প্রকাশ: শুক্রবার, ১৪ মার্চ, ২০২৫, ৩:২৭ পিএম (ভিজিট : ১২৪)

নলতা শরিফে ইফতার করছেন মুসল্লিরা। ছবি: সময়ের আলো
প্রতি বছরের মতো এবারও দেশের অন্যতম বৃহৎ ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত হচ্ছে সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার নলতা শরিফে হজরত খান বাহাদুর আহছানউল্লার (রহ.) মাজার প্রাঙ্গণে। প্রায় ৯০ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে এই ইফতার মাহফিল। বর্তমানে এখানে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৬ হাজার রোজাদার একসঙ্গে বসে ইফতার করেন। নলতা কেন্দ্রীয় আহছানিয়া মিশনের ব্যবস্থাপনায় এ ইফতার মাহফিলের আয়োজন করা হচ্ছে। ধর্মীয় সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বের এক অনন্য দৃষ্টান্ত এই ইফতার মাহফিল। এখানে প্রতিদিন ইফতার করাতে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে রোজাদাররা সওয়াব হাসিলের জন্য এই বড় ইফতার মাহফিলে শরিক হতে নলতায় ছুটে আসেন। ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাই ভেদাভেদ ভুলে এক কাতারে বসে এখানে ইফতার করেন। মিশন কর্তৃপক্ষের দাবি, এটিই দেশের সর্ববৃহৎ ইফতার মাহফিল।
মিশন কর্তৃপক্ষ জানায়, আহছানউল্লা (রহ.) ১৯৩৫ সালে নিজের হাতে নলতা কেন্দ্রীয় আহছানিয়া মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। মিশন প্রতিষ্ঠা করার পর তিনি নিজেই প্রতি বছর রমজান মাসব্যাপী এ ইফতার মাহফিলের আয়োজন করতেন। পরবর্তী সময়ে এই ইফতার মাহফিলের পরিধি বেড়ে যায়। ১৯৫০ সাল থেকে শুরু করে প্রতি বছর রমজান মাসে ইফতারের আয়োজন করে আসছে নলতা কেন্দ্রীয় আহছানিয়া মিশন। ইফতার মাহফিলে সবাই একসঙ্গে বসার জন্য আহছানউল্লার (রহ.) মাজার প্রাঙ্গণে বিশাল টিনের ছাউনি নির্মাণ করা হয়।
এখানে ইফতারসামগ্রী বিতরণের জন্য রয়েছে প্রায় তিনশ স্বেচ্ছাসেবক। এ স্বেচ্ছাসেবকদের একটি বড় অংশ শিশু-কিশোর। যারা বিনা পারিশ্রমিকে প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পরিশ্রম করেন। আশপাশের এলাকা থেকে এরা সবাই এসেছেন নিজ ইচ্ছায়। বেলা সাড়ে ৩টার পর থেকে কাজ বণ্টন শুরু করা হয়। আসরের নামাজের পর থেকে ইফতার সাজানোর কাজ শুরু করেন স্বেচ্ছাসেবকরা।
একজন স্বেচ্ছাসেবক অলিউল্লাহ বলেন, তারা চেষ্টা করেন, যাতে ইফতার করতে আসা রোজাদারদের কোনো অসুবিধা না হয়। প্রথমে ছাউনির নিচে মাদুর বিছানো হয়। তারপর সারি সারি লাইন করে পানির বোতল দেওয়া হয়। তারপর গ্লাস-প্লেট। সাড়ে ৫টার দিকে ইফতার মাহফিল তৈরি হয় জনসমুদ্রে।
মিশনের ইফতারের তালিকায় রয়েছে ফিরনি, ডিম, চিড়া, ছোলা ভুনা, খেজুর, শিঙাড়া ও কলা। প্রতিদিন ১৫ মণ দুধের ফিরনি তৈরি করা হয় এখানে। রোজাদারদের জন্য প্রতিদিন প্রায় ৬ হাজার প্লেটে ইফতার প্রস্তুত করা হয়। এ ছাড়াও নলতা শরিফের আশপাশের এলাকার মসজিদ ও বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয় এক থেকে দেড় হাজার রোজাদারের ইফতার। রয়েছে পানি পানের বিশেষ ব্যবস্থা। দেশ-বিদেশের ভক্তরা যৌথভাবে এই ইফতারের অর্থ যোগান দিয়ে যাচ্ছে।
মিশনের বাবুর্চি মহব্বত আলী ও মোক্তার আলী জানান, তারা দুজন ৪০ বছর ধরে এখানে ইফতার তৈরির কাজ করছেন। তাদের মতোই ২২-২৫ জন ফজরের নামাজের পরপরই ইফতার তৈরির কাজ শুরু করেন। প্রায় ছয় হাজার মানুষের ইফতার তৈরিতে সময় লেগে যায় আসরের নামাজ পর্যন্ত। তারপর শুরু হয় ইফতার সাজানোর কাজ।
বর্তমানে ৫০০ কেজি দুধ দিয়ে ফিরনি প্রস্তুত করা হয়। সেদ্ধ করা হয় সাড়ে ৬ হাজার ডিম। ২৫০ কেজি ছোলা ভিজানো হয়। এ ছাড়া ১০৮ কেজি সুজি, ময়দা ১৯০ কেজি, চিড়া ১৫০ কেজি, চিনি ১৫০ কেজি, কয়েক মণ আলু দিয়ে থাকে। ফিরনি ও ডিম সেদ্ধ করার কাজটি করেন মহব্বত আলী। তিনি বলেন, আমরা এ মাসে রোজাদারদের খেদমত করি, তৃপ্তি পাই। কর্তৃপক্ষ যে টাকা দেয়, তাতে সবাই খুশি থাকেন। এটি পারিশ্রমিক নয়, সম্মানী বলে আমরা মনে করি।
ইফতারির আগে প্রতিদিন ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা দেশ ও জাতির কল্যাণে বিশেষ মোনাজাতে অংশ নেন। ইফতার শেষে এই প্রাঙ্গণেই মাগরিবের নামাজ আদায় করা হয়।
সাতক্ষীরা থেকে নলতা শরিফের ইফতার মাহফিলে যোগ দিতে এসেছেন এসএম বিপ্লব হোসেন। তিনি বলেন, আমি বিশেষভাবে নলতা শরিফের ইফতার মাহফিলে অংশ নিতে এসেছি। এটি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ইফতার আয়োজন, যেখানে ছয় হাজার মানুষ একসঙ্গে ইফতার করেন। এত মানুষের সঙ্গে বসে ইফতার করা এক অসাধারণ অনুভূতি। কার দোয়া কখন কবুল হয়, তা বলা যায় না। আমি আশা করি, এই ইফতার মাহফিলে অংশগ্রহণের মাধ্যমে মহান আল্লাহ তায়ালা আমার দোয়াও কবুল করবেন।
কেন্দ্রীয় আহছানিয়া মিশনের (ভারপ্রাপ্ত) সাধারণ সম্পাদক কৃষিবিদ ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, হযরত খান বাহাদুর আহছানউল্লা (রহ.) এই আয়োজন চালু করেন, যা সময়ের সঙ্গে আরও প্রসারিত হয়েছে। শুরুতে ইফতারের আয়োজন সীমিত ছিল। কিন্তু এখন এটি দেশের সবচেয়ে বড় ইফতার মাহফিলে পরিণত হয়েছে। এ আয়োজন সফল করার জন্য প্রতি বছর রোজার ৪০ দিন আগে থেকে প্রস্তুতি নেওয়া হয়।