প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ১৩ মার্চ, ২০২৫, ৯:০৫ এএম (ভিজিট : ২৩৪)

ছবি : সময়ের আলো
জুলাই বিপ্লবের পর নারীর প্রতি সহিংসতা, ধর্ষণ ও নিপীড়নের প্রতিবাদে সারা দেশ উত্তাল। এরকম একটা ঐতিহাসিক বিপ্লবের পর আবার জনগণকে রাস্তায় নামতে হচ্ছে বিষয়টা খুবই উদ্বেগের। এককথায় বলতে গেলে বলতে হয়, ডাকাতি, ছিনতাই এবং মব জাস্টিসকে ছাড়িয়ে এখন চলছে ধর্ষণের মহোৎসব! ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির দাবিতে রাস্তায় ছাত্র-জনতা।
কেন ছাত্র-জনতাকে বারবার রাস্তায় নামতে হবে? কেন থামাতে পারছি না দুষ্কৃতকারীদের? রাষ্ট্রের কী করণীয়, তা জনগণকেই বারবার মনে করিয়ে দিতে হবে?
বিগত বছর ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের পর ৮ আগস্ট পর্যন্ত তিন দিন পুরোদেশ সরকারবিহীন এবং একই সঙ্গে পুলিশবিহীন ছিল। সে সময়ের তুলনায় অপরাধ এখন কম নয়, বরং অনেক বেশি। সঙ্গে যোগ হয়েছে ধর্ষণের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা।
পুলিশ সদর দফতরের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় ২০২৪ সালে জানুয়ারি-জুলাই মাসে নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা হয় ১০,৭০৪টি এবং আগস্ট-ডিসেম্বর ৫ মাসে হয় ৬,৮৬৭টি। আর ২০২৫ সালের শুধু জানুয়ারি মাসেই ১,৪৪০টি মামলা হয়। ফেব্রুয়ারিতেই সারা দেশে গড়ে শুধু নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা হয়েছে ১২টি। এসব পরিসংখ্যান থেকে দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা সহজেই আন্দাজ করা যায়।
কখন অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পায়? আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতিই কি একমাত্র কারণ? এ ছাড়া বিচারহীনতার সংস্কৃতি অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ বলা যায়। অপরাধ করলে যখন কোনোভাবেই রেহাই পাওয়া যায় না, কেবল তখনই অপরাধপ্রবণতা উল্লেখযোগ্য হারে কমতে পারে। বর্তমানে এ দুটিরই চরম ঘাটতি রয়েছে, যার কারণে একের পর এ ধরনের ঘটনা ঘটছে।
বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা মাগুরায় ৮ বছরের শিশুকে পরিকল্পিতভাবে ধর্ষণ। বিগত ৬ মার্চ শিশু আছিয়া বড় বোনের বাড়িতে এসে তার বোনের শ্বশুরের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয় এবং এ কাজে সহযোগী হিসেবে নাম আসে আপন দুলাভাইয়ের। মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে থাকা এ ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ দেশব্যাপী ধর্ষণের বিরুদ্ধে একের পর এক বিক্ষোভ এবং ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন চলছে। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় তখনও দেশের অন্য কোনো প্রান্তে চলছে ধর্ষণের মতো ঘটনা।
একটা শিশুর জন্য নিজের বোনের বাড়ি, তার স্বামী-শ্বশুরের কাছে নিরাপদ নয়, ভাবা যায়? শিশুর নিরাপদ জায়গা কোথায়? কেউ কেউ পোশাকের দোহাই দেন, এখানে তারা কী বলবেন? শিশুটি মৃত্যু শয্যায়। বেঁচে ফিরলেও এ ভয় তাকে হয়তো কোনোদিনই শান্তিতে ঘুমাতে দেবে না। কার ওপর দায় চাপাবেন? পতিত সরকার কিংবা বিরোধী দলের কাজ এটি নয়। এটি একটি সামাজিক ব্যাধি।
শিশু আছিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ডাক্তারের ভাষ্য শুনে গা শিউরে উঠে। আছিয়ার বড় বোনের বর্ণনায় উঠে আসে স্বামী সজিব এবং শ্বশুর হিটু শেখের নির্মমতা। মানুষের বিবেক কতটা নিচে নামলে এবং কতটা বিকৃত রুচিবোধ থাকলে এমন নির্মমভাবে ধর্ষণ করতে পারে। নিষ্ঠুরতার একটা সীমা থাকে, এখানে তাও নেই। অবাক করা বিষয় হচ্ছে হিটু শেখ এর আগেও ছেলে বউয়ের দিকে হাত বাড়িয়েছে? সম্মান বাঁচাতে যখন স্বামীর কাছে জানায় উল্টো তাকেই অপমান অপদস্থ হতে হয়। পুরো পরিবার যখন পশুবৃত্তির চর্চা করে তখন আর কিছুই বলার থাকে না।
দীর্ঘ এক সপ্তাহ লাইফ সাপোর্টে এবং কোমায় থেকে একটু চোখ মেলে বেঁচে থাকার জানান দিচ্ছে। ধর্ষণের অভিযোগে ভিক্টিটিমের বোনের স্বামী, বোনের শ্বশুর, শাশুড়ি ও ভাশুরকে গ্রেফতার-পরবর্তী ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন মাগুরার আদালত। মাগুরার আইনজীবী সমিতির কোনো সদস্য এ ধর্ষণ মামলার আসামির পক্ষে লড়বেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন। বিষয়টি অনেকেই ইতিবাচকভাবে নিয়েছেন। তবে এ রকম সুযোগ আছে কি না তা আইনজ্ঞরাই ভালো বলতে পারবেন। আইনকে আইনের গতিতে চলতে দেওয়া উচিত। জুলাই-পরবর্তী মব জাস্টিসের নামে নিরাপরাধ লোককে আমরা মরতে দেখেছি।
শেরপুরে বিস্কুট দেওয়ার কথা বলে ৫ বছরের শিশুকে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করার অভিযোগে ৬০ বছরের চান মিয়াকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ছাড়া রাজধানীর গুলশান, হবিগঞ্জ, নওগাঁ, কুমিল্লা, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, বগুড়াসহ বিভিন্ন জায়গায় শিশু-কিশোরীকে ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এদিকে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১০ বছরের এক মাদরাসা শিক্ষার্থী। জানা যায় মাদরাসা ছুটির পর শিশুটি তার নানাবাড়িতে যায়। ধর্ষক ফিরোজ মিয়া জমিতে সার দেওয়ার প্রাক্কালে শিশুটির গতি রোধ করে এবং শিশুটিকে মিথ্যা বলে একটি ফাঁকা বাড়িতে নিয়ে ধর্ষণ করে এবং কাউকে বললে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। ঘটনা এলাকায় জানাজানি হলে গ্রাম্য সালিশে ধর্ষক ফিরোজ মিয়াকে দেড় লাখ টাকা জরিমানায় বিষয়টি সুরাহা করা হয়। আরও অভিযোগ আছে জরিমানার ৯২ হাজার টাকা ভুক্তভোগী পেলে অবশিষ্ট ৫৮ হাজার টাকা যায় গ্রাম্য মাতব্বর- মালেক, বাবুল, ফাজুসহ কয়েকজনের পকেটে। এখন পর্যন্ত ধর্ষক ফিরোজ মিয়া গ্রেফতার হয়নি। খেয়াল রাখা দরকার প্রতিটি ধর্ষকের একই উক্তি কাউকে বললে মেরে ফেলা হবে।
এ কথা ধর্ষক যে এমনি এমনি বলে তা নয়। যাদের হত্যা করা হয়নি তাদের ধারণায় ছিল ঘটনাটি কেউ জানবে না। তা না হলে তাকেও মেরে ফেলা হতো।
রাজনৈতিক দলগুলো সমস্যার সমাধান না খুঁজে অপরকে দোষারোপেই আত্মতৃপ্তি পায়। তাদের ধারণা নির্বাচন হয়ে গেলেই এ ধরনের ঘটনা আর ঘটবে না। অথচ ধর্ষণের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা নতুন নয়। আমরা এখন পর্যন্ত বিচারে কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারিনি বলেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে।
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের তুলনায় বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ভিন্ন। তাদের কাজ শুধু নির্বাচন করে বিদায় নেওয়া নয়। একটি সুন্দর গণতন্ত্রকে সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিন। কিন্তু তা কতটুকু পারছেন? অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জনগণের যে প্রত্যাশা ছিল তা অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। কেন এমনটা হচ্ছে তা সহজেই অনুমেয়। একদিকে অন্তর্বর্তী সরকারে কোনো রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন লোক নেই, অন্যদিকে রাজনৈতিক শক্তি ক্রমেই দ্বিধাবিভক্ত হচ্ছে। যারা একসঙ্গে আন্দোলন করছেন তাদের ঐক্যে ফাটল দেখা দিয়েছে। এ সুযোগ গ্রহণ করছে দুর্বৃত্তরা।
একটা কথা বলা যায়, শিশু আছিয়ার ধর্ষণে রাষ্ট্র কিংবা কোনো রাজনৈতিক দল সরাসরি জড়িত নয়। এতে তাদের আপাতত কোনো দায় নেই। কিন্তু বিচার না করাটাই রাষ্ট্রের দায়। রাষ্ট্র যদি বিচার করতে না পারে কিংবা এমন কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে না পারে তবে তো ধর্ষণ রোধ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। অবশ্যই এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে মানুষ যেন ধর্ষণের কথা চিন্তা করতেও ভয় পায়। রাষ্ট্রকে নির্বিকার থাকলে হবে না কিংবা আইনের দোহায় দিলে চলবে না।
আশার কথা ধর্ষণ মামলার তদন্ত ও বিচারের সময় কমিয়ে অর্ধেক করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এসব মামলার তদন্তের সময় ৩০ থেকে কমিয়ে ১৫ দিন এবং বিচারকার্য ৯০ দিনের মধ্যে শেষ করার কথা বলা হয়। কিন্তু বিদ্যমান আইনে বিগত বছরগুলোতে কি বিচার সম্পন্ন হয়েছে? আইন এখানে সমস্যা নয়, সমস্যা সরকারের সদিচ্ছা। অপরাধ একেবারে নির্মূল সম্ভব নয়। কিন্তু অপরাধের লাগাম সরকারের হাতে থাকতে হবে। লাগাম যখন অপরাধীদের হাতে থাকে তখন সার্বভৌমত্বই হুমকির মুখে পড়ে।
নারীর প্রতি সহিংসতা ও ধর্ষণ রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিন। মনে রাখতে হবে ধর্ষণের প্রভাব খুনের থেকে ভয়াবহ। খুনের শাস্তি যদি ফাঁসি হয়, তা হলে ধর্ষণের শাস্তি ফাঁসি যৌক্তিক। ধর্ষকের কোনো দল নেই।
তাদের কোনো দল থাকতে পারে না। সমাজের সব থেকে নিকৃষ্ট অপরাধ ধর্ষণ। ধর্ষণের শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারলে, সমাজ থেকে ধর্ষণ নির্মূল করতে না পারলে দেশ নিয়ে স্বপ্ন দেখে কোনো লাভ নেই।