
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। ছবি : সংগৃহীত
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আমন্ত্রণে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বৃহস্পতিবার (১৩ থেকে ১৬ মার্চ) চার দিনের সফরে বাংলাদেশে আসছেন।
জাতিসংঘ মহাসচিবকে ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ হিসেবে ঘোষণা করে গত ৬ মার্চ প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, জাতিসংঘ মহাসচিবের আসন্ন সফরে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে কার্যকর আলোচনা হবে।
বুধবার (১২ মার্চ) প্রধান উপদেষ্টার ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি আবুল কালাম আজাদ মজুমদার জানান, জাতিসংঘ মহাসচিব ও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে এক লাখ রোহিঙ্গা ইফতার করবেন বলে আমরা আশা করছি। ইফতার আয়োজন করা হচ্ছে প্রধান উপদেষ্টার সৌজন্যে। রোহিঙ্গাদের জন্য এটি একটি ইউনিক এক্সপেরিয়েন্স হবে। নানা দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও তারা ওই সময়ে কিছুটা স্বস্তি অনুভব করবেন বলে আশা করছি।
তিনি জানান, জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস চার দিনের সফরে বৃহস্পতিবার ঢাকায় আসবেন। আগামী ১৬ মার্চ তিনি ফিরে যাবেন। এই চার দিন বাংলাদেশে অবস্থানকালে তার মূল কর্মসূচি মূলত ১৪ ও ১৫ মার্চ এই দুই দিন। জাতিসংঘ মহাসচিব ঢাকায় অবতরণের পর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। সাক্ষাৎ শেষে তিনি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চলে যাবেন। তার সঙ্গে একই প্লেনে কক্সবাজার যাবেন প্রধান উপদেষ্টা।
তিনি জানান, কক্সবাজারে প্রধান উপদেষ্টার কিছু কর্মসূচি আছে। তিনি কক্সবাজার বিমানবন্দরের একটি প্রকল্প উদ্বোধন এবং একটি জলবায়ু উদ্বাস্তু কেন্দ্র পরিদর্শন করবেন। পাশাপাশি একটি মডেল মসজিদও উদ্বোধন করবেন। জাতিসংঘ মহাসচিব কক্সবাজার থেকে সরাসরি চলে যাবেন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। সেখানে একটি ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা নিয়ে একটি প্রেজেন্টেশন দেওয়া হবে। সেটার পর যাবেন রোহিঙ্গা কালচারাল সেন্টারে। রোহিঙ্গারা সেখানে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা করবেন। রোহিঙ্গা তরুণদের সঙ্গেও জাতিসংঘ মহাসচিব বসবেন এবং কক্সবাজারে একটি লার্নিং সেন্টার পরিদর্শন করবেন। এই প্রোগ্রামগুলো শেষ হলে তিনি রোহিঙ্গাদের সঙ্গে ইফতার করবেন। সেখানে প্রধান উপদেষ্টাও অংশ নেবেন।
ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি আরও জানান, প্রধান উপদেষ্টা এবং জাতিসংঘ মহাসচিব ওই দিনই কক্সবাজার থেকে ফিরে আসবেন। পরদিন শনিবার মহাসচিব কর্মব্যস্ত দিন কাটাবেন। ঢাকায় জাতিসংঘের কার্যালয় পরিদর্শন করবেন। দুপুরে চারটি সংস্কার কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করবেন, এরপর সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। শনিবার তিনি সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখবেন। সংবাদ সম্মেলনের পর তার সম্মানে প্রধান উপদেষ্টার আয়োজিত ইফতার ও ডিনারে যোগ দেবেন। পরদিন রোববার জাতিসংঘ মহাসচিব সফর শেষে বাংলাদেশ ছেড়ে যাবেন।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা কমে গেছে অনেক। আমরা আশা করছি জাতিসংঘ মহাসচিবের এই সফর মানবিক সহায়তাগুলো জোগাড় করার ওপর একটি ভূমিকা রাখবে। তাদের পুষ্টি সহায়তা খুবই জরুরি। আমরা চাই রোহিঙ্গাদের পুষ্টির চাহিদা যাতে কোনোভাবে কম্প্রোমাইজ না হয়। সেজন্য আন্তর্জাতিক সহায়তার প্রয়োজন হয়, প্রতিমাসে প্রায় ১৫ মিলিয়ন ডলার রোহিঙ্গাদের জন্য দরকার। আমরা আশা করছি জাতিসংঘ মহাসচিবের এই সফর এখানে বিশ্বের নজর ফিরিয়ে আনবে। রোহিঙ্গাদের জন্য যে সহায়তা আসে সেটি যেন বন্ধ না হয়, তাতে যেন কোনও প্রভাব না পড়ে। রোহিঙ্গা বিষয়ে সেপ্টেম্বরে আন্তর্জাতিক সম্মেলন করবে জাতিসংঘ। তার সঙ্গে ফিনল্যান্ড এবং মালয়েশিয়া যুক্ত হয়েছে কো-স্পন্সর হিসেবে। আমরা আশা করছি জাতিসংঘ মহাসচিবের সফরকে ঘিরে এই আয়োজনে আরও ডেভেলপমেন্ট হবে। আমরা চাচ্ছি এই সম্মেলনের মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যার একটা দ্রুত সমাধান তৈরি হোক।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টার কার্যালয় এবং নিউইয়র্কে অবস্থিত জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন এক বার্তায় জানিয়েছে, জাতিসংঘ মহাসচিবের কার্যালয় জানিয়েছে যে আন্তোনিও গুতেরেস আগামী ১৩-১৬ মার্চ বাংলাদেশ সফর করবেন। প্রধান উপদেষ্টার আমন্ত্রণে আন্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশ সফরে আসছেন। প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা ইস্যু ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি-সংক্রান্ত উচ্চ প্রতিনিধি খলিলুর রহমান গত ৭ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কে জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় তিনি প্রধান উপদেষ্টার আমন্ত্রণপত্রটি জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে হস্তান্তর করেন।
এর আগে ২০১৮ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ সফর করেন জাতিসংঘ মহাসচিব গুতেরেস। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অনুরোধে চলতি বছরের দ্বিতীয়ার্ধে জাতিসংঘের রোহিঙ্গাবিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। কাতারের রাজধানী দোহায় এই সম্মেলন আয়োজনের বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং গত ২৬ ফেব্রুয়ারি এক বার্তায় জানিয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে চিঠি দিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। চিঠিতে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের প্রতি জাতিসংঘের দৃঢ় সংহতি এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশের উত্তরণ প্রক্রিয়ার প্রতি জাতিসংঘের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছেন গুতেরেস।
জাতিসংঘ মহাসচিব চিঠিতে বলেন, বাংলাদেশ ও এ অঞ্চলে রোহিঙ্গা সংকটের প্রভাবের পাশাপাশি রাখাইনে মানবিক পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার উদ্বেগের সঙ্গে আমি একমত। রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দাতা হিসেবে বাংলাদেশকে সমর্থনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস অব্যাহত রাখবে জাতিসংঘ। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে জাতিসংঘের প্রতিনিধি দল কীভাবে রাখাইনের জনগোষ্ঠীকে মানবিক সহায়তা এবং জীবিকা নির্বাহের জন্য সর্বোচ্চ সহায়তা দিতে পারে, সে ব্যাপারে সহযোগিতা করতে আমি আমার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছি। রাখাইনসহ পুরো মিয়ানমারের সংকটপূর্ণ এলাকায় মানবিক সহায়তা যেন নিরাপদ, দ্রুত, টেকসই ও নির্বিঘ্ন হয়, তা নিশ্চিত করতে জাতিসংঘ বদ্ধপরিকর। এ জন্য জরুরি ত্রাণ সমন্বয়কারী এবং মিয়ানমারে অবস্থিত জাতিসংঘের আবাসিক ও মানবিক সমন্বয়কারীর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত থাকার বিষয়টি অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। রোহিঙ্গা মুসলিম ও মিয়ানমারের অন্যান্য সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি নিয়ে উচ্চপর্যায়ের এই সম্মেলন নতুন করে সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে এবং দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে ভূমিকা রাখবে। এই প্রক্রিয়াকে সর্বোচ্চ সমর্থনের জন্য (আসিয়ানের) সদস্য দেশগুলোর পরামর্শের পর সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনার জন্য আমরা অপেক্ষায় রয়েছি।
জাতিসংঘ মহাসচিবকে ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ হিসেবে ঘোষণা করে গত ৬ মার্চ প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় এই সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সরকার বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী (স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স) আইন, ২০২১-এর ধারা ২(ক)-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে, জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস-কে আগামী ১৩-১৬ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশ সফরকালীন ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ হিসেবে ঘোষণা করিলো।
আইনে বলা আছে ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ অর্থ সরকার কর্তৃক, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, কোনও বিদেশি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার প্রধান এবং এই আইনের উদ্দেশ্যগুলো পূরণকল্পে, অনুরূপ ব্যক্তি বলে ঘোষিত অন্য কোনও ব্যক্তিও এর অন্তর্ভুক্ত হবেন। আইন অনুযায়ী ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে’ বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী দৈহিক নিরাপত্তা দিয়ে থাকে।