
প্রতীকী ছবি
কিডনির সমস্যা সারা বিশ্বজুড়ে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশেও এই রোগের প্রাদুর্ভাব উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। দেশের শহর ও গ্রামাঞ্চলে সমানভাবে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। দারিদ্র্য, অসচেতনতা, চিকিৎসাসেবার অপ্রতুলতা এবং অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এই সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। দেশের প্রায় ৩ কোটি ৮০ লাখ মানুষ কোনো না কোনো কিডনি রোগে ভুগছে।
এর মধ্যে প্রতি বছর প্রায় ৪০ হাজার কিডনি রোগী ডায়ালাইসিসের ওপর নির্ভরশীল হয়। আরও ২৪ থেকে ৩০ হাজার রোগী হঠাৎ কিডনি বিকল হয়ে সাময়িক ডায়ালাইসিস প্রয়োজন হয়। অথচ ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে শিশুদের কিডনি রোগের চিকিৎসা সুবিধা কিছুটা থাকলেও দেশের অধিকাংশ হাসপাতালে তেমন কোনো সুবিধা নেই। ফলে অতিরিক্ত চিকিৎসা খরচ এবং চিকিৎসা ব্যয় সাধ্যাতীত হওয়ায় এ রোগে আক্রান্তদের একসময় কিডনি সম্পূর্ণ বিকল হয়ে যায়। তখন ডায়ালাইসিস বা কিডনি সংযোজন ছাড়া বাঁচার উপায় থাকে না। এ দুটি চিকিৎসা পদ্ধতিই অত্যন্ত ব্যয়বহুল। অর্থের অভাবে অনেকে পুরো চিকিৎসাসেবা চালিয়ে যেতে পারেন না। আবার চিকিৎসা করতে গিয়ে অনেকে নিঃস্ব হয়ে যায়। আর চিকিৎসা ও ডায়ালাইসিসেস অভাবে এবং কিডনি সংযোজন করতে না পেরে প্রতি বছর দেশে প্রায় ৮০ শতাংশ কিডনি রোগীর মৃত্যু হয়।
তাই তো কিডনি রোগকে নীরব ঘাতক বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, কিডনি রোগ প্রায় উপসর্গবিহীন। কিডনির কার্যক্ষমতা প্রায় ৯০ শতাংশ কমলে উপসর্গ প্রকাশ পায়। আবার কিডনি রোগ আছে এমন ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষ জানেই না যে তারা এই রোগে আক্রান্ত। এ ছাড়াও দেশে প্রতি বছর অন্তত ১০ হাজার মানুষের কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হচ্ছে গড়ে সর্বোচ্চ ৩৬৫ জনের, যা প্রয়োজনের মাত্র ৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ। প্রতিস্থাপন পরবর্তী ওষুধ ও চিকিৎসার না পেয়ে অর্ধেকের মৃত্যু হয় পাঁচ বছরে আগে।
আর চিকিৎসকরা জানান, কিডনি বিকল হওয়ার অন্যতম কারণ কিডনি প্রদাহ, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ। এ ছাড়া অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক ও ব্যথানাশক সেবন, কেমিক্যালযুক্ত ভেজাল খাবার ও পরিবেশ দূষণের কারণে কিডনি বিকল হতে পারে। কিন্তু স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনের মাধ্যমে ৬০-৭০ শতাংশের ক্ষেত্রে এই মরণঘাতী কিডনি বিকল প্রতিরোধ করা সম্ভব। তাই সচেতনতা এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে কিডনি রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী প্রায় ৮৫ কোটি মানুষ শুধু দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে আক্রান্ত। এই সংখ্যা ডায়াবেটিস রোগীদের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ এবং ক্যানসার রোগীদের চেয়ে প্রায় ২০ গুণ। মৃত্যুর কারণ হিসেবে কিডনি রোগ ১৯৯০ সালে ছিল ১৯তম স্থানে, বর্তমানে দাঁড়িয়েছে সপ্তম স্থানে। এভাবে চলতে থাকলে ২০৪০ সালে দখল করে নেবে পঞ্চম স্থান। আবার উন্নয়নশীল বা স্বল্পোন্নত দেশে কিডনি রোগের হার সবচেয়ে বেশি।
দেশের দুয়েকটি হাসপাতালে শল্যচিকিৎসকরা আড়াই লাখ টাকায় কিডনি প্রতিস্থাপন করে দিলেও এর সঙ্গে ওষুধ, রক্তের টাইপিং, টিস্যু টাইপিং, ক্রসমেচ, ডায়ালাইসিস মিলিয়ে একজন রোগীর দশ লাখের বেশি খরচ হয়। অথচ সরকারি হাসপাতালে রোগীদের খরচ হয় খুবই সীমিত। এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আজ বিশ্ব কিডনি দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হলোÑ‘আপনার কিডনি ঠিক আছে কি? তাড়াতাড়ি পরীক্ষা করুন, কিডনির স্বাস্থ্য রক্ষা করুন।’
দেশে কিডনি রোগীর সংখ্যা কেন বাড়ছে এমন প্রশ্নের জবাবে বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কিডনি অ্যাওয়ারনেস মনিটরিং অ্যান্ড প্রিভেনশন সোসাইটির (ক্যাম্পস) প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি অধ্যাপক ডা. এমএ সামাদ সময়ের আলোকে বলেন, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, স্থূলতা, নেফ্রাইটিস, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ধূমপান, নিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, বংশগত কিডনি রোগ, মূত্রতন্ত্রের প্রদাহ কিডনি রোগের অন্যতম কারণ।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, কিডনি প্রতিস্থাপনের এক বছরে ৯৬ শতাংশ রোগী ভালো থাকছে, তিন বছরে পর সুস্থ থাকছে ৮৫ শতাংশ, পাঁচ বছরে ৭৫ ও দশ বছরে অর্ধেক রোগী মারা যায় বিভিন্ন সংক্রমণের কারণে। অথচ তার কিডনি ভালো রয়েছে। ঠিকমতো কাজ করছিল।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দেশে কিডনি প্রতিস্থাপন শুরু হয় আশির দশকে। এরপর চার দশকের বেশি সময় কেটে গেলেও সরকারি পর্যায়ে এর চিকিৎসাসেবা তেমন এগোয়নি। একমাত্র বিশেষায়িত সরকারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি (এনআইকেডিইউ) হাসপাতালে এখন পর্যন্ত কিডনি প্রতিস্থাপন হয়েছে কেবল ৬০টির মতো।
এ হাসপাতালের ইউরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. শওকত আলম বলেন, আমাদের এখানে ২০০৫ সালে অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম প্রথম কিডনি প্রতিস্থান শুরু করেন। তখন প্রতি বছর তিন-চারটা প্রতিস্থাপন হতো। মাঝে আবার একবারে কমে যায়। এরপর আমি প্রশিক্ষণ শেষে কিডনি প্রতিস্থাপন শুরু করি। তবে সেটি নিয়মিত হচ্ছে না।
দেশে সবচেয়ে বেশি কিডনি প্রতিস্থাপন করেছেন সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম। শুক্রবার ১ হাজার ৮০০ কিডনি প্রতিস্থাপনের রেকর্ড গড়তে যাচ্ছেন তিনি।
স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত এ চিকিৎসক বলেন, দেশে কিডনি প্রতিস্থাপন প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। এর অন্যতম কারণ অঙ্গ প্রতিস্থাপনে দক্ষ জনবল তৈরি করা যায়নি, ওষুধে ব্যক্তির খরচ অনেকে বেশি, এ ছাড়া আইনি জটিলতা, সরকারের অর্থ বরাদ্দ নেই ও ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্লান্টের দিকে মানুষের আগ্রহ তৈরি করা যায়নি। এ ক্ষেত্রে ক্যাডাভেরিক অঙ্গদান ও প্রতিস্থাপন কার্যক্রম জোরদার করার লক্ষ্যে ধর্মীয়, আইনি ও সমাজের বিশিষ্টজনদের এগিয়ে আসতে হবে।