ই-পেপার শুক্রবার ১৪ মার্চ ২০২৫
শুক্রবার ১৪ মার্চ ২০২৫
ই-পেপার

শুক্রবার ১৪ মার্চ ২০২৫

স্বাস্থ্যসম্মত রাজধানী চাই
প্রকাশ: শুক্রবার, ১৪ মার্চ, ২০২৫, ৩:৪১ পিএম  (ভিজিট : ১০২)
শেলী সেনগুপ্তা। ছবি: সময়ের আলো

শেলী সেনগুপ্তা। ছবি: সময়ের আলো

প্রতিদিন বাড়ছে মানুষ, প্রতিদিন যেন মানুষের ঢল ছুটছে কিছু একটা পাওয়ার আশায়, ছুটছে রাজধানী অভিমুখে। তাই অন্য শহরের চেয়ে ঢাকায় মানুষ আগে থেকে অনেক বেশি, আবার প্রতিদিন বাড়ছে গাণিতিক হারে, কিছু জন্মসূত্রে আর কিছু অন্য শহর থেকে আসছে। প্রতিদিন ঢাকার অধিবাসী হিসেবে যোগ হচ্ছে দুই হাজারেরও অধিক মানুষ।

তা ছাড়া সরকারি অফিস-আদালত, সেরা বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যাংকের হেড অফিস, ভারী ও মাঝারি শিল্প-কারখানাসহ বিভিন্ন ধরনের সেবা কেন্দ্রীভূত হওয়ায় ঢাকায় আসা ছাড়া কিছু মানুষের সামনে কোনো বিকল্প পথ থাকে না। এ ছাড়া অনেক শিল্প-কলকারখানা রাজধানী এবং এর আশপাশে হওয়ায় বিশাল জনগোষ্ঠীর বাস রাজধানী ও সংলগ্ন এলাকায়, যার বিশাল প্রভাব পড়ছে ঢাকায়।

এসব মানুষ কাজের জন্য বাইরে যায় এবং অধিক সময় রাস্তায় থাকে। সময়ের চাহিদা হিসেবে তাদের মলমূত্র ত্যাগ করার দরকার হয়। শহরে যত মানুষ প্রতিদিন বাইরে যায় সেভাবে হিসাব করলে এত মানুষের জন্য দরকার প্রচুর গণশৌচাগার। আমাদের প্রাণের শহর, ব্যস্ততার শহর, উন্নয়নের মূল কেন্দ্রবিন্ধু ঢাকাতে আছে কি তেমন সংখ্যক গণশৌচাগার? যা আছে তা কি আদৌ স্বাস্থ্যসম্মত? এসব গণশৌচাগার কি নারী, শিশু বা প্রতিবন্ধীর জন্য নিরাপদ? বিষয়গুলো নিয়ে ভাবার সময় এসেছে।

মানুষের জীবনে শৌচাগারের গুরুত্ব কত বেশি তা বলে বোঝানো যাবে না। এই শৌচাগারকে কেন্দ্র করে কত যে গল্প প্রচলিত আছে তাও বলে শেষ করা যাবে না। এর কিছু সত্য, আবার কিছু অতিরঞ্জিত। 

বলা হয়ে থাকে আর্কিমিডিস তার বিখ্যাত সূত্রটি নাকি বাথরুমে বসে পেয়েছিলেন এবং তাৎক্ষণিক ‘ইউরেকা’ ‘ইউরেকা’ বলে বস্ত্রহীন অবস্থায় রাস্তায় বের হয়ে পড়েছিলেন। আমাদের সমাজে বাথরুমের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ‘বাথরুম সিঙ্গার’ নামক শব্দটি, যা দিয়ে হেঁড়ে গলার গায়কদের নিয়ে কৌতুক করা হয়, আবার কখনো ছিটকিনিবিহীন বাথরুমের ক্ষেত্রেও ‘বাথরুম সিঙ্গার’ শব্দটি প্রযোজ্য। বিষয়টি সত্যিই আনন্দের।

এত গেল বাথরুম নিয়ে ভিন্ন ধরনের সমাচার। প্রকৃতপক্ষে আধুনিক নগর অবকাঠামো উন্নয়নে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের কথা বিবেচনায় রাখলে গণশৌচাগার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে অবশ্যই পরিগণিত হয়। আমাদের প্রিয় শহর ঢাকা প্রতিদিন বড় হচ্ছে, বাড়ছে আবাসন ব্যবস্থা, বাড়ছে জনসংখ্যাও। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নাগরিকের সমস্যাও কিছু কম নয়। পথে নামলে মানুষের দরকার হয় শৌচাগারের, এ জন্য গণশৌচাগারের শরণাপন্ন হতে হয়। 

তার জন্য আদৌ কি আছে পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যসম্মত গণশৌচাগার? এ শহরের ফুটপাথ, রাস্তাঘাট, রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ড, বিমানবন্দর, লঞ্চঘাট ও বাজারে প্রতিদিন অনেক মানুষের জমায়েত হয়। অনেক হকার রাস্তায় বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র বিক্রি করে। তারা দিনের অধিকাংশ সময় থাকে রাস্তায়। বিশাল এই জনগোষ্ঠীর নিয়মিত মলমূত্র পরিত্যাগের আবশ্যিকতা রয়েছে।

তা ছাড়া ঢাকাবাসীদের নিত্যসঙ্গী যানজট। ফলে জনসাধারণকে দীর্ঘক্ষণ রাস্তায় থাকতে হয়। আর কর্মজীবীদের কথা না হয় না-ই বললাম। এসব মানুষের জন্য দরকার পর্যাপ্ত গণশৌচাগার। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, এ বিশাল চলমান জনগোষ্ঠীর জন্য নেই পর্যাপ্ত গণশৌচাগার। যে কয়টি আছে তাতে নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শৌচাগার ব্যবহারে আলাদা ব্যবস্থা ও নিরাপত্তার ব্যবস্থাও নেই। আমাদের দেশের বিপুলসংখ্যক নারী এখন কাজের জন্য নিয়মিত বাইরে বের হচ্ছে, অথচ তাদের জন্য কোনো নারীবান্ধব ও নিরাপদ শৌচাগার নেই। ফলে নারীরা পথে বের হলে অতি প্রয়োজনেও পানি পান করা থেকে বিরত থাকে। হয়তো এ কারণেই আমাদের দেশে দিন দিন কিডনি সমস্যাজনিত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি আমাদের দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য হুমকিস্বরূপ।

একইভাবে পথচারী অপারগ পুরুষরা শহরের যত্রতত্র মলমূত্র পরিত্যাগ করে যা আমাদের পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। ক্ষতিকর সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার জন্যও, তা ছাড়া এটি একটি শহরের সৌন্দর্যও নষ্ট করে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমরা ভুলে যাই যে জীবন বাঁচানোর জন্য যেমন খাদ্য গ্রহণের দরকার আছে তেমনি সেই খাদ্যকে বর্জ্য হিসেবে মানবদেহ থেকে নিষ্কাশনেরও দরকার আছে এবং এটি আমাদের নিত্যদিনের কাজ। তাই প্রতিদিনের মানব বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য ঘরে ও বাইরে স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থা থাকা দরকার। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানব দেহের যাবতীয় সুস্থতা। মানব বর্জ্য নিষ্কাশনের স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থা না থাকলে এটি অসুস্থতার জন্য একটি অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়। 

আমাদের প্রিয় নগরী ঢাকাতে ভাসমান মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি, তাদের মধ্যে রয়েছে হকার, রিকশাচালক, ভিক্ষুক ইত্যাদি। তারা দিনের অধিকাংশ সময় অর্থের প্রয়োজনে রাস্তায় থাকে। আমাদের শহরে এসব মানুষের জন্য নেই কোনো শৌচাগারের ব্যবস্থা। তারা বাধ্য হয়ে ফুটপাথের পাশে, পার্কে, সড়কের পাশে প্রকৃতির ডাকে সারা দেয়। এর ফলে যেসব উন্মুক্ত স্থান যেখানে মানুষের ঘুরে বেড়ানোর কথা সেসব স্থান মানববর্জ্য দ্বারা দূষিত হয়ে যাচ্ছে। এসব মানববর্জ্য হলো জীবাণুর আধার। তা শুকিয়ে ধুলো বা খাবারের সঙ্গে কিংবা পানিতে মিশে মানবদেহে প্রবেশ করে। 

এতে টাইফয়েড, জন্ডিস, আমাশয়, ডায়রিয়া এমনকি কৃমি রোগও হতে পারে। এককথায় বলা যায় এটি সত্যিই জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তাই সব দিক বিবেচনা করে, জনগণের সুস্থতা, শহরে জনগণের চলাচলকে আরামদায়ক করা ও শহরের মর্যাদা বৃদ্ধি করার জন্য আমাদের শহরে আধুনিক গণশৌচাগার তৈরির কোনো বিকল্প নেই। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার কথা স্মরণ রেখে শহরময় পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি গণশৌচাগার সুবিধা নিশ্চিত করে নগরবাসীকে স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে রক্ষা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, শক্তিশালী জাতি গঠনে সুস্থ জনগোষ্ঠীর ভূমিকা অসীম।

একটি আধুনিক নগর অবকাঠামো উন্নয়নে জনস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কথা বিবেচনায় রেখে পাবলিক টয়লেট একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচিত হতে হবে। নগরের পরিধি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বর্ধিত হারে গণশৌচাগারের ব্যবস্থাও রাখতে হবে। নগর উন্নয়ন, নগর পরিকল্পনা এবং নগর ব্যবস্থাপনায় অবশ্যই গণশৌচাগার ব্যবস্থাকে তালিকাভুক্ত করতে হবে এবং এই তিন জায়গায় নারীর চাহিদাকে বিশেষ বিবেচনায়ও রাখতে হবে। অথচ এটিই এখন সবচেয়ে বেশি অবহেলিত।

আমাদের দেশে বেশ কিছু গণশৌচাগার আছে। কিন্তু সেগুলো চাহিদার তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল। মানুষের প্রয়োজনকে মনে রেখে আরও বেশি বেশি গণশৌচাগার নির্মাণের ব্যবস্থা নিতে একই সঙ্গে সেগুলো অবশ্যই স্বাস্থ্যসম্মত হতে হবে। থাকতে হবে পর্যাপ্ত পানি, টিস্যু পেপার ও উন্নত মানের হ্যান্ডওয়াশের সরবরাহ। প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ থাকতে হবে। দরজায় লক থাকতে হবে। সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ের ব্যবস্থাও রাখতে হবে। ব্যবস্থাপনা মানসম্মত না হলে অভিযোগ প্রদানের ব্যবস্থা রাখতে হবে এবং জরিমানা নিশ্চিত করা দরকার।

ঢাকা শহরে যে পরিমাণ গণশৌচাগার দরকার তার সবই প্রস্তুত করা এবং দেখাশোনার দায়িত্ব শুধু সিটি করপোরেশনকে দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়ার কিছুই নেই। গণশৌচাগারের জন্য সঠিক জায়গাও দরকার। এ জন্য সবসময় সিটি করপোরেশনের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকেও দায়িত্ব দেওয়া যায়। রাস্তার পাশে প্রতিষ্ঠিত সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, এমনকি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকেও দায়িত্ব দেওয়া যায়। সহজে প্রবেশযোগ্য স্থানে তাদের নিজস্ব অর্থায়নে ও ব্যবস্থাপনায় গণশৌচাগার নির্মাণ করার নীতিমালা প্রণয়ন করা দরকার। এ জন্য প্রয়োজনে বাধ্যও করতে হবে।

আমাদের দেশে পেট্রোল পাম্প, সিএনজি ফিলিং স্টেশন ইত্যাদিতে গণশৌচাগর নির্মাণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। গণশৌচাগার নির্মাণ করাও হয়েছিল, দুঃখজনক বিষয় হলো একসময় নির্মিত হলেও তা সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি। এখন এসব গণশৌচাগার অপরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যকর হয়ে আছে। কোনো কোনো শৌচাগার ব্যবহারেরও অনুপযুক্ত হয়ে গেছে। 

এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে, আবার নতুন করে শৌচাগার নির্মাণে বাধ্যবাধকতা আনতে হবে। একই সঙ্গে এসব দেখাশোনা ও পরিচ্ছন্ন রাখার বিষয়টির দিকে মনোযোগ দিতে হবে। তা ছাড়া গণশৌচাগার ব্যবহারকারীদেরও এটির পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে সমানভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। এ জন্য বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রচার ও সভা-সেমিনার করে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে একটি শক্তিশালী ও সফল জাতি গঠনে পরিহার্য বিষয় হলো সুস্থতা।

লেখক: কথাসাহিত্যিক





https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ। নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।
ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close