ই-পেপার বৃহস্পতিবার ১৩ মার্চ ২০২৫
বৃহস্পতিবার ১৩ মার্চ ২০২৫
ই-পেপার

বৃহস্পতিবার ১৩ মার্চ ২০২৫

জায়গা নেই হিমঘরে, বিপাকে কৃষকরা
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ১৩ মার্চ, ২০২৫, ১২:৪৩ পিএম  (ভিজিট : ১৪৮)
হিমাগারে সংরক্ষণের জন্য আলু নিচ্ছেন কৃষকরা। ছবি: সময়ের আলো

হিমাগারে সংরক্ষণের জন্য আলু নিচ্ছেন কৃষকরা। ছবি: সময়ের আলো

চালের চাহিদা ও দাম বৃদ্ধির বাস্তবতায় এক সময় স্লোগান চালু হয়েছিল, ‘বেশি করে আলু খান, ভাতের ওপর চাপ কমান।’ ভাতের ওপর চাপ কমাতে আমরা একটু একটু করে আলুমুখী হওয়ার পর বর্তমানে কৃষকদের কাছে অর্থকরী ফসল আলু। আলুর মোট উৎপাদনে বাংলাদেশ পৃথিবীতে সপ্তম স্থানে রয়েছে। এখন সেই আলু চাষ করেই দুশ্চিন্তায় কৃষক। ‘আলুর দোষ’ কাটাতে চাষিরা ছোটাছুটি করছেন এদিক-ওদিক।

এবার উত্তরের জেলা গাইবান্ধায় আলুর ভালো ফলন হয়েছে। বাজারে চাহিদার তুলনায় জোগান বেশি হওয়ায় আলুর দাম কম। ক্ষতি কমাতে কৃষক হিমাগারে আলু রেখে পরে বিক্রির চিন্তা করছেন। হিমাগারে তাই কৃষকের ভিড় বাড়ছে। তবে, চাহিদা অনুযায়ী হিমঘরে জায়গা না থাকায় আলু রাখতে না পেরে ফেরত যাচ্ছেন অনেকে। হিমাগারে আলু সংরক্ষণ করতে গিয়ে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা ও বিড়ম্বনা পোহাতে হচ্ছে চাষিদের। বুকিং কার্ড থাকলেও আলু নিয়ে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে কৃষককে। স্থান সংকুলান না হওয়ায় হিমাগারের বাইরে আটকে আছে আলু বহনকারী শত শত ট্রাক। এতে কৃষকের পাশাপাশি ভোগান্তিতে পড়েছেন যানবাহনের চালকরা।

অন্যদিকে মালিকেরা হিমাগার পরিচালনার খরচ বাড়ার কথা বলে ভাড়া বাড়িয়েছেন। হিমাগারের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী, স্থানীয় দালাল ও ফড়িয়াদের সঙ্গে আঁতাত করে ব্যবসায়ীরা আলু সংরক্ষণের অগ্রিম বুকিং কার্ড হাতিয়ে নিয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। এতে কৃষকেরা হিমাগারে আলু রাখতে পারছেন না। সব মিলিয়ে হিমাগারমালিক ও আলুচাষিরা এখন মুখোমুখি অবস্থানে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর গাইবান্ধার সূত্র জানিয়েছে, জেলায় এবার ১২ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিলো। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে আবাদ হয়েছে ১৪ হাজার ৪৯৭ হেক্টরে। এর মধ্যে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলাতেই আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ৬ হাজার ১০৪ হেক্টর জমিতে। আবাদ হয়েছে ৯ হাজার ৩১৮ হেক্টরে। এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবং রোগ-বালাইয়ের আক্রমণ না হওয়ায় আলুর বাম্পার ফলন হয়েছে।

চাষি ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২৩ মওসুমে হিমাগারে প্রতি কেজি আলু সংরক্ষণে চাষিদের দিতে হতো ৩ টাকা ৫৭ পয়সা। ২০২৪ মওসুমে তা বাড়িয়ে করা হয় ৫ টাকা ২০ পয়সা। আর এবার প্রতি কেজি আলু সংরক্ষণে হিমাগারভাড়া হয়েছে ৮ টাকা। গত বছরের চেয়ে এবার ভাড়া বেড়েছে ২ টাকা ৮০ পয়সা। এতে ৬৫ কেজির এক বস্তা আলুর ভাড়া পড়বে ৫২০ টাকা। অগ্রিম বুকিং কার্ড নিতে দিতে হচ্ছে ৫০ টাকা করে। হিমাগার কর্তৃপক্ষ বলছে, গত বছর যে এক বস্তায় ৬৫-৬৬ কেজি পর্যন্ত আলু রাখা হয়েছিল, তা এবার ৫০ কেজি করে রাখতে হবে।

এদিকে উৎপাদিত আলু সংরক্ষণের জন্য গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার বকচর হিমাদ্রি কোল্ডস্টোরেজ-১, গোবিন্দগঞ্জ কোল্ডস্টোরেজ-২ ও উপজেলার সূর্যগাড়ি এলাকায় ১টি এবং সাপমারা এলাকায় অ্যাপেক্স অ্যাগ্রিসায়েন্স লিমিটেড নামে ৪টি হিমাগার রয়েছে। এ ছাড়া সাদুল্লাপুর উপজেলায় আরভি কোল্ডস্টোরেজ ও সুন্দরগঞ্জে আশরাফ আলী কোল্ডস্টোরেজ রয়েছে। এই ছয়টি হিমাগারে ৫২ হাজার ৭৬০ টন আলু সংরক্ষণ করার সুযোগ রয়েছে। এরই মধ্যে হিমাগারগুলো প্রায় পূর্ণ হয়ে গেছে। ফলে কৃষকেরা সংরক্ষণের সুযোগ না পেয়ে আলু বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে দাম কমে গিয়ে কৃষকেরা লোকসানে পড়েছেন।

গোবিন্দগঞ্জের কৃষক সাইফুল ইসলাম (৩৬) সেহরি খেয়ে হিমাগারে আলু নিয়ে আসেন। পরদিন রাত ১২টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও আলু রাখতে না পেরে ফেরত যান তিনি। সাইফুল ইসলাম বলেন, আলুচাষিরা প্রতিবছর হিমাগার মালিকদের ছলচাতুরীর মধ্যে পড়েন, এখন আলুর দাম কম। আলু হিমাগারে রেখে বছরের মাঝামাঝি সময়ে দাম বাড়লে বিক্রির আশা করেছিলেন কৃষকেরা। কিন্তু হুট করে হিমাগার মালিকেরা ভাড়া বাড়িয়ে দিলেন। বাড়তি ভাড়ায় আলু সংরক্ষণ করতে গেলে লাভ তো দূরের কথা, লোকসান বাড়বে। তিনি জানান, হিমাগারে ১০ বস্তা রাখার জন্য স্লিপ কিনেছেন। কিন্তু স্লিপ থাকার পরও হিমাগারে রাখতে না পেরে আলু নিয়ে ফেরত যান। এতে গুনতে হয়েছে বাড়তি গাড়িভাড়া। ফলে কম দামে বাড়ি থেকেই আলু বিক্রি করে দিয়েছেন।

গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার শাখাহার ইউনিয়নের বাল্ল্যে গ্রামের কৃষক হেলাল সরকার এবার ৬ একর জমিতে আলুর আবাদ করেছেন। সংরক্ষণের বুকিং কার্ড সংকটের খবর পেয়ে কয়েকটি হিমাগার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু কোনো কার্ডের ব্যবস্থা করতে পারেননি। তিনি অভিযোগ করেন, হিমাগার কর্তৃপক্ষ প্রকৃত চাষিদের নয়, কেবল মজুতদার ও ব্যবসায়ীদের কাছে আলু রাখার বুকিং কার্ড বিক্রি করেছে। ফলে এলাকার চাষিরা হিমাগারে আলু রাখার সুযোগ পাচ্ছেন না।

কৃষকেরা জানান, আলুর দাম কমে যাওয়ায় তারা উৎপাদনের অর্ধেক খরচও তুলতে পারছেন না। বাধ্য হয়ে হিমাগারে রাখার চেষ্টা করছেন। হিমাগারের ভাড়া বৃদ্ধি ও দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়েও আলু রাখার বুকিং কার্ড না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়েছেন তারা। আলু রাখার স্লিপ কার্ড দেওয়া শুরু হয় গত ১৫ ফেব্রুয়ারি। ১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত স্লিপ কার্ড দিয়েছে হিমাগার কর্তৃপক্ষ। ১৮ ফেব্রুয়ারি শত শত আলুচাষি বুকিং কার্ডের দাবিতে গোবিন্দগঞ্জে হিমাদ্রি কোল্ড স্টোরেজের মেইন গেট অবরুদ্ধ এবং ঢাকা-রংপুর মহাসড়ক প্রায় দেড় ঘণ্টা অবরোধ করেন।

কৃষকদের অভিযোগ, হিমাগার কর্তৃপক্ষ যোগসাজশ করে মজুতকারীদের আলু সংরক্ষণের কার্ড আগেভাগেই দিয়ে দিয়েছে। ফলে হিমাগারে আলু সংরক্ষণের কার্ড থেকে সাধারণ আলুচাষিরা বঞ্চিত হয়েছেন। অথচ দিন-রাত ট্রলি, ট্রাক্টর, ভ্যানে করে ব্যবসায়ী ও মজুতকারীদের হাজার হাজার বস্তা আলু হিমাগারে প্রবেশ করছে। এদিকে বুকিং কার্ড না পেয়ে কৃষকেরা খেত থেকে তোলার সঙ্গে সঙ্গে আলু বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এভাবে চলতে থাকলে তারা আগামী মওসুমের জন্য বীজআলুও সংরক্ষণ করতে পারবেন না।

হিমাদ্রি কোল্ড স্টোরেজের ম্যানেজার মোজাম্মেল হক বলেন, বুকিং কার্ড শেষ হয়ে গেছে। বিগত বছর আমাদের হিমাগারে আলু রাখা ব্যবসায়ীদের এবারও বুকিং কার্ড দেওয়া হয়েছে। তবে তা পরিমাণে অনেক কম। বুকিং কার্ড কালোবাজারে বিক্রির কোনো সুযোগ নেই।

গোবিন্দগঞ্জ কোল্ড স্টোরেজের ম্যানেজার সজীব বলেন, এ বছর আমরা স্থানীয় কৃষকদের অগ্রাধিকার দিচ্ছি। মজুতদারদের কোনো কার্ড দেওয়া হচ্ছে না। কৃষকেরা ৫ থেকে ১০ বস্তা করে আলু নিয়ে এলে কোল্ডস্টোরেজে রাখার কোনো সমস্যা হবে না। তিনি আরও বলেন, আমাদের কোল্ডস্টোরেজ দুটির ধারণক্ষমতা প্রায় সাড়ে ৩ লাখ বস্তা। এখন পর্যন্ত ১ লাখ ২০ হাজার বস্তা আলু বুকিং হয়েছে।

এ বিষয়ে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দা ইয়াসমিন সুলতানা বলেন, কৃষকেরা যাতে তাদের উৎপাদিত আলু হিমাগারে সংরক্ষণ করতে পারেন, সে জন্য নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে। হিমাগার মালিক সমিতি আমাদের জানিয়েছে, তাদের হিমাগারগুলোয় যথেষ্ট জায়গা ফাঁকা রয়েছে। কৃষকদের বীজআলু রাখতে কোনো সমস্যা হবে না। কেউ অতিরিক্ত আলু মজুতের কারসাজি করলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

গাইবান্ধা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. খোরশেদ আলম বলেন, এবার আলু উৎপাদনের জন্য আবহাওয়া ভালো ছিল। তাই লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে জেলায় প্রায় দেড় গুণ বেশি আলু উৎপাদন হয়েছে। সব কৃষক যাতে করে কমপক্ষে বীজ হিসেবে আলু সংরক্ষণ করতে পারেন, সেটুকু ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য কোল্ড স্টোরেজের মালিকদের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা চালিয়ে যাচ্ছি।




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ। নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।
ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close