
আমরা তখন শহরতলীর এক উচ্চবিদ্যালয়ে ক্লাস এইটে পড়ি। গ্রাম থেকে আমরা চার বন্ধু দলবেঁধে স্কুলে যেতাম সেসময়। দু’পায়া পথ মাড়িয়ে নৌকায় পার হয়ে আরও কিছুটা পথ হাঁটতে হতো আমাদের। স্কুল শেষে এভাবেই ফিরতে হতো বাড়ি। এর মধ্যে বাটন ফোনে রেডিও ছেড়ে আমরা গান শুনতাম। গান নিয়ে আমাদের তেমন পছন্দের বালাই ছিল না। তবে সুমন ছিল এ ব্যাপারে একরোখা। তার শুধু দুঃখ-কষ্ট বা বেদনাভরা গানই ভালো লাগত। আমরা এ নিয়ে তার সঙ্গে ঠাট্টা করতাম। বলতাম, ‘তোকে তো এখনো সে ছেড়ে যায়নি, তোর এত কষ্টের গান ভালো লাগে কেন?’ সে বলত, ‘একদিন তোদেরও ভালো লাগবে।’ আমরা হাসতাম।
সময়ের পিঠে চড়ে সময় গড়িয়ে যায়। আমরা বছর বছর নতুন ক্লাসে বসি। বয়স বাড়তে থাকে আমাদের। অবচেতনে আমাদেরও ভালো লাগতে থাকে দুঃখের গান। কষ্টের গান শুনলেই মনে হয়, গানটি একান্ত আমার। মনও খানিকটা ভালো হয়ে যায়। অথচ এ গানের কথার সঙ্গে জীবনের কোনো মিল খুঁজে পাই না। তবুও মনে হয়, দুঃখের গানগুলো আমার। দুঃখের গানগুলোই বেজে যায় সময়-অসময়ে।
চলতে-ফিরতে দেখলাম, দুঃখের গানগুলো শুধু আমারই ভালো লাগে না; প্রায় সবারও ভালো লাগে। বেশিরভাগ মানুষই দুঃখের গান শুনতে পছন্দ করেন। ভালোবাসেন। কিন্তু কেন?
একাধিক গবেষণায় দাবি করা হয়েছে, দুঃখের গানই মন বেশি ভালো রাখে। যদিও এর প্রভাব ব্যক্তিবিশেষে ভিন্ন। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, দুশ্চিন্তা, নেতিবাচক চিন্তা অথবা একাকিত্বের অনুভূতি থেকে অনেকটাই রেহাই দিতে পারে দুঃখের গান।
‘দুঃখের গান বা ঢিমে তালে চলা মিউজ়িক শুনলে নাকি আঠার মতো লেগে থাকা হতাশা ও অবসাদ অনেকখানি দূর হয়,’ বলেছেন আমেরিকার ইয়েল ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীরা। তারা দুঃখের গান নিয়ে বেশ বড়সড় গবেষণাই করে ফেলেছেন। এই বিষয়ে প্রতিবেদনও ছাপা হয়েছে‘দ্য জার্নাল অফ এস্থেটিক এডুকেশন’-এ। এই বিষয়ে ঐক্যমত পোষণ করেছেন ব্রিটেনের ‘মন্টফোর্ট ইউনিভার্সিটি’-র গবেষকেরাও। তারা দাবি করেছেন, এমন গানে যে কোনও নেতিবাচক ভাবনা দূর হতে পারে। অতিরিক্ত উদ্বেগ বা উৎকণ্ঠায় যারা ভুগছেন, তারা যদি মিনিট দশেকও এমন গান শোনেন, তা হলে চিন্তার বোঝা অনেক নেমে যাবে। প্রচণ্ড শারীরিক যন্ত্রণা হলে বা উদ্বেগে যখন হৃৎস্পন্দন, নাড়ির গতি ও রক্তের চাপ বেড়ে যায় যায়, তখন এমন গানের সুরে তা কমতে শুরু করে।
দুঃখ বা বেদনার গান শুনলে পুরনো স্মৃতি তাজা হয়ে ওঠে। ছোটবেলার কথা, আনন্দের কোনও মুহূর্ত বা প্রিয়জনের সঙ্গে কাটানো মুহূর্তেরা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। ফলে মনেও আনন্দের অনুভূতি জাগে। আবার কখনো কখনো দুঃখের গান শুনলে মন খারাপ হয়। পুরনো স্মৃতিরা মনের মধ্যে হানা দিয়ে বেদনা জাগায়।
মনে রাখতে হবে, ইয়েল ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীরা যে গবেষণা করেছেন, এটি যে সকলের ক্ষেত্রেই সমান কার্যকরী হবে, তা কিন্তু নয়।