প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ১৩ মার্চ, ২০২৫, ৯:০০ এএম (ভিজিট : ১৪৬)

ছবি : সময়ের আলো
রোহিঙ্গাদের নিয়ে বাংলাদেশ বলা যায় মহা বিপাকে আছে। না পারছে ধরতে, না পারছে ছাড়তে। নিজেদের দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে অনুপ্রবেশ করে প্রতিবেশী বাংলাদেশে। অস্থায়ীভাবে বাস করতে শুরু করে। বাংলাদেশের মানুষ সাময়িক সময়ের জন্য তা মেনে নেয়। এখন বলা যায় ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। রোহিঙ্গারা যেন অক্টোপাসের মতো আঁকড়ে আছে বাংলাদেশকে। বাংলাদেশের মানুষ রোহিঙ্গাদের থেকে মুক্তি চাচ্ছে। কোনোভাবেই মুক্তি পাচ্ছে না।
রোহিঙ্গা সম্প্রদায় হচ্ছে মিয়ানমার রাষ্ট্রের উত্তর রাখাইন প্রদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠী। কয়েকশ বছর আগে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের বাসস্থান ছিল রাখাইন প্রদেশে। ১৯৮২ সালে মিয়ানমার রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব আইনে তাদের বঞ্চিত করা হয়।
১৯৭৮ সাল থেকে রোহিঙ্গা সম্প্রদায় বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হয়েছে। বলপূর্বক শ্রম, বেআইনি গ্রেফতার, অনির্দিষ্টকালের জন্য আটক, নির্যাতন, হত্যা, শ্লীলতাহানি, বাড়িঘর ও মসজিদ ভাঙচুর, গতিবিধির নিয়ন্ত্রণ, উৎখাত, শিক্ষার ওপর নিষেধাজ্ঞা, চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত এবং বাধ্যতামূলক জন্মনিয়ন্ত্রণসহ নানারকম অত্যাচার-অবিচার করা হতো রোহিঙ্গাদের ওপর।
সংখ্যাগুরু বৌদ্ধ সম্প্রদায় এবং রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের শিকার হওয়ায় বহু রোহিঙ্গা প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হন। আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে রোহিঙ্গা সম্প্রদায় একদিকে উদ্বাস্তু অন্যদিকে রাষ্ট্রহীন। অধিকাংশ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আইনগত মর্যাদা থেকে বঞ্চিত। তার মূল কারণ বাংলাদেশ সরকার ১৯৫১ সালের রিফিউজি কনভেনশন (দ্য রিফিউজি কনভেনশন) আইন অনুমোদন করেনি এমনকি স্টেটলেস কনভেনশন অথবা দেশীয় আইন যা উদ্বাস্তুদের সামাজিক স্বীকারোক্তি অথবা তাদের আশ্রয় প্রদান এই দুটো আইনের কোনোটাই প্রণয়ন করা হয়নি।
তারপরও ১৯৭০ সাল থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বাংলাদেশে উদ্বাস্তু হয়ে বাস করতে শুরু করে। ২০১৭ সালে আনুমানিক ১০ লাখের মতো শরণার্থী বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছিল। বর্তমানে এই সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ। অধিকাংশ শরণার্থী টেকনাফ-কক্সবাজার হাইওয়ে বরাবর অবস্থিত নাফ নদের সীমান্তরালে বাস করে, যা বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্তে অবস্থিত।
যদিও বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতে কিংবা তাদের মানবাধিকার দিতে বাধ্য নয় তারপরও অনেকটা অনুরোধে ঢেকি গেলার মতো। ২০১৬ সালে যখন মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর ভয়ানক অত্যাচার হচ্ছিল সেই সময় বাংলাদেশের অনেক ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান তাদের সহায়তা ও সৌহার্দ্যরে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল।
ইতিহাসে দেখা যায়, রাখাইন রাজ্য (পূর্বতন আরাকান) এবং বাংলাদেশের (পূর্বতন বাংলা) মধ্যে মাইগ্রেশনের প্রচলন ছিল। ১৪০৪ সালে আরাকানের রাজা নিজের রাজ্য থেকে পলায়ন করে সুলতানি আমলে বাংলার রাজধানী গৌড়ে আশ্রয় নেন। ১৭৮৫ সালে আরাকান রাজ্য বার্মার রাজা অধিগ্রহণ করে এবং ১৯৪২-৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অধিক সংখ্যক উদ্বাস্তু আরাকান রাজ্য থেকে বাংলায় অনুপ্রবেশ করে। ১৯৭৮ সালে বর্মাসেনা ‘অপারেশন নাগামিন (ড্রাগন কিং) অভ্যুদ্বয়ে ২ লাখ ২২ হাজার রোহিঙ্গাকে উত্তর আরাকান থেকে বিতাড়িত করায় প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে বার্মা এবং বাংলাদেশ সরকারের আলোচনার মাধ্যমে ১ লাখ ৮৭ হাজার ২৫০ জন উদ্বাস্তু পুনরায় বার্মায় ফিরে যায়।
১৯৯১-৯২ সালে সীমান্ত এলাকায় বিপুল পরিমাণে সেনাদের উপস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের ওপর ব্যাপক নিপীড়ন, বলপূর্বক শ্রম, ধর্ষণ ও হত্যা ঘটে। ফলে প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। ১৯৯২ এবং ২০০৮ সালের মধ্যে উদ্বাস্তুদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়।
বর্তমানে বাংলাদেশে রোহিঙ্গার সংখ্যা ১২ লাখের বেশি। এর মধ্যে ১০ লাখ রোহিঙ্গা এসেছে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে পরবর্তী কয়েক মাসের মধ্যে। নতুন করে আর একজন রোহিঙ্গাকেও আশ্রয় দেওয়ার মতো অবস্থা নেই বাংলাদেশে। তারপরও অবিরত চলছে নানা চাপ। রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদানের চাপ। তাদের এনআইডি প্রদানের চাপ। বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য চিকিৎসা প্রদানের চাপ।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক এসব চাপের কারণে বাংলাদেশ অনেকটাই বিপাকে। যেখানে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর কথা ভাবছে সরকার সেখানে কেউ কেউ চাচ্ছে আরও রোহিঙ্গাকে অনুপ্রবেশ করাতে।
জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশ সফরে আসছেন। তার চার দিনের সফরে রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট ও মানবাধিকারের প্রসঙ্গ অগ্রাধিকার পাবে বলে কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ও জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করবেন।
তাদের শরণার্থী শিবির পরিদর্শনের একটা আলাদা গুরুত্ব আছে। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন থেকেই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের এই ভারী বোঝা বহন করতে পারছে না। যদিও অনেকটা বাধ্য হয়ে বহন করছে। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশের বাড়তি বোঝা বহন করার ক্ষমতা নেই বললেই চলে। যেখানে নিজের দেশের মানুষ সব রকম চাহিদা পূরণ করতে পারছে না সেখানে ১২ লাখের চেয়ে বেশি মানুষের একটা বাড়তি চাপ। শুধু যে আশ্রয় দেওয়া তাই নয়। তাদের মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ। সব মিলিয়ে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে পাঠাতে পারলে যেন বেঁচে যায় বাংলাদেশ ও এ দেশের মানুষ।
জাতিসংঘ মহাসচিবের চার দিনের বাংলাদেশ সফরে যদি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে ইতিবাচক আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয় তা হলে বড় বাঁচা বেঁচে যাবে বাংলাদেশ।
রোহিঙ্গারা অনেকটা মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘার মতো। গলার কাঁটা বললেও অত্যুক্তি হবে না। দীর্ঘদিনের রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট সমাধানে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে নানা রকম আলোচনা-পর্যালোচনা চলছে। জাতিসংঘ মহাসচিব যদি ইতিবাচকভাবে বিষয়টিকে দেখেন, বাংলাদেশের সামর্থ্য কত তা নিয়ে চিন্তা করেন তা হলে সহজেই রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো যাবে। তারা নিজ দেশে ফেরত না গেলে প্রতিদিন প্রতিক্ষণ মাশুল গুনতে হবে বাংলাদেশকে।
লক্ষ্য করা গেছে উদ্বাস্তুদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে যথেষ্ট উদ্বেগ আছে। আছে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ নানা রকম চাপ। রাখাইন প্রদেশে বাস্তবিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন না হওয়ায় ফেরত পাঠানোর পরও অনেকে আবার সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে চলে আসে। যারা পুনরায় অনুপ্রবশ করে তারা নিবন্ধীকরণে রাজি হয় না। এমনকি নিবন্ধীকরণের প্রয়োজনীয়তা পর্যন্ত অনুভব করে না। কোনো ধরনের অনুমতি ছাড়াই তারা অস্থায়ী বাসস্থান নির্মাণ করে বসবাস শুরু করে। আনুমানিক ২ থেকে ৫ লাখ অনিবন্ধনকৃত রোহিঙ্গা জাতি আইনগত পরিচয়হীনভাবে বসবাস করছে।
২০১৬ সালে মিয়ানমারে জাতিগত দাঙ্গার কারণে রোহিঙ্গাদের অপসারণ ঘটে। সে সময় হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। ইউএনসিএইচআরের দাবি রাখাইন প্রদেশে দাঙ্গা ও সেনাবাহিনী পরিচালিত নির্যাতনের কারণে ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বরের মধ্যে প্রায় ১০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এসব রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠাতে অবিরাম চেষ্টা করছে বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু কোনোভাবেই ফেরত পাঠানো যাচ্ছে না। বরং নতুন করে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করে রোহিঙ্গারা।
দেশ ও দেশের মানুষের মনে শান্তি-স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতেই হবে। জাতিসংঘের উচিত হবে সব দেশের সুবিধা-অসুবিধা শক্তি সামর্থ্যরে কথা বিবেচনা করা।
বাংলাদেশ যেখানে নিজের দেশের মানুষের মৌলিক মানবিক চাহিদা ও অধিকার ঠিক মতো নিশ্চিত করতে হিমশিম খেতে হয়, সেখানে পাশের দেশের ১২ লাখের চেয়ে বেশি মানুষকে বছরের পর বছর আশ্রয় দিয়ে নানারকম জ¦ালা-যন্ত্রণা সহ্য করছে তা আসলে কতটা যৌক্তিক? এর একটা বিহীত অবশ্যই হওয়া দরকার। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়ে সমস্যাটার চিরতরে সমাধানের পথ নিশ্চয়ই বের করবেন জাতিসংঘ মহাসচিব। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ সেই প্রত্যাশায় প্রহর গুনছে।