে চলাফেরা করা মানুষ কি পারবেন ততক্ষণ হাঁটতে? অবশ্যই না। সে জন্যই চলার পথের একটি নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যকে বলা হয় সর্বজনীন, যা ৩০ মিটার বা ৯৮ ফিটের অধিক নয় এবং এর ন্যূনতম প্রস্থ হতে হবে ৪ ফিট। ভবন বা পার্কিংয়ের প্রবেশমুখে থাকতে হবে র‌্যাম্প। সে র‌্যাম্পেরও একটি সর্বজনীন পরিমাপ আছে। অর্থাৎ তা এমনভাবে ঢালু করতে হবে যাতে করে একজন হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী বা ক্রাচ ব্যবহারকারী বিনা বাধায় ওপর-নিচ ওঠানামা করতে পারেন। র‌্যাম্পের তল সর্বোচ্চ ১ : ১২ অনুপাতে সুষম ঢালবিশিষ্ট হতে হবে। গণপরিবহনের ক্ষেত্রেও আছে নির্দেশনা। গণপরিবহনের দরজার প্রস্থ ও উচ্চতা একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির গমনযোগ্যতাকে নিশ্চিত করতে হবে। 

মোটকথা একজন ব্যক্তির লিঙ্গ, বয়স ও শারীরিক সক্ষমতা নির্বিশেষে তার চলাচল, ওঠা, বসা, খাওয়া, যাতায়াত, বিনোদন ও স্যানিটেশনে যেন কোনো প্রকার প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি না হয় সে লক্ষ্যে কিছু সুনির্দিষ্ট নীতিমালা বিদ্যমান আছে। আছে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, নারী ও শিশু এবং বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তিদের কল্যাণার্থে আইন ও নীতিমালাও। কিন্তু এতদসত্তে¡ও আমরা কি সর্বজনীনগম্যতার সেই কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হতে পেরেছি? আমাদের স্থাপনাগুলোতে, চলার পথে, গণপরিবহনে আমরা প্রতিনিয়ত দেখে আসছি একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, একজন নারী, অন্তঃসত্ত্বা নারী, শিশু, বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তির দুর্দশা। 

রাষ্ট্র পারছে না তাদের সহজগম্যতা, সমাজের সব ক্ষেত্রে তাদের সর্বজনীন অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে। আমাদের চলার পথের কথাই যদি ধরি, আমাদের ফুটপাথগুলো বেদখল হয়ে থাকে হকারদের হাতে অথবা নির্মাণাধীন ভবনের নির্মাণসামগ্রী রাখার কাজে। সেখানে নেই গণমানুষের হাঁটার স্থান। রাস্তা পারাপারের ক্ষেত্রে আমাদের কর্তৃপক্ষের প্রথম পছন্দ হলো ফুটওভার ব্রিজ। পঁচিশ থেকে ত্রিশ ফুট উঁচু একটি ফুটওভার ব্রিজে ওঠা একজন সুস্থ মানুষের জন্যই যেখানে কষ্টকর সেখানে একজন বৃদ্ধ ব্যক্তি কি পারবেন এর মাধ্যমে রাস্তা পার হতে? যদি পেরেও থাকেন তবে তার কষ্ট, একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীর কষ্ট কি ভেবে দেখা হয়েছে কখনো? রাস্তা পারাপারের সবচেয়ে ভালো ব্যবস্থা হলো জেব্রা ক্রসিং এবং সেখানেও থাকতে হবে সর্বজনীনগম্যতা যেন একজন হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী বা ক্রাচ ব্যবহারকারী অথবা অসুস্থ ব্যক্তি নির্বিঘ্ন গমন করতে পারেন। আমাদের স্থাপনাগুলোর বেশিরভাগেরই মূল প্রবেশপথে থাকে সিঁড়ি এবং কোনো ধরনের র‌্যাম্প থাকে না। তা হলে কীভাবে একজন ব্যক্তি হুইল চেয়ার নিয়ে সেখানে প্রবেশ করতে সক্ষম হবেন? 
একটি রাষ্ট্রকে শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করলেই চলবে না, তাকে হতে হবে মানবিক। 

সমাজের সব মানুষকে এক কাতারে রেখে গ্রহণ করতে হবে নীতিমালা, প্রণয়ন করতে হবে আইন। আমাদের নীতিনির্ধাকরা এখন অনেকটাই সচেতন। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে বাংলাদেশের এ দীর্ঘ যাত্রায় আমরা দেখতে পাই নীতিমালা, বিধি-বিধান ও আইনকানুনের দিক থেকেও বাংলাদেশ যথেষ্ট আধুনিকতার পরিচয় রেখে চলছে। এর সঙ্গে সংবেদনশীলতারও সংযোজন প্রয়োজন। প্রয়োজন নীতিমালার সঠিক ও যুগোপযোগী বাস্তবায়ন, নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়নের, যা সর্বজনীনগম্যতার সঠিক ও পুঙ্খানুপুঙ্খ চিত্রের একটা বাস্তবরূপ সামনে নিয়ে আসবে। একটি সমাজ তখনই সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে যখন ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, নারী-পুরুষ-তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তি, শিশু-তরুণ-বৃদ্ধ, সক্ষম, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ও প্রতিবন্ধী সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। সর্বজনীনগম্যতা শুধু কোড, নীতিমালা বা আইনের বিষয়বস্তু নয়, শুধুই কাগজকলমে থাকার বিষয়ও নয়, এর চর্চা প্রয়োজন। একজন স্থপতি, পরিকল্পনাবিদ ও প্রকৌশলীকে সব স্থাপনা, সব পরিকল্পনার ক্ষেত্রেই তা বিবেচনায় রেখে কাজ করতে হবে। প্রশাসনকে হতে হবে কঠোর ও দক্ষ। সবার সমান উপস্থিতি, সর্বজনীন ও স্বতঃস্ফ‚র্ত অংশগ্রহণ সংবলিত তেমন একটি বাংলাদেশের প্রত্যাশা আমাদের সবার।




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ। নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।
ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close