ই-পেপার মঙ্গলবার ১১ মার্চ ২০২৫
মঙ্গলবার ১১ মার্চ ২০২৫
ই-পেপার

মঙ্গলবার ১১ মার্চ ২০২৫

নেতানিয়াহু গাজাকে ভেঙে ফেলতে পারবেন না
প্রকাশ: সোমবার, ১০ মার্চ, ২০২৫, ১০:০৮ এএম আপডেট: ১০.০৩.২০২৫ ১০:০৯ এএম  (ভিজিট : ১৫৫)

বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু কীভাবে গাজাকে দখল করে নিতে চান ও গাজার মানুষেরা কীভাবে এর বিরুদ্ধে লড়াই করছে, করবে সেই বিষয়ে আলজাজিরাতে একটি মতামত প্রকাশ করেন ফারাহ যাইনা। সময়ের আলোর পাঠকের জন্য লেখাটি অনুবাদ করেছেন কৃপাসিন্ধু পাল

২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসের মধ্যে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু প্রায় ১৯ লাখ ফিলিস্তিনিকে বাস্তুচ্যুত করেছেন। বলতে গেলে প্রায় পুরো গাজার জনগোষ্ঠীকে। এতে তিনি নিশ্চয়ই গর্বিত। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী এখন গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম লেখাতে পারেন সেই ব্যক্তি হিসেবে, যিনি এককভাবে সবচেয়ে কম পরিসরের ভেতরে সর্বাধিকসংখ্যক মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেছেন। 

আমি নিজেই এই ১৯ লাখ মানুষের মধ্যে একজন। আমাকে দুবার বাস্তুচ্যুত হতে হয়েছে। প্রথমবার গণহত্যামূলক যুদ্ধের শুরুতে, তারপর এক বছর পর আবারও।

অনেক ফিলিস্তিনি পরিবার একাধিকবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে, কেউ কেউ ১০ বার বা তারও বেশি। এটি ছিল নেতানিয়াহুর সুস্পষ্ট কৌশল আমাদের বিভক্ত করার জন্য। উত্তরকে দক্ষিণ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল। ‘উত্তরবাসীদের’ জোরপূর্বক দক্ষিণে পাঠানো হয়। তারপর ‘দক্ষিণবাসী’ এবং অন্যান্য বাস্তুচ্যুতকে কেন্দ্রের দিকে সরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এতেও তার সন্তুষ্টি আসেনি। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী গাজা উপত্যকা জুড়ে, বিশেষত উত্তর ও দক্ষিণে, ব্যাপকভাবে বাড়িঘর ধ্বংসের অনুমোদন দেন। পাশাপাশি আমাদের অনাহারে রাখার জন্য মানবিক সহায়তা অবরুদ্ধ করার নির্দেশও দেন।

জাতিসংঘের মানবিকবিষয়ক সমন্বয় কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গাজা উপত্যকার ৯২ শতাংশ বাড়িঘর, সংখ্যায় যা প্রায় ৪,৩৬,০০০ কাঠামো, ইসরাইলি আগ্রাসনের ফলে ধ্বংস হয়েছে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আল-মিজান সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটসের মতে, যুদ্ধবিরতির মধ্যেও রাফাহতে ইসরাইলি সেনাবাহিনী ঘরবাড়ি ধ্বংস করা থামায়নি। 
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) মতে, জানুয়ারি পর্যন্ত ২০ লাখের বেশি মানুষ পুরোপুরি খাদ্য সহায়তার ওপর নির্ভরশীল ছিল এবং কয়েক লাখ মানুষ ‘দুর্যোগপূর্ণ মাত্রার খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার’ সম্মুখীন হয়েছিল।
নেতানিয়াহু এখন আবার সব মানবিক সহায়তা বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং পুনরায় উত্তরের ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক দক্ষিণে ঠেলে দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন। তার উদ্দেশ্য স্পষ্ট। আমাদের সমাজকে টুকরো টুকরো করা, আমাদের দুর্বল ও বিভক্ত করা, চরম বঞ্চনার 

মাধ্যমে আমাদের একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো। কিন্তু গত ১৬ মাসে তার এই কৌশল ব্যর্থ হয়েছে এবং এটি আবারও ব্যর্থ হবে।

গণহত্যার এই যুদ্ধের মধ্যেও গাজার জনগণ একে অপরের প্রতি অসীম সংহতি দেখিয়েছে। যার বাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল, সে উদ্বাস্তুদের জন্য আশ্রয় খুলে দিয়েছে, পরিবার, বন্ধু, প্রতিবেশী এমনকি অপরিচিতদের জন্যও। যার কাছে সামান্য খাবার ছিল, সে তা অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছে।

২০২৩ সালের ডিসেম্বরে যখন আমরা আমাদের এলাকা শেখ রাদওয়ানে অবরোধের মধ্যে ছিলাম, তখন আমরা জানালা দিয়ে আমাদের প্রতিবেশী এবং তার মেয়ের জন্য পানির বোতল ছুড়ে দিতাম, যাতে তারা অন্তত কিছু পান করতে পারে। আমাদের বাড়ির পাশের দেয়াল টপকে আমরা খাবারও সরবরাহ করতাম যারা তীব্র সংকটে ছিল। আমাদের দ্বিতীয়বার বাস্তুচ্যুত হওয়ার সময়, আমার বাবার এক বন্ধু দক্ষিণে তার বাড়ির দরজা আমাদের জন্য খুলে দিয়েছিলেন, যেখানে আমরা চার মাস ছিলাম।

১৫ জানুয়ারি যখন যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হলো, তখন গাজার জনগণ নেতানিয়াহুর ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ কৌশলের বিরুদ্ধে জয়ী হলো। চার দিন পর, রাফাহ থেকে কিছু উদ্বাস্তু তাদের বাড়ির পথে ফিরতে পারল। তারপর ২৭ জানুয়ারি এলো ‘বড় প্রত্যাবর্তন’। লাখ লাখ ফিলিস্তিনি উত্তরের দিকে ফিরে যেতে লাগল।

কিন্তু বেশিরভাগ বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য ‘প্রত্যাবর্তন’ মানে ছিল গৃহহীনতা আবিষ্কার করা। দীর্ঘ পথ হেঁটে তারা শুধু দেখতে পেল তাদের বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে। গাজায় এখন ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া বাড়িগুলোর বর্ণনা দিতে আমরা যে শব্দ ব্যবহার করি তা হলো ‘বিস্কুট’, একটি বাড়ি যেটিকে চেপে সমানভাবে চূর্ণ করে ফেলা হয়েছে।
এই গৃহহীন মানুষদের হাতে বিকল্প ছিল খুব কম। স্কুলগুলোর শরণার্থী শিবিরে থাকা, খোলা জায়গায় তাঁবু খাটানো বা বাড়ির ধ্বংসস্তূপের পাশে আশ্রয় নেওয়া, অথবা যেকোনো অবশিষ্ট দেয়াল মেরামত করে সেগুলোকে বসবাসযোগ্য করে তোলা। ভারী বৃষ্টি, প্রবল বাতাস ও ঠান্ডার মধ্যে পরিবারগুলো প্রচণ্ড কষ্ট করছে। 

অনেকেই ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করতে গিয়ে, মেরামতের চেষ্টা করতে গিয়ে বা হারিয়ে যাওয়া জিনিসপত্র খুঁজতে গিয়ে তাদের স্বজনদের মরদেহ খুঁজে পেয়েছে এবং তাদের সমাধিস্থ করেছে। তবে এই কঠিন বাস্তবতার মধ্যেও ফিলিস্তিনিরা এখনও একে অপরের প্রতি সংহতি দেখাচ্ছে।

মানুষ তাদের সামান্য খাবার, পানি ও বসবাসের স্থান পর্যন্ত ভাগ করে নিচ্ছে। প্রতিবেশীরা একসঙ্গে ভাঙা দেয়াল ও ছাদ মেরামত করছে। যাদের ঘর অর্ধেক ক্ষতিগ্রস্ত, তারা অন্যদের জন্য আশ্রয়ের ব্যবস্থা করছে। স্বেচ্ছাসেবীরা স্কুল, শরণার্থী শিবির ও তাঁবুর ক্যাম্পে খাবার ও পোশাক বিতরণের জন্য উদ্যোগ নিচ্ছে।

কিছু তরুণ প্রতিদিন একত্রিত হয়ে কমিউনিটি রান্নাঘরে খাবার তৈরি করে, যাতে কেউ না খেয়ে থাকে। মানুষ হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ এবং মানসিক স্বাস্থ্য সভার মাধ্যমে একে অপরকে মানসিক সহায়তা দেয়। রাতে পরিবারগুলো একত্রিত হয়ে গল্প শেয়ার করে এবং একে অপরকে সান্ত্বনা দেয়, যাতে একাকিত্বের অনুভূতি কমে।
আমাদের পাড়ার পুরুষরা একটি সময়সূচি তৈরি করেছে, যাতে একে অপরকে ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি মেরামতে সাহায্য করতে পারে। তারা আমাদের জন্য ত্রিপল টাঙিয়ে খুঁটির সাহায্যে মাটিতে শক্তভাবে বেঁধে দিয়েছে এবং 
আমাদের বিধ্বস্ত বাড়ির দেয়াল মেরামত করেছে। আমরা অন্যদের সাহায্য করেছি, আমাদের প্রায় অকেজো হয়ে যাওয়া সৌর প্যানেলের মাধ্যমে সরঞ্জাম চালানোর জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ করে।

‘বাড়ি’ এখন গাজার বেশিরভাগ মানুষের একমাত্র চাওয়া। এটি এমন একটি উষ্ণ স্থান হওয়া উচিত, যেখানে মধুর স্মৃতিগুলো রয়ে যায়, যেখানে আশ্রয় নেওয়া যায় যখন পৃথিবী অসহনীয় হয়ে ওঠে। এটি কোনো তাঁবু, স্কুল বা ধ্বংসস্তূপ হওয়া উচিত নয়। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা এর আগে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে। গাজার জনসংখ্যার তিন-চতুর্থাংশই শরণার্থী বা শরণার্থীদের বংশধর, যারা নাকবার সময় তাদের বাড়িঘর হারিয়েছিল। আমার নিজের পূর্বপুরুষদেরও আল-মাজদাল শহর থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল।

নেতানিয়াহু ও তার মতো অন্য ইসরাইলি নেতারা যা বুঝতে পারেন না, তা হলো, গাজা আমাদের জন্য শুধুই একটি স্থান নয়, এটি আমাদের ‘বাড়ি’। ইসরাইল যতবারই সাহায্য বন্ধ করুক বা আক্রমণ চালিয়ে আমাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করুক, মানুষকে বাস্তুচ্যুত করুক না কেন আমরা আবার গড়ে তুলব। কোনো জাদু দিয়ে নয়, বরং আমাদের সংহতি, দৃঢ়তা এবং বিশ্বের সমর্থনের মাধ্যমে। যে ঐক্য প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসছে, সেটিই এমন একটি সমাজ গড়ে তুলেছে, যা কখনো মুছে যাবে না। এটাই গাজাকে আবার উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করবে।

ফারাহ যাইনা
প্রভাষক
ইউনিভার্সিটি কলেজ অব অ্যাপ্লায়েড সায়েন্স, গাজা




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ। নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।
ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close