ই-পেপার শুক্রবার ১৪ মার্চ ২০২৫
শুক্রবার ১৪ মার্চ ২০২৫
ই-পেপার

শুক্রবার ১৪ মার্চ ২০২৫

কবির বসন্ত রোদন
প্রকাশ: শুক্রবার, ১৪ মার্চ, ২০২৫, ৩:৫০ পিএম  (ভিজিট : ৯৮)
কৃষ্ণচূড়ার ডালে বসে আছে একটি পাখি। ছবি: সংগৃহীত

কৃষ্ণচূড়ার ডালে বসে আছে একটি পাখি। ছবি: সংগৃহীত

কবিতার জন্ম যেমন বার্তা দিয়ে আসে না, কবির জন্মই তাই; তবু কবির জন্মকাল বসন্তে। বসন্তকে চিত্রিত করতে রবীন্দ্রনাথ যেমন লেখেন—‘মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে/ মধুর মলয়সমীরে মধুর মিলন রটাতে...’, তেমনি লেখেন, ‘রোদনভরা এ বসন্ত সখী, কখনো আসেনি বুঝি আগে...’। ঋতুচক্রে বঙ্গাব্দের শেষপ্রান্তে আসে বসন্তকাল। বসন্তকে ‘ঋতুরাজ’ বলা হয় কেন? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছি অনেক। কিন্তু তার মনোপূত উত্তর কি পেয়েছি কারও কাছে? স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, যিনি নানা বৈচিত্র্যে চিত্রিত করেছেন বসন্তকে তার অবিনাশী গানে, কথাসাহিত্যে ও কবিতায়; তাতেই কি ‘ঋতুরাজ’ প্রশ্নের মীমাংসায় পৌঁছাতে পেরেছি?

বসন্ত ঋতুতে আমাদের প্রকৃতিতে অনেক ফুল ফোটে; বিশেষত শিমুল, পলাশ, অশোক এসব উজ্জ্বলবর্ণ ফুল আমাদের প্রকৃতিকে রাঙিয়ে দেয়। বনে বনে সবুজের সমারোহে আবীরবরণ পলাশ, পথের দুপাশে রক্তবর্ণ শিমুল আর অশোককাননে বর্ণিল ফুলের উপস্থিতি রাঙিয়ে দিয়ে যায় সংবেদনশীল সৃজনপ্রয়াসী মানুষের অন্তর। ভাঁটফুল, বনটগরের উজ্জ্বল উপস্থিতি গাঢ় সবুজ গ্রাম বাংলাকে তারকাখচিত করে তোলে অনিন্দ্য সৌন্দর্যে। ফুলের এই সমারোহই কি বসন্তকে ‘ঋতুরাজ’ অভিধায় অভিসিক্ত করেছে? বসন্তের তুলনায় আমাদের অন্যান্য ঋতুতেও কম ফুল ফোটে না, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছুটা বেশিই ফোটে; তবে অন্য ঋতুর ফুলেরা বসন্তফুলের মতো ততটা প্রগাঢ়-উজ্জ্বল নয়। 

কিন্তু কেবল ফুলবাহারে বসন্তকে ঋতুরাজ ডাকাকে কিছুতেই যৌক্তিক মনে হয়নি; আমি বরং বসন্তের স্বাতন্ত্র্য খুঁজেছি বসন্তরোদে, বসন্তের নিজস্বতা খুঁজেছি বসন্তবাতাসে, বিষণ্ণ-সুগন্ধ আমের বোলে, প্রকৃতির আনমনা চারিত্র্যে, নিজস্বতা খুঁজেছি ‘মধুর মিলনে’ আর ‘রোদনে’।

রবীন্দ্রনাথ বসন্তকে আবাহন করে লিখেছেন, এস’ এস’ বসন্ত, ধরাতলে।/ আন’ মুহু মুহু নব তান, আন’ নব প্রাণ নব গান/ আন’ গন্ধমদভরে অলস সমীরণ।/ আন’ বিশ্বের অন্তরে নিবিড় চেতনা।/ আন’ নব উল্লাসহিল্লোল।/ আন’ আন’ আনন্দছন্দের হিন্দোলা ধরাতলে।/ ভাঙ’ ভাঙ’ বন্ধনশৃঙ্খল।/ আন’ আন’ উদ্দীপ্ত প্রাণের বেদনা ধরাতলে।/ এস’ থরথরকম্পিত মর্মমুখরিত নবপল্লবপুলকিত/ ফুল-আকুল মালতীবল্লিবিতানে—সুখছায়ে, মধুবায়ে।/ এস’ বিকশিত উন্মুখ, এস’ চির-উৎসুক নন্দনপথচিরযাত্রী।/.......এস’ নগরে প্রান্তরে বনে।/ এস’ কর্মে বচনে মনে। এস’ এস’।/ এস’ মঞ্জরীগুঞ্জর চরণে।/ এস’ গীতমুখর কলকণ্ঠে।/ এস’ মঞ্জুল মল্লিকামাল্যে।/ এস’ কোমল কিশলয়বসনে।/ এস’ সুন্দর, যৌবনবেগে।/ এস’ দৃপ্ত বীর, নবতেজে।/ ওহে দুর্মদ, কর জয়যাত্রা,/ চল’ জরাপরাভব সমরে/ পবনে কেশররেণু ছড়ায়ে,/ চঞ্চল কুন্তল উড়ায়ে ॥ (গীতবিতান)

প্রকৃতির আনমনা আবহের সঙ্গে বসন্তে আকুল কণ্ঠে গেয়ে ওঠে কোকিল, সন্ধ্যায় জোনাকের বাতি জ্বলে ওঠা গ্রামে গ্রামে-অরণ্য-জঙ্গলে; সবমিলিয়ে যেন ঋতুবতী হয়ে ওঠে প্রকৃতি। প্রকৃতি ঋতুবতী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যা কিছু প্রাকৃতিক সবাই চঞ্চল হয়ে ওঠে; প্রত্যেকেই খুঁজে নিতে চায় আপন প্রেয়সীর মন, প্রেয়সী প্রকৃতিও আকুল মিলনাকাঙ্ক্ষায়। মিলন থেকেই তো সৃষ্টির অঙ্কুরোদ্গম। কবিচিত্তের সেই মিলনাকাঙ্ক্ষার আর্তিই হয়তো উচ্চারিত হয়েছে রবীন্দ্রগীতে। বসন্তের এই উতলা করার সামর্থ্য, উন্মনা করার শক্তি আর সঙ্গে আছে বসন্তের নাতিশীতোষ্ণ আবহ; বসন্তের এই ঋতুবতীরূপ, নীলাকাশের পটভূমিতে উজ্জ্বল বর্ণিল ফুলের সমারোহ; কোকিলের আকুল করা সুর, জোনাকের আলো ঝলমল সন্ধ্যা আর পত্রপল্লবহীনতার হাহাকার থেকে নতুন পাতার আগমনি; সব মিলিয়েই বসন্ত হয়ে উঠেছে অনন্য সৌন্দর্যমণ্ডিত এক সময়কাল। ঋতুবতী বসন্তের সব আড়াল ভেঙে মিলন প্রত্যাশায় কবি খুঁজে নিতে চান দৃশ্যের অধিক।

দৃশ্যের অধিক যিনি দেখেন, তিনিই কবি। সাদা চোখে একজন মানুষ যা দেখেন কবি তারচেয়েও বেশি দেখেন; সরল অর্থে কথাটি নিশ্চয়ই সর্বাংশে সত্য নয়; কিন্তু কবির কবিতায় যখন কোন দৃশ্যকল্পে স্বতন্ত্র ব্যঞ্জনার স্বাদ আস্বাদন করেন পাঠক, তখনই কবিদৃষ্টির স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে পাঠকের চিন্তার বাঁক বদলে যায়। কবির উপস্থাপনশৈলীতে মুগ্ধ হন পাঠক, কবির কবিতা পড়ে চমৎকৃত হন, বারবার পড়ে কবিতাকে হৃদয়ঙ্গম করে নিতে সচেষ্ট হন। এটি ঘটে কবির পর্যবেক্ষণ গুণের কারণে। উন্মনা বসন্তের ঔদাসীন্যের পর্দা খুলে কবি নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে পঙক্তি নির্মাণ করেন, যে পঙক্তি পাঠ করে পাঠক বুঝে নিতে চান, কবি তারই কথাটি অনিন্দ্য সুষমায় উচ্চারণ করেছেন। এভাবেই বসন্ত হয়ে ওঠে কবিতার নিজস্ব ঋতু। কবিতার পঙক্তিতে কবি হৃদয়াকুতিকে মেলে ধরেন তার আকাঙ্ক্ষার কথা।


কবিতাবিষয়ক এ আলোচনায় আরও একটি প্রসঙ্গের অবতারণা করে আলোচনার ইতি টানতে চাই; কবির প্রত্যাশা কল্যাণের পক্ষে, শুদ্ধতা ও সুন্দরের পক্ষে; মানবজীবনের গূঢ় সত্যের উন্মোচনে সাহিত্যের যে লক্ষ্যের কথা উচ্চারিত হয়েছে বারবার; সে গূঢ় সত্য উন্মোচনের মাধ্যমে পাঠকের নানাবিধ প্রত্যাশা পূরণের পাশাপাশি মানবহিতের বিষয়টিকে নিশ্চিত করার কাজে ব্রতী কবিকুল বসন্তের আকুলতা থেকে নির্মাণ করেন কবিতার পঙক্তি। সত্যের সঙ্গে জ্ঞানের মিথষ্ক্রিয়ায় অধপাতিতদের বোধোদয় প্রার্থনা করেন; আমাদের কল্পনার গভীরে তন্দ্রাচ্ছন্ন সৃষ্টিপ্রবণ শক্তির মুক্তি ঘটুক; গঠনমূলক সমালোচনায় সোচ্চার হোক বিদগ্ধ প্রাজ্ঞজনরা; বিজ্ঞানমনষ্ক আধুনিক আবহে কূপমণ্ডুকতা-ধর্মান্ধতা থেকে মুক্তি পাক সুশীল সমাজ। প্রতিটি কবিতা হোক প্রত্যেক কবির স্বপ্নের সমান বিস্তৃত। কবিপ্রাণে এ সত্য উন্মোচিত হয় তার কবিজন্মের মধ্য দিয়ে। যে জন্ম হয় তার বসন্তে।

কবি ও কবিতাবিষয়ক অকিঞ্চন এ আলোচনার পরও, উপসংহারে বলি—কবিতা যত্ন চায়, কবিতা দহন চায়-গ্রহণ চায়, মগ্ন হতে বলে কবিতা। কবিতা ক্ষরণ চায়, নিবেদন চায়, প্রণয়-নৈবেদ্য চায় প্রতিদিন-সারাক্ষণ। কবিতা মুগ্ধতা চায়, অভিনিবেশন প্রার্থনা করে, সতর্কতা চায় কবিতা। কবিতা প্রত্যয় চায়, আত্মবিশ্বাস চায়; আত্মপরিচয় চায়, স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল থাকতে চায় প্রতিদিন। কবিতা জীবনের গান গায়, হাঙরের মুখ থেকেও যেন ফিরে আসে প্রতিটি জীবন। কবিতা জীবনের সপক্ষে দাঁড়ায়। কবিতা সংগ্রাম চায়, উজান গাঙে গুন টেনে নিতে বলে কবিতার নাও। কবিতা ধৈর্য চায়-সহিষ্ণুতা চায়, কবিতা সংযম চায়, পরিমিতি চায়। অস্থিরতায় কবিতা ক্লিশে হয়ে পড়ে, ক্ষীণ-রুগ্ন হয় পড়ে। কবিতাবৃক্ষকে বেড়ে ওঠার অবসর দিতে হবে। এক মাসেই ফলবতী হবে কবিতাবৃক্ষ তেমনটি প্রত্যাশা করলে রক্তশূন্যতায় কবিতার অকাল মৃত্যু হবে। পূর্ণ ফল পেতে চাইলে কবিতাবৃক্ষকে ঋতুবতী হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। পৃথিবীর ঋতুকাল বসন্তেই তাই প্রত্যেক কবির জন্ম হয় নিজের চৈতন্যের গভীরে। কাঙালের প্রতি পক্ষপাত নেই কবিতার, বিত্ত-বেসাতের কাছেও নেই নগ্ন আনুগত্য। করুণায় কবির ঘৃণা। কবিতা স্বপ্ন-স্বয়ম্বরা অযত্নে কবিতা বাহারি-বর্ণিল হলেও মরা; প্রত্যাখ্যাত কবিতা মৃত প্রজাপতি হয়ে পড়ে থাকে পথের ধুলায়। কবিতা নিজস্ব সবুজ খুঁজে পেতে চায় কবির প্রতিটি পঙক্তির ভেতর। কবিতাচারিত্র্য হঠকারিতায় বিপন্ন না হয়, কবিতা তাই প্রত্যাশা করে একজন সৎ কবির কাছে। আসুন আমরা সবাই কবিতার প্রত্যাশা পূরণে সচেষ্ট হই! বসন্ত কীভাবে ধরা দেয় কবির চেতনায় সে কথাটি একটি কবিতা উদ্ধৃত করে বুঝে নেওয়ার পাশাপাশি কবিজন্মের সত্যটাকে আবিষ্কার করতে চাই।

কৈশোরে বসন্ত আসে কোকিলেরা গানে গলা সাধে
দখিনা বাতাস শিরীষের বীজাধারে নূপুরের ধ্বনি কাঁদে
দরোজায় কড়া নেড়েছিল গোলাপ বিদায়ি শীতের সকাল
উদাস দুপুর ডেকেছিল বনে যেতে আমলকীর পত্রশূন্য ডাল
বহেরার শাখা হাহাকার করেছিল নতুন পত্রপল্লব চেয়ে
উদাস ব্যাকুল বাউল হারিয়ে গিয়েছিল বিরহের গান গেয়ে;
মেহগিনি সড়ক কেবল ডেকেছিল বিরহিনী বালুচর
যখন ফুটেছে কুঁড়ি শিমুলের ডালে জন্মেছিলে তুমি প্রিয় কবিবর।
 (বসন্ত আবাহন)

পথ চলতে চলতে কবি প্রকৃতিতে বসন্ত পাঠ করে নেন। গ্রামবাংলার পথে-প্রান্তরে যদি হাঁটো কিছুক্ষণ, দেখো প্রকৃতির রূপ যার ছবি অরূপ রতন, বসন্তে পোয়াতি গাছে গাছে ফোটে কত শত ফুল, আম লিচু জাম লেবু কামরাঙা বাতাবি জারুল, পাখিরা যে যার সুরে মগ্ন মান গায় গলা খুলে, রঙিন ফিতাটি প্রজাপতি হয়ে বসে আছে বালিকার চুলে; সজিনার লতা দোলে পত্রশূন্য ডালে কিশোরীর ধুলোমাখা মুখ তবু লাল আভা গালে, ছোট নদী বসন্তে শুকায় জলশূন্য হয় বিল শালবনে গাছে গাছে খেলে কটিপাতার ঝিলমিল; পলাশ শিমুল মান্দারের ডালে আবির-আগুন, স্মৃতিপটে দোলা দিয়ে যাবে লক্ষ শহিদের খুন। ধানের সবুজ ক্ষেতে মিশে থাকে কৃষকের হাসি, নেপথ্যে কে যেন গায়—‘... সোনার বাংলা তোমায় ভালোবাসি।’
বসন্ত প্রেমময় কবিতার ঋতু, বসন্ত জীবন সংগ্রামের ঋতু—স্মৃতি জাগানিয়া স্বপ্ন নিমজ্জনের ঋতু; কবি ও শিল্পী এবং শিল্পেরও ঋতু এই মধুর বসন্তে তাই থাকে স্বপ্ন ভঙ্গের হাহাকার, আকুল রোদন।




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ। নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।
ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close