ই-পেপার মঙ্গলবার ১১ মার্চ ২০২৫
মঙ্গলবার ১১ মার্চ ২০২৫
ই-পেপার

মঙ্গলবার ১১ মার্চ ২০২৫

গরিবের বাঁচা-মরা কার হাতে
প্রকাশ: সোমবার, ১০ মার্চ, ২০২৫, ১০:১৩ এএম  (ভিজিট : ৯৮)

এ দেশের আর সাধারণ মানুষেরা কী অবস্থায় আছে ভাবলেই যেন অস্থির লাগে। দম বন্ধ হয়ে আসে। স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে সাধারণ ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আমাদের যেসব নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য পাওয়ার কথা, সেসব নিয়ন্ত্রণের বাইরে। বাজারে যেতে হয় সবাইকেই। সংসারও রয়েছে সবার। সাধারণ মানুষের আয়ের উৎস তো আর অন্য কিছু না। সেখানে হিসাব করেই সবাই খায়। তবু হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। সেই সাধারণ এবং যাদের গরিব বলে আখ্যা দেওয়া তাদের রাস্তার পাশের খাবারের দোকান থেকে ঘরে মাদুর পেতে খাবার পর্যন্ত জোগান দিতে পেটে পাথর বাঁধার সময় এসেছে। 

দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সমন্বয়হীনতা লাগাম ছাড়িয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। ‘সমন্বয়’ কথাটি দিয়ে যা-ই বোঝানো হোক, বাংলাদেশে ‘মূল্য সমন্বয়’ বলতে সম্ভবত শুধু মূল্যবৃদ্ধিই বোঝানো হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে যখন কোনো পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি হয়, তখন তার সঙ্গে ‘সমন্বয়’ করে দেশে ওই পণ্যের দাম বাড়ানো হয় ঠিকই, কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে যখন পণ্যের দাম কমে, তখন তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দেশের বাজারে সেই পণ্যের দাম কমতে দেখা যায় না।
শফিক, ছাত্র, পড়েন হাবিবুল্লাহ কলেজে। বাবা রিকশাচালক। শান্তিনগরের পাশের ফুটপাথের দোকানে কলেজ থেকে বেরিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে মেসে ফিরতেন। মেসের মিলের চেয়ে ফুটপাথের দোকানে ভাত, ডিম, ডাল তার দামে পোষাতো আর খেতেও মজা লাগত। খালাদের চেয়ে রান্নায় একটু বৈচিত্র্যও পেতেন। বাবা রিকশা চালিয়ে তাকে পুরো খরচের জোগান দিতে পারেন না। পড়ার সময় থেকে একটু সময় বাঁচিয়ে দুটি টিউশনি করে যা পান তা দিয়ে কোনোরকম দিন চলে যেত, এখন আর দিন চলে না। এমনকি বিকালবেলার এক ঠোঙা দিব্যি ঝালমুড়ি ১০ টাকায় হয়ে যেত। এখন সেই ঝালমুড়ির দাম ১৫ টাকা। এক প্লেট ছোলাবুট-দুটো পেয়াজু দিয়ে ১০ টাকা ছিল তার দাম বেড়ে ২০ টাকা। 

১ প্লেট ভাত, এক গোল্লা আলুভর্তা, ডাল আর অর্ধেক ডিম ভাজা কয়েক দিন আগেও ছিল ‘এক প্লেট ভাত ১০ টাকা, আলুভর্তা ৫ টাকা, ডাল ফ্রি, আর অর্ধেক ডিম ভাজা ১৫ টাকা। ৩০ টাকায় দিব্যি দুপুরের খাবার হয়ে যেত। এখন তার দাম বেড়ে ভাত এক প্লেট ১৫ টাকা, আলুভর্তা ১০ টাকা, ডাল ৫ টাকা, অর্ধেক ডিম ভাজা ২০ টাকা।
সকালের নাশতা পরোটা ৫ টাকা, সবজি ১০ টাকা। ডাল ছিল ফ্রি। এখন সেই নাশতার পরোটা ১০ টাকা, সবজি-ডাল ২০ টাকা। বিকালে ১০ টাকার ঝালমুড়ি। রাতে মেসে ফিরে ভাত-সবজি-মাছ মিলে মিল ছিল ৪৫ টাকা। এখন সেই মিল বেড়ে ৬০ টাকা।

টিউশনি একটি বাড়িয়ে দিয়েও ঢাকায় পড়াশোনা করে কোনো বিলাসিতা না করে শুধু খেয়ে বেঁচে থাকা শফিকের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়েছে। দোকানদাররা কী করব, ‘তেলসহ আলু, চাল-ডাল সব কিছুর দাম যে হারে বাড়ছে, তারাই বা কী করব?’ এমন করেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন শফিক। 

জুরাইন রেলগেটে মোহাম্মদ আলীর শরবতের দোকান। গতকাল সন্ধ্যায় বাসায় যাওয়ার পথে সিএনজির জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে এলোভেরা কিনব ভেবে এগিয়ে গেলাম, মোহাম্মদ আলীর মুখ থমথমে। জানতে চাইলাম আলী ভাই কী খবর, দুটো এলোভেরার ডাঁট দেন, মুখ কালা ক্যান?

আলী ভাই ছলছল চোখে উত্তর দিল, আফা কোনোদিন দেখছেন আমি না হাইসা থাকি। কিন্তু কেউ তো এখন শরবত খাইতে চায় না, বললাম কী হইছে? মানুষ পেডে ভাত পায় না আর খাইব শরবত। 

এলোভেরার ডাঁট পলিতে (পলিথিন) ভরতে ভরতে বলল দ্যান ৫৫ টাকা, ৫ টাকা কমাইয়া দিলাম। আমি তো হতবাক! কেন? ৪০ টাকায় তো গত সপ্তাহে নিলাম। ২০ টাকা করে। ‘আফা, এডাই কইতেছিলাম, এলোভেরার দাম বাড়ছে এহন ৩০ টাকা ডাঁট, চিনির দামও বাড়ছে, পাকা পেঁপে ৬০ টাকা হইলে একটা কেনতে পারতাম এখন ১০০ টাকাও পাই না, এক গ্লাস শরবত ১৫ টাকায় বেচতাম, এখন খরচই তো হয় ১৫ টাকা। কেমনে ব্যবসা কইরা পোলাপান নিয়া বাঁচমু। আমি কিছুটা তথৈবচ হয়ে ফিরলাম!

দাম বাড়ার কারণ সম্পর্কে পাগলার আলাউদ্দিন হোটেলের মালিক (ঝুপড়ি হোটেল) মালিক আলাউদ্দিন ভাই আলী শরীফ বলেন, ‘আগে আলু, ডাল, ডিমসহ সবকিছুর দাম নাগালের মধ্যে ছিল। এ জন্য হোটেলে খাবারের দাম ছিল কম। ডাল ফ্রি ছিল। ডিম ভাজি, ভাতের প্লেট, যেকোনো ভর্তা সবকিছুর দাম কম ছিল। এখন আর ফ্রি দিলে পোষায় না। দাম বেড়েছে দ্বিগুণ। স্টাফদের বেতন বেড়েছে। ব্যবসা করেই আমাদের বাঁচতে হয়, ক্যামনে কী করা, বলেন?

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে ফুটপাথের খাবার হোটেলে কী ধরনের প্রভাব পড়েছে সে সম্পর্কে কথা হয় জাফর নামের আরেকজন দিনমজুরের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সব জায়গাতেই এখন দাম বেশি। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশাÑশুধু নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম কমানো। এ ছাড়া খেটে খাওয়া মানুষের আর কোনো দাবি নাই। তিন বেলা ভাত খাওয়ার জায়গায় এখন আমরা কোনোভাবে দুই বেলা খাচ্ছি। দৈনিক পাঁচশ টাকা আয় করলে যদি দেড়-দুইশ টাকা খেতেই খরচ হয়, তা হলে সংসার চালাব কীভাবে?’ 

পল্টন মোড়ে চিকেন ফ্রাই বিক্রি করত কলিম চাচা। চিকেন কলিম নামেই সবাই তাকে চিনত। চাচার সঙ্গে কথা হলে সে জানাল ১৩০ টাকার ব্রয়লার মুরগি কেন ২৬০ টাকায় কিনতে হচ্ছে, কেমনে চিকেন ফ্রাই বেঁচুম। চা বেঁচুম, যে চায়ের টং দোকানের চায়ের দাম ছিল যেখানে ৫ টাকা এখন তা বেড়ে হয়েছে ১০ টাকা।  এখন রিকশা চালাই। তাতেও জ্বালা কম নাই। হাঁপানি, পাইরা উঠি না। 

বিশ্ববাজারে প্রায় প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম কমছে, আর আমাদের বেড়েই চলেছে।  কার্ড করে দেওয়ার আগপর্যন্ত করোনার পর টিসিবির ট্রাকের পেছনে মানুষের অসহায়ত্বের যে দৌড় আমরা দেখেছি, তা-ও আদৌ ভোলার নয়।
বাজারে গেলে বা রান্নাঘরে ঢুকলে বা খাবার টেবিলে বসলেই বোঝা যায়, দ্রব্যমূল্য কতটা বিষধর সাপ হয়ে মানুষের গলা প্যাঁচিয়ে ধরেছে। আর ঘরে রান্না না করলেও বাজারে না গেলেও দোকানে বা হোটেল-রেস্তোরাঁয় খেতে গেলে বা স্ট্রিটফুডের দিকে তাকালেও বোঝা যায়। 

‘স্রোতের ভিতরে ঘূর্ণি, ঘূর্ণির ভিতরে স্তব্ধ
আয়ু 
লেখো আয়ু লেখো আয়ু,
এতো কথা বলো কেনো? 
চুপ করো, শব্দহীন হও’

এসব লাইন যেন অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলছে সবাই। রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক অধিকারের চাপে পেটের অধিকার এখন চ্যাপটা। 

মার্চে প্রধান আটটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানিমূল্য ও খুচরা বাজার তুলনা করে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেল, পাম অয়েল, চিনি, আটা তৈরির গম, পেঁয়াজ, মসুর ডাল, ছোলা ও মটরের ডালÑআটটি পণ্যের দাম রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর সময়কার তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে কমলেও দেশের বাজারে তার কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। পেঁয়াজ কিংবা সয়াবিন তেলের দাম বিশ্ববাজারে কমলেও দেশে উল্টো বেড়েছে। চিনির দাম বিশ্ববাজারে যা বেড়েছে, দেশে বেড়েছে তার দ্বিগুণ। ডালের দাম বিশ্ববাজারে যে হারে কমেছে, দেশে সে হারে কমেনি।

দেখা গেছে যে নভেম্বর ২০২২ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২৩ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম কমলেও একই সময়ে স্থানীয় বাজারে সয়াবিন তেলের দাম কমেনি। দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের এই অস্বাভাবিক মূল্যের পেছনে একদিকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সরকারের ভুল নীতি ও বারবার মূল্যবৃদ্ধি, অন্যদিকে দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের বাজারে অল্প কিছু কোম্পানির একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও সরকারের তদারকের অভাবই দায়ী।
অর্থনীতি ও বাজার এই দুই জায়গাতেই সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে, যে কারণে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ঝরে পড়ছেন এবং পণ্যের মূল্য বেড়ে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। মানুষ বাজার করতে গিয়ে এখন কাঁদছেন এবং সাধারণ মানুষ আর কতটা চুপ করে শব্দহীন হয়ে বেঁচে থাকবেন? সেই চুপ থাকা কি তার পেট শুনবে? বেঁচে থাকার কায়দা আসলে কি? কার হাতে রয়েছে তাদের বাঁচা-মরার উপাখ্যান? 

আঁখি সিদ্দিকা 
প্রাবন্ধিক




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ। নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।
ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close