ই-পেপার শুক্রবার ১৪ মার্চ ২০২৫
শুক্রবার ১৪ মার্চ ২০২৫
ই-পেপার

শুক্রবার ১৪ মার্চ ২০২৫

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতেও রোজার গুরুত্ব অপরিসীম
প্রকাশ: শুক্রবার, ১৪ মার্চ, ২০২৫, ৪:১৫ পিএম  (ভিজিট : ১২৬)
প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

মুসলমানদের বড় পর্ব রোজা। হিজরি সাল অনুযায়ী নবম মাস। রোজার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নিয়ে লিখলে পাঠক সমাজ অবহিত হবেন এবং আমিও তৃপ্ত হব। বিভিন্ন ধর্মে রোজার আদলে নানা নামে থাকলেও ইসলাম ধর্মে রমজানের রোজার আনুষ্ঠানিকতা, গুরুত্ব ও মহত্ত্ব কত যে বড়, তা বলে শেষ করা যাবে না। যদিও এই ইসলাম ধর্মেই অন্যান্য রোজার মধ্যে আশুরার রোজা, শাবান মাসের রোজা, শাওয়াল মাসের রোজা, জিলহজ মাসের রোজা, সাপ্তাহিক রোজা, মানতের রোজা, কাজা রোজা, কাফফারার রোজা ইত্যাদি প্রণিধানযোগ্য।

মূলত সুবহে সাদেক থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সব ধরনের পানাহার, পাপাচার, কামাচার এবং সেই সঙ্গে যাবতীয় ভোগবিলাস থেকেও বিরত থাকার নাম রোজা। মূল কুরআনীয় আরবিতে ইসলামী উপবাসের নাম সাওম, বহুবচনে সিয়াম, যার শাব্দিক অর্থ হচ্ছে সংযম বা আত্মনিয়ন্ত্রণ বা বিরত থাকা। এদিকে রোজা শব্দটি ফারসি শব্দ, এসেছে আদি-ইরানীয় ধাতুমূল রোওচাকাহ থেকে, যার অর্থ উপবাস। এটি আবার এসেছে ইন্দো-ইরানীয় ধাতুমূল রোচস থেকে, যার অর্থ দিন বা আলো। ফারসি ভাষায় সিয়ামের প্রতিশব্দ হিসেবে রোজা ব্যবহৃত হয়, যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য ভাষার মতো কালক্রমে বাংলা ভাষাতেও শত শত বছর আগে থেকে এখন পর্যন্ত সাওম বা সিয়াম নামক ইসলামী উপবাস বোঝানোর জন্য সমধিকভাবে ‘রোজা’ শব্দটি বহুল ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আর সূর্যাস্তের সময় মুসলমানরা আনুষ্ঠানিকভাবে ইফতারির মাধ্যমের রোজা ভঙ্গ করেন। পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, ‘যারা ঈমান এনেছ, তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল; যাতে করে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করতে পারো (সুরা বাকারা : ১৮৩)। হজরত আদম (আ.) নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার পর তওবা করেছিলেন; তখন ৩০ দিন পর্যন্ত তাঁর তওবা কবুল হয়নি। তবে ৩০ দিন পর তাঁর তওবা কবুল হয়। তারপর তাঁর সন্তানদের ওপরে ৩০টি রোজা ফরজ করে দেওয়া হয়। এদিকে নূহ (আ.)-এর যুগেও রোজা ছিল। কারণ, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন; হযরত নূহ (আ.) ১ শাওয়াল ও ১০ জিলহজ ছাড়া সারা বছর রোজা রাখতেন। তা ছাড়া হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর যুগে ৩০টি রোজা ছিল বলে কেউ কেউ লিখেছেন। এদিকে হযরত দাউদ (আ.) এর যুগেও রোজার প্রচলন ছিল। 

হাদিসে বলা হয়েছে যে, আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় হযরত দাউদ (আ.)-এর রোজা। তিনি একদিন রোজা রাখতেন এবং একদিন বিনা রোজায় থাকতেন। আরববাসীরাও ইসলামের আগে রোজা সম্পর্কে কম-বেশি ওয়াকিফহাল ছিল। আর মক্কার কুরাইশরা অন্ধকার যুগে আশুরার (অর্থাৎ ১০ মহররম) দিনে রোজা রাখত এবং এই দিনে কাবার ওপর নতুন গেলাফ চড়ানো হতো। তা ছাড়া মদিনায় বসবাসকারী ইহুদিরাও পৃথকভাবে আশুরা উৎসব পালন করত। অর্থাৎ ইহুদিরা নিজেদের গণনানুসারে সপ্তম মাসের দশম দিনে রোজা রাখত।

রোজা রাখার উপকারিতা, গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে পবিত্র কুরআন ও হাদিসে কি বলা হয়েছে, তা আমরা সবাই কম-বেশি জানি। রোজা শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নয়। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতেও রোজার উপকারিতা অপরিসীম।

১. মূলত রোজা থাকা অবস্থায় গড়ে কমপক্ষে ১৫ ঘণ্টা যাবতীয় খানাপিনা বন্ধ থাকে। এ সময় পাকস্থলী, অন্ত্র-নালী, যকৃত, হৃদপিণ্ডসহ অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিশ্রাম পায়। তখন এসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিজেদের পুনর্গঠনে নিয়োজিত হতে পারে। অন্যদিকে দেহে যেসব চর্বি জমে শরীরের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়; সেগুলো রোজার সময় দেহের প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটানোর জন্য সমন্বয় করে। স্বাস্থ্য বিজ্ঞান মতে উপবাসকালে শরীরের মধ্যকার প্রোটিন, চর্বি, শর্করা জাতীয় পদার্থগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে হজম হয় এবং এর ফলশ্রুতিতে গুরুত্বপূর্ণ কোষগুলোর পুষ্টি বিধান হয়; ২. উপবাসের মাধ্যমে লিভারে রক্ত সঞ্চালন দ্রুত হয়, ফলে ত্বকের নিচে সঞ্চিত চর্বি, পেশির প্রোটিন, গ্রন্থি এবং লিভারে কোষগুলো আন্দোলিত হয়। এদিকে অভ্যন্তরীণ দেহ যন্ত্রগুলোর সংরক্ষণ এবং হৃৎপিণ্ডের নিরাপত্তার জন্য অন্য দেহাংশগুলোর বিক্রিয়া বন্ধ রাখে। শুধু তাই নয়, আরাম-আয়েশের জন্য মানুষের শরীরের যে ক্ষতি হয়, রোজা তা পূরণ করে দেয়। ৩. ‘যারা আলস্য, গোঁড়ামি এবং অতিভোজনের কারণে নিজেদের সংরক্ষিত জীবনী শক্তিকে ভারাক্রান্ত করে ধীরে ধীরে আত্মহত্যার দিকে এগিয়ে যায়, রোজা তাদের সে বিপদ থেকে রক্ষা করে; ৪. ফুসফুসের কাশি, তীব্র কাশি, সর্দি এবং ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো রোগ রোজার কারণেই নিরাময় হয়; ৫. রোজাব্রত পালনের কারণে মস্তিষ্ক এবং স্নায়ুতন্ত্র সর্বাধিক উজ্জীবিত হয়; ৬. রোজা হলো পরম হিতৈষী ওষুধ বিশেষ।


কারণ রোজা পালনের ফলে বাতরোগ, বহুমূত্র, অজীর্ণ, হৃদরোগ ও রক্তচাপজনিত ব্যাধিতে মানুষ তুলনামূলক কম আক্রান্ত হয়; ৭. গবেষণায় দেখা গেছে যে, পেপটিক আলসারের রোগীরা রোজা রাখলে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন এবং একই সঙ্গে হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও হাঁপানি রোগীদের জন্যও রোজা উপকারি; ৮. ডাক্তারি বিজ্ঞান মতে, রোজার ফলে মস্তিষ্কের সেরিবেলাম ও লিমরিক সিস্টেমের ওপর নিয়ন্ত্রণ বাড়ার কারণে মনের অশান্তি ও দুশ্চিন্তা দূর হয়, যা উচ্চ রক্তচাপের জন্য মঙ্গলজনক। 

তা ছাড়া বহুমূত্র রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে রোজা খুব উপকারি। এ ক্ষেত্রে ডাক্তারি পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, একাধারে ১৫ দিন রোজা রাখলে বহুমূত্র রোগের ক্ষেত্রে অত্যন্ত উপকার হয়; ৯. কিডনি সমস্যায় আক্রান্ত রোগীরা রোজা রাখলে, এ সমস্যা আরও বেড়ে যাবে ভেবে রোজা রাখতে চান না। অথচ আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা জোর দিয়ে উল্লেখ করেছেন যে, রোজা রাখলে কিডনিতে সঞ্চিত পাথর কণা ও চুন স্বয়ংক্রিয়ভাবে দূরীভূত হয় এবং ১০. স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীদের মতে রোজা রাখার বড় উপকারিতা হলো যে, সারা বছর অতিভোজ, অখাদ্য, কুখাদ্য এবং ভেজাল খাদ্য খাওয়ার ফলে আমাদের শরীরে যে জৈব বিষ জমা হয়, তা দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তাই এক মাস রোজা পালনের ফলে তা সহজেই দূরীভূত হয়ে যায়।

মেডিকেল সাইন্সের দৃষ্টিকোণ থেকে রোজাকে ঘিরে ইতিবাচক কথা বললাম, কিন্তু রোজা কীভাবে উপকার করে, সেই সূক্ষ্ম বিষয় আরও বুঝিয়ে বলার জন্য সচেষ্ট হয়েছি। ইদানীং ডাক্তারি বিদ্যায় অটোফ্যাজি বলে একটি শব্দ শোনা যাচ্ছে। বস্তুত অটোফ্যাজি গ্রিক শব্দ। এখানে অটো এর অর্থ নিজ এবং ফ্যাজি হলো খাওয়া। পুরো শব্দটিতে এককথায় দাঁড়ায় যে নিজে নিজেকে খাওয়া তথা আত্মভক্ষণ। এ ব্যাপারে উল্লেখ্য, এই অটোফ্যাজি শব্দ উনিশ শতকের মাঝামাঝি বিদ্যমান ছিল এবং ব্যবহৃতও হতো। অবশ্য বেলজিয়ান জৈব রসায়নবিদ ক্রিশ্চিয়ান ডিভুত লাইসোসোমের (এক ধরনের কোষীয় অঙ্গাণু) কার্যাবলি আবিষ্কারের ভিত্তিতে উদঘাটন করেছিলেন এবং ইনিই অটোফ্যাজি নামকরণ করেছিলেন। এদিকে নব্বইয়ের দশকে ঈষ্টে (এক কোষি ছত্রাক) অটোফ্যাজি সম্পর্কিত জিনের শনাক্তকরণ গবেষকদের অটোফ্যাজির প্রক্রিয়াগুলো বের করার অনুমতি দেওয়া হয়, যার ফলশ্রুতিতে অবশেষে ২০১৬ সালে জাপানি গবেষক ইয়েশিনোরি ওহসুমি নোবেল পুরস্কার পান। 

কোষগুলো যখন খাবার না পায়, তখন নিজকে নিজে খায়, যা মেডিকেল সাইন্স অটোফ্যাজি শব্দের আড়ালে এই কর্মকাণ্ডটি অভিহিত করেছে। এ প্রেক্ষাপটে একটি উদাহরণের সাহায্য নিচ্ছি। একটি ঘরের অতি কাছে যেমন ডাস্টবিন থাকে অথবা আমরা যে কম্পিউটার ব্যবহার করি, সেখানে যেমন রিসাইকেল বিন থাকে; ঠিক তেমনি আমাদের দেহের বিলিয়ন বিলিয়ন কোষের মাঝেও একটি করে ডাস্টবিন রয়েছে। 

সূত্র ধরে সঙ্গত কারণেই দৈহিক লাগাতার কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতায় সেখানে ময়লা বা আবর্জনা জমে যায়। অথচ কোষগুলো চলমান কাজে ব্যস্ত থাকায় ডাস্টবিন পরিষ্কারের সময় ও ফুরসত পায় না। এটি সত্য যে, কোষগুলো যদি ডাস্টবিনগুলো পরিষ্কার করতে না পারে, তা হলে প্রকারান্তরে কোষগুলো একসময় নিষ্ক্রিয় হয়ে শরীরে ক্যানসার ও ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি করে। 
কিন্তু মানুষ উপবাস বা রোজা থাকলে কোষগুলোর তেমন কাজ থাকে না, অনেকটা বেকারের পর্যায়ে চলে যায়। কিন্তু প্রকৃতিগত কারণে কোষগুলো অলস থাকতে পারে না। এরা কাজ করবেই। তখন এই কাজের আদলে জমে থাকা ময়লা ও আবর্জনা পরিষ্কার করতে শুরু করে থাকে। এখানে যে কথা উঠে আসে, তা হলো আবর্জনা যে পরিষ্কার করে, তা ফেলবে কোথায়? তেমন জায়গা তো নেই। তাই কোষগুলো নিজেদের আবর্জনা, তারা নিজেরাই খেয়ে ফেলে। আর মেডিকেল সাইন্সে এই প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি অটোফ্যাজি বা আত্মভক্ষণ বলে অভিহিত।

রোজাকে ঘিরে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার কথা বলেছিলাম; আর সেটিই ওপরে সহজ ভাষায় তুলে ধরেছি। পরিশেষে এই বলে ইতি টানছি যে, রোজা কেবল ধর্মীয় দিক দিয়ে উচ্চ মাত্রায় অবস্থান নিয়ে আছে, তা কেবল নয়। বৈজ্ঞানিক প্যারামিটারের আওতায় এর গুরুত্ব খাটো করে দেখার অবকাশ নেই।

লেখক: সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ। নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।
ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close