
মসজিদে তারাবি নামাজ আদায় করছেন মুসল্লিরা। ছবি: ডেইলি সাবাহ
আজকের তারাবিতে পবিত্র কোরআনের ১৭তম পারা পড়া হবে। সুরা হিসেবে সুরা আম্বিয়া ও সুরা হজ তেলাওয়াত। সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে চিন্তা, নবী-রাসুল পাঠানোর কারণ, দুনিয়ার জীবন ক্ষণস্থায়ী, মানুষ সৃষ্টির উপকরণ, আল্লাহ মুমিনের বন্ধু, কিয়ামতের ভয়াবহতা, হজ, পুনরুত্থান, কোরবানি, জিহাদ, মৃত্যু, মুশরিকদের আপত্তির জবাব, মুমিনের বৈশিষ্ট্য, ইয়াজুজ-মাজুজের ফিতনা, জান্নাত-জাহান্নাম, আল্লাহর ক্ষমতা ও কুদরত, নামাজ, জাকাত, শিরক, মূর্তিপূজা ইত্যাদি বিষয়ের আলোচনা রয়েছে আজকের তারাবিতে।
নবিদের নামে সুরার নাম
১১২ আয়াত বিশিষ্ট সুরা আম্বিয়া মক্কায় অবতীর্ণ। এটি কোরআনের ২১তম সুরা। আরবি ‘নাবিইয়ুন’ শব্দের বহুবচন আম্বিয়া। অর্থ নবি বা আল্লাহর বিশেষ বার্তাবাহক। ১৮ জন নবীর আলোচনা থাকায় এর নাম রাখা হয়েছে সুরা আম্বিয়া। ১৮ জন নবী হলেন মুসা (আ.), হারুন (আ.), ইবরাহিম (আ.), লুত (আ.), ইসহাক (আ.), ইয়াকুব (আ.), নুহ (আ.), দাউদ (আ.), সোলায়মান (আ.), আইয়ুব (আ.), ইসমাইল (আ.), ইদরিস (আ.), জুলকিফাল (আ.), ইউনুস (আ.), জাকারিয়া (আ.), ইয়াহইয়া (আ.), ইসা (আ.) এবং মুহাম্মাদ (সা.)।
মানুষ বড় উদাসীন
আজকের তারাবির প্রথম রাকাতের প্রথম আয়াতে আল্লাহ মানুষকে তাদের উদাসীনতার ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। আসন্ন হিসাব-নিকাসের কথা বলেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘মানুষের হিসাব-নিকাশের সময় আসন্ন কিন্তু ওরা উদাসীনতায় মুখ ফিরিয়ে রয়েছে।’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত : ১)। মানুষের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জীবনে কিয়ামত বা শেষ অধ্যায় নেমে আসে। প্রত্যেক মানুষের মৃত্যুই তার জীবনের কিয়ামত। মানুষের যত দীর্ঘায়ু হোক, তার মৃত্যু দূরে নয়। মৃত্যুর পরই মানুষের হিসাব শুরু হয়ে যায়। অথচ মানুষ এ ব্যাপারে বড় উদাসীন। (তাফসিরে মাআরেফুল কোরআন, মুফতি মুহাম্মাদ শফি, অনুবাদ : মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, পৃষ্ঠা : ৮৭১)
আল্লাহ পছন্দ করেছিলেন যে রায়
সুরা আম্বিয়ার ৭৮ থেকে ৮২ নম্বর আয়াতে দাউদ (আ.) ও সুলাইমান (আ.)-এর কথা এবং একটি রায়ের বর্ণনা রয়েছে। যে রায় আল্লাহর পছন্দ হয়েছিল। আল্লাহর বিশেষ নবী ছিলেন দাউদ (আ.)। প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। খুব সুর করে আল্লাহর কিতাব জাবুর পড়তেন। বর্ম বানাতে জানতেন তিনি। পাহাড় ও পাখি তাঁর কথা শুনত। একবার দুই লোক বিচার নিয়ে এল তাঁর কাছে। একজন ছাগলের পাল ও অন্যজন শস্যখেতের মালিক। শস্যখেতের মালিক বলল, ‘তার ছাগলগুলো রাতে আমার শস্যখেতে চড়াও হয়ে সম্পূর্ণ ফসল নষ্ট করে দিয়েছে। কিছুই অবশিষ্ট নেই আর।’ ছাগলগুলোর মালিক তা স্বীকার করল। দাউদ (আ.) রায় দিলেন, ছাগলগুলো শস্যখেতের মালিককে দেওয়া হোক। তারা মেনে নিল। তারা দাউদ (আ.)-এর আদালত থেকে বের হওয়ার সময় দরজায় দেখা হয় দাউদপুত্র সুলায়মান (আ.)-এর সঙ্গে। তিনি রায় সম্পর্কে অবগত হলেন। সুলায়মান (আ.) বললেন, ‘আমি অন্যভাবে রায় করতাম। সেটি উভয়ের জন্য উপকারী হতো।’ (তাফসিরে মাআরিফুল কোরআন, মাওলানা মুহাম্মাদ ইদরিস কান্ধলভি, অনুবাদ : আব্দুল্লাহ আল ফারুক, খণ্ড : ৫, পৃষ্ঠা : ৪৫২)
পিতাকে তিনি এ কথা জানালেন। পিতা উপকারী রায় জানতে চাইলেন। সুলায়মান (আ.)-বললেন, ‘আপনি ছাগলের পাল শস্যখেতের মালিককে দিন। সে এগুলোর দুধ, পশম ইত্যাদি দিয়ে উপকারী হোক। খেত দিন ছাগলের মালিককে। সে তাতে চাষাবাদ করে শস্য উৎপন্ন করবে। যখন খেত ছাগলে নষ্ট করার আগের অবস্থায় পৌঁছে যাবে, তখন খেতের মালিককে খেত এবং ছাগলের মালিককে ছাগল দিয়ে দেবে।’ দাউদ (আ.) এ রায় কার্যকর করেন।
রহমতের নবি মুহাম্মাদ (সা.) মুহাম্মাদ (সা.)-কে সমগ্র জগতের জন্য রহমত হিসেবে পাঠিয়েছেন আল্লাহ। তিনি শান্তি-সম্প্রীতি ও সুখের বাতাস বইয়ে দিয়েছেন পৃথিবীর ঘরে ঘরে। তাঁর আগে কেউ ব্যাপক-বিপুল রহমত নিয়ে পৃথিবীতে আগমন করেননি। আল্লাহ বলেন, ‘হে নবি, আমি তোমাকে সারা বিশ্বের জন্য রহমত হিসেবে পাঠিয়েছি।’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত : ১০৭)। তিনি শত্রুকেও ভালোবাসতেন। তিনি কারও জন্য বদদোয়া করতেন না।
কিয়ামতের ভয়াবতামদিনায় অবতীর্ণ সুরা হজ কোরআনের ২২তম সুরা। ৭৮ আয়াতবিশিষ্ট এ সুরায় হজ-সম্পর্কিত বিধানের আলোচনা থাকায় এর নাম রাখা হয়েছে সুরা হজ। সুরার শুরুতে আল্লাহকে ভয় করার আদেশ দিয়ে কিয়ামতের ভয়াবহতা বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘হে মানুষ, তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো, কিয়ামাতের কম্পন এক ভয়ানক জিনিস। সেদিন তুমি দেখবে প্রতিটি দুগ্ধদায়িনী ভুলে যাবে তার দুগ্ধপোষ্য শিশু, আর প্রত্যেক গর্ভবতী গর্ভপাত করে ফেলবে, আর মানুষকে দেখবে মাতাল, যদিও তারা প্রকৃতপক্ষে মাতাল নয়, কিন্তু আল্লাহর শাস্তি বড়ই কঠিন (যার কারণে তাদের ওই অবস্থা ঘটবে)।’ (সুরা হজ, আয়াত : ১-২)
কবুল হজে নিষ্পাপ মানুষআল্লাহর নির্দেশে ইবরাহিম (আ.) ছেলে ইসমাইল (আ.)-কে নিয়ে কাবাঘর নির্মাণ করলেন। কাবাঘর নির্মাণ হলে আল্লাহ বলেন, ‘আর মানুষের মধ্যে হজের ঘোষণা দাও, তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে, আর সব (পথক্লান্ত) শীর্ণ উটের পিঠে, বহু দূরের গভীর পর্বতসংকুল পথ বেয়ে।’ (সুরা হজ, আয়াত : ২৭)
হজ ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ। আর্থিক ও শারীরিকভাবে সমর্থ পুরুষ ও নারীর ওপর হজ ফরজ। হজের নির্দিষ্ট সময় হলো ৮ জিলহজ থেকে ১২ জিলহজ পর্যন্ত
—পাঁচ দিন। এই পাঁচ দিনই মূলত হজ পালন করা হয়। মক্কা শরিফে কাবা, সাফা-মারওয়া, মিনা, আরাফা ও মুজদালিফা হলো হজের মূল জায়গা।
গ্রহণযোগ্য হজের বিনিময়ে জান্নাত মেলে। অভাব-অনটন দূর হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি হজ করল এবং হজ অবস্থায় কথা ও কাজে পাপ থেকে বিরত রইল, সে হজ শেষে সেই দিনের মতো নিষ্পাপ হয়ে ঘরে ফিরবে, যেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছিলেন।’ (বুখারি, হাদিস : ১৫২১)
আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় কোরবানি জিলহজ মাসের ১০ তারিখ সকাল থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্তের আগে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট পশু জবাই করা হলো কোরবানি। কোরবানি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। সামর্থ্যবান নারী-পুরুষের ওপর ওয়াজিব। সব নবীর শরিয়তে কোরবানি ছিল। তবে পদ্ধতি ছিল ভিন্ন রকম। মুহাম্মাদ (সা.) মদিনায় ১০ বছর বেঁচে ছিলেন, প্রতিবছরই তিনি কোরবানি করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘সব সম্প্রদায়ের জন্য আমি কোরবানির বিধান দিয়েছি, তিনি (আল্লাহ) তাদের জীবনোপকরণস্বরূপ যেসব চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছেন, সেগুলোর ওপর যেন তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।’ (সুরা হজ, আয়াত : ৩৪)। কোরবানি করতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। এখানে গোশত খাওয়া কিংবা লোক দেখানোর নিয়ত থাকলে কোরবানি হবে না। আল্লাহ বলেন, ‘কোরবানির গোশত বা রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না, আল্লাহর কাছে পৌঁছায় শুধু তোমাদের নিষ্ঠাপূর্ণ আল্লাহ সচেতনতা।’ (সুরা হজ, আয়াত : ৩৭)
লেখক: আলেম ও সাংবাদিক