প্রকাশ: বুধবার, ১২ মার্চ, ২০২৫, ১০:৪৬ এএম (ভিজিট : ১৬৪)

উম্মে কুলসুম পপি। পুরোনো ছবি
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রায়ই দেখা মেলে এক উচ্ছল তরুণী কৃষি ও প্রকৃতি নিয়ে নানারকম কনটেন্ট নির্মাণ করছেন। কখনো ফল, কখনো ছোট কোনো ভেষজ গাছ-লতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন তিনি। শুধু ফেসবুক বা ইউটিউবের কনটেন্ট নিয়েই থেমে থাকেননি তিনি। প্রতিনিয়ত মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের সঙ্গে কাজ করছেন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে
কৃষকদের দিচ্ছেন প্রশিক্ষণ, আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি নিয়ে সচেতন করছেন তাদের। তার এ পথচলায় কৃষক তো বটেই সারা দেশে কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে নারীদের পথচলা সুগম হয়েছে।
আলোচিত এই নারীর নাম উম্মে কুলসুম পপি। তিস্তা পাড়ের এই কন্যা নিজের এগ্রো ব্যবসা ও কনটেন্ট বানিয়ে পৌঁছে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। লালমনিরহাটের এক গ্রামীণ পরিবারে জন্ম নেওয়া পপি নিজেকে আগ্রহ ভরে পরিচয় দেন ‘গ্রামের মেয়ে’ হিসেবে। যেখানে মানুষ পদ ও পদবির লোভে ছোটে সেখানে নিজেকে ভিন্নভাবে মেলে ধরতে চেয়েছিলেন পপি। মাটির সুগন্ধ মেখে বেড়ে ওঠায় বিভিন্ন সময়ে তিনি শহরমুখী হলেও আত্মিক টানে ছুটে গেছেন গ্রামে।
মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে পপি পড়াশোনা করতেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানেই আবু সাঈদ আল সাগরের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। বিশ্ববিদ্যালয়ে পপির বিষয় ছিল ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞান আর সাগর ছিলেন পরিসংখ্যানের ছাত্র। কয়েকজন বন্ধু মিলে ‘ক্রিয়েটিভ সোসাইটি’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন সাগর। উপস্থাপনা শেখার পাশাপাশি সেখানে গ্রাফিক্স ডিজাইন এবং ভিডিও এডিটিং শেখানো হতো। সেখানে তাদের সঙ্গে যোগ দেন পপিও। একসময় শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থানের কথা মাথায় রেখে ভিন্নভাবে কিছু করার চিন্তা করছিলেন সবাই।
২০১৬ সালের তাদের তৈরি প্ল্যাটফর্ম ক্রিয়েটিভ সোসাইটি বর্তমানে ‘বিডি অ্যাসিস্ট্যান্ট লিমিটেড’ নামে একটি ব্যবসায়িক উদ্যোগে রূপান্তরিত হয়। নতুন এ প্ল্যাটফর্মে টেকনিক্যাল হোম সার্ভিস নিয়ে কাজ করছিলেন তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ড্রপআউট শিক্ষার্থী এবং এসএসসি ও এইচএসসিতে অকৃতকার্য ১৫-২০ জনকে নিয়ে শুরু হয় তাদের নতুন পথচলা। ক্যাম্পাসের বাইরে নেওয়া হলো অফিস। অভিজ্ঞ টেকনিশিয়ানের মাধ্যমে সবাইকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পরে ফেসবুক পেজের মাধ্যমে অর্ডার সংগ্রহ করে গ্রাহকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিভিন্ন ধরনের টেকনিক্যাল সার্ভিস দিতে থাকে বিডি অ্যাসিস্ট্যান্ট। এটি ছিল পপি ও সাগরদের প্রথম পদক্ষেপ।
একবার বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এক প্রতিযোগিতায় অংশ নেন পপি ও তার বন্ধুরা। তাদের বিজনেস আইডিয়ার জন্য বিডি অ্যাসিস্ট্যান্ট এ প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পায়। প্রতিযোগিতার এক পর্যায়ে মুম্বাই যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। বাড়ি থেকে বাধা পেয়ে পপি যেতে না পারলেও বিডি অ্যাসিস্ট্যান্টের পক্ষ থেকে সাগর সেখানে যুক্ত হন। এর পরপরই পপি ও সাগরের বিয়ে হয়। ব্যবসা নিয়ে বৃহৎ পরিসরে ভাবা শুরু করেন পপি।
করোনা মহামারির সময়ে ২০২০ সালে থমকে যায় বিডি অ্যাসিস্ট্যান্টের কাজ। কাজ না পাওয়ায় স্থবির হয়ে পড়ে অফিসের কার্যক্রম। কিন্তু হাল ছাড়তে রাজি নন পপি। সে সময় আমের মৌসুম চলছিল। মৌসুমি ফলের ব্যাপক চাহিদা মাথায় রেখে পপি আর সাগর অনলাইনে রংপুরের বিখ্যাত হাঁড়িভাঙা আম বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন। এরই মধ্য দিয়ে শুরু হয় পপি-সাগরের নতুন উদ্যোগ ‘প্রিমিয়াম ফ্রুটস’। পরবর্তীতে নিজেরা সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে আমবাগান ইজারা নেন। সেখানে বিষমুক্ত আম উৎপাদন করেন এবং বাগানের বিষমুক্ত আমের ভিডিও আপলোড করতে থাকেন ফেসবুক ও ইউটিউবে। সেসব ভিডিও দেখে গ্রাহকদের আস্থা বেড়ে যায়। পপি এখন শুধু হাঁড়িভাঙা আমই সরবরাহ করেন না, বিষমুক্ত বিভিন্ন মৌসুমি ফল সরবরাহ করেন সারা দেশে।
বাংলাদেশিদের মধ্যে অনলাইনে কৃষি কমিউনিটিতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে সফলভাবে নিজেকে মেলে ধরেছেন উম্মে কুলসুম পপি। ফেসবুকে তার দুটি পেজের একটিতে ২.৪ মিলিয়ন (২৪ লাখ) এবং অন্যটিতে ৯ লাখ ৭২ হাজার ফলোয়ার রয়েছে। ভিডিও কনটেন্ট তৈরি এবং ব্যবসা একই সূত্রে গেঁথেছেন পপি।
কৃষির প্রতি গভীর অনুরাগ থেকে তিনি এই বিষয়ে ক্রমাগত শিখছেন। নিজেই এই শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে তিনি বেছে নিয়েছেন কনটেন্ট ক্রিয়েটিংকে। প্রকৃতির কাছাকাছি থাকতে চাওয়ার অদম্য ইচ্ছেকে সম্বল করে পপি ও সাগর শুরু করছেন এগ্রি ট্যুরিজম। রংপুর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে তাদের নিজস্ব কৃষি প্রকল্পকে ঘিরে শুরু করেছেন এই নতুন অধ্যায়। আগ্রহী মানুষরা সেখানে ঘুরতে যাওয়ার পাশাপাশি সেখানে উৎপাদিত ফসল তুলে খেতে পারবেন। বাগান ঘুরে দেখতে গিয়ে নিজ হাতে ফল পেড়ে খাওয়ার ইচ্ছেও পূরণ হবে সেখানে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মা ও মাটির গন্ধ এভাবেই ছড়িয়ে যেতে চান এই তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা।