ই-পেপার শুক্রবার ১৪ মার্চ ২০২৫
শুক্রবার ১৪ মার্চ ২০২৫
ই-পেপার

শুক্রবার ১৪ মার্চ ২০২৫

দীর্ঘসূত্রতায় বিচারে গলদ
প্রকাশ: সোমবার, ১০ মার্চ, ২০২৫, ৯:১৫ এএম  (ভিজিট : ১৪০)

নারী ও কন্যাশিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে সারা দেশ। যারা বিচারের দাবিতে পথে নেমেছেন, তাদের বেশিরভাগই সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ড চান। সর্বোচ্চ সাজার পক্ষে আছেন বিশ্লেষকদের একাংশও। 

তবে অন্যরা মনে করেন, ধর্ষকের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকলে তা ভিকটিমের প্রাণনাশের আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়। সেইসঙ্গে কঠিন করে তোলে বিচারপ্রাপ্তির সম্ভাবনাও। সর্বোচ্চ শাস্তির বিধানের বিষয়ে মতানৈক্য থাকলেও সব পক্ষই একমত যে, যথাযথ সাক্ষীর অভাবে মামলা মুখ থুবড়ে পড়ে। তাদের মতে, ধর্ষণ প্রতিরোধে বিচারের দীর্ঘসূত্রতার অবসান দরকার। 

সম্প্রতি ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সহিংসতা ও যৌন হয়রানির বিভিন্ন খবর সংবাদমাধ্যমে প্রাধান্য বিস্তার করেছে। ঘরে ঢুকে বাবা-মাকে বেঁধে রেখে ধর্ষণ, স্বামীর কাছ থেকে স্ত্রীকে ছিনিয়ে নিয়ে ধর্ষণ, ৪ বছরের শিশুকে যৌন নির্যাতন, দলবদ্ধ হয়ে ধর্ষণের মতো নৃশংস অপরাধগুলো দখল করছে সংবাদমাধ্যমের পরিসর। সর্বশেষ মাগুড়ায় ৮ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের ঘটনায় ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে সারা দেশ। ধর্ষকের শাস্তির দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা নেমেছেন রাস্তায়। তারা বেশিরভাগই ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ড চান।

নৃবিজ্ঞানী অধ্যাপক বখতিয়ার আহমেদ সময়ের আলোকে বলেন, ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড ভিকটিমের প্রাণনাশের আশঙ্কা বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। সর্বোচ্চ শাস্তির ভয়ে একজন ধর্ষক প্রাণভয়ে নির্যাতনের শিকার নারীকে খুন করে ফেলতে পারে। তার মতে, সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে যে ধরনের সাক্ষ্যপ্রমাণ প্রয়োজন হবে ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে তা সংগ্রহ করাটা বেশ দুরূহ। সে কারণে মৃত্যুদণ্ডের বিধান ভিকটিমের বিপক্ষে যাওয়ার সুযোগ থাকে।

প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া এক তরুণীকে তুলে সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে নিয়ে যায় ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। সেখানে ধর্ষণ করা হয় ওই তরুণীকে। এর সপ্তাহখানেক পর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে আরেক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হয়। এমন কয়েকটি ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার ঘটনায় আলোচনায় আসে ধর্ষণ প্রতিরোধে আইনের সংশোধন। সারা দেশে এ নিয়ে আন্দোলনের পর ২০২০ সালের ১৭ নভেম্বর জাতীয় সংসদে পাস হয় ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) বিল-২০২০’। নতুন আইনের ৯ (১) উপ-ধারায় ‘যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড’-এর স্থলে ‘মৃত্যুদণ্ড-বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান যুক্ত করা হয়’।

সেই আইনের কথা মনে করিয়ে দিয়ে, গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য মারজিয়া প্রভা সময়ের আলোকে বলেন, শুধু মৃত্যুদণ্ডই ধর্ষণ বন্ধে একমাত্র পদক্ষেপ না। ‘ধর্ষণ ও নিপীড়ন বিরুদ্ধে বাংলাদেশ’ ব্যানারে ধর্ষণের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হচ্ছে সেখানে ৯ দফা দাবির কথা বলা হলেও সুপরিকল্পিতভাবে শুধু ‘মৃত্যুদণ্ডের’ দাবিই সামনে আনা হচ্ছে। ন্যায়বিচার নিশ্চিতে বিচারিক প্রক্রিয়াকে কার্যকর করা ও ধর্ষণ মামলা করার ক্ষেত্রে হয়রানি বন্ধ করার প্রশ্নকে সামনে আনেন এই অধিকারকর্মী। 

পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে ধর্ষণের ঘটনায় প্রতিদিন ১৩টিরও বেশি মামলা হচ্ছে। ধর্ষণের পর হত্যা ও আত্মহত্যার ঘটনাও কম নয়। গত ১০ দিনে দেশের বিভিন্ন জেলায় যৌন সহিংসতার ৯টি ঘটনা নথিবদ্ধ করেছে মানবাধিকার সংগঠন ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’। এদিকে দেশব্যাপী হঠাৎ করেই ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি সুপরিকল্পিত কি না তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করছেন অনেকে।

সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক সর্বোচ্চ শাস্তির পক্ষে। সময়ের আলোকে তিনি বলেন, আইন অনুযায়ী যে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান আছে তা দ্রুত কার্যকরের মাধ্যমে ধর্ষণ বন্ধে কার্যকর ভূমিকা রাখা যেতে পারে। সেইসঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হিসেবে সামাজিক সচেতনা বৃদ্ধির মতো কার্যক্রমগুলোও চালিয়ে যাওয়া উচিত। অভিযুক্তদের কঠোর সামাজিক অনুশাসনের মধ্যে রাখার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্য ধর্ষকদের অধিকাংশই সমাজে প্রভাবশালী হওয়ায় তারাই এখন সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করছে। আইন করলেও প্রতিটি সরকারই ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধ বন্ধে তাদের সর্বোচ্চটা কখনো করেনি। আইনের প্রয়োগ হয় না বলেই অপরাধীরা নির্বিঘ্নে বছরের পর বছর এ ধরনের ঘৃণ্য কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। 

বখতিয়ার আহমেদ মনে করেন,  দেশে নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে রাজনৈতিক দলগুলোরও বড় ভূমিকা আছে। এ জন্য আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলকে নারীর স্বাভাবিক চলাচল, নারীর স্বাধীনতা ও নারীর অধিকার প্রশ্নে তাদের দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রতিশ্রুতি পরিষ্কার করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি। এই নৃবিজ্ঞানী বলেন, ধর্ষণরোধে প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলনের। এ ছাড়া আমাদের পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা পদ্ধতিরও বদল করা প্রয়োজন। তবে সামাজিকের চেয়ে রাজনৈতিক সমাধানই এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি কার্যকর ফলাফল বয়ে আনবে।

নারীর প্রতি যৌন নিপীড়ন বন্ধে ও ধর্ষকের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করতে হলে প্রচলিত বিচার প্রক্রিয়াকে ঢেলে সাজানোর ওপর গুরুত্বারোপ করেন অধ্যাপক বখতিয়ার আহমেদ। বলেন, প্রচলিত বিচার প্রক্রিয়ায় ভিকটিমকেই প্রমাণ করতে হয় তিনি নির্যাতনের শিকার। এ ছাড়া ভুক্তভোগী নারীকে নারী হিসেবে না দেখে অনেক ক্ষেত্রে তার পোশাকসহ অন্য বিষয়াদির দিকে দৃষ্টি ফেরানো হয়। ফলে সামাজিক ও মানসিকভাবে ভুক্তভোগীকে আরও বেশি নাজুক অবস্থায় পড়তে হয়। এসব কারণে নির্যাতনের শিকার নারী কিংবা তার পরিবার অনেক ক্ষেত্রে বিচার প্রক্রিয়া পর্যন্ত যেতে চায় না। 

নিম্ন আদালতের সিনিয়র আইনজীবী মঞ্জুর আলম সময়ের আলোকে বলেন, প্রধানত দুইটি কারণে ধর্ষণ মামলাগুলোর বিচার প্রক্রিয়া প্রলম্বিত হয় কিংবা ভিকটিম যথাযথ বিচার পান না। অধিকাংশ ধর্ষণ মামলাতেই সাক্ষী অনুপস্থিত থাকেন। কিংবা যথাযথ সাক্ষী উপস্থিত থাকেন না। আবার আউট অব কোর্ট ভিকটিমের পরিবার আসামি পক্ষের সঙ্গে আপস মীমাংসা করতে বাধ্য হওয়ায় বিচার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায় না। 

সিনিয়র এই আইনজীবী বলেন, আইনে ৯০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করার কথা বলা হলেও এই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিচারকাজ শেষ করার কোনো উদাহরণ নেই। বিচার প্রক্রিয়ার এই দীর্ঘসূত্রতার কারণে ভিকটিম অনেক ক্ষেত্রে যথাযথ বিচার পান না। এ ছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন-সংক্রান্ত মামলা ক্ষেত্রে এর অপপ্রয়োগেরও অনেক উদাহরণ আছে। এসব মামলা নেওয়ার ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, বর্তমানে ধর্ষণ মামলার শুধু মেডিকেল টেস্ট রিপোর্ট দিয়ে মামলা হয় না। এ জন্য ডিএনএ রিপোর্টও প্রয়োজন। ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে যথাযথ বিচার পেতে চিকিৎসক, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও), ডিএনএ টেস্ট এবং ভিকটিম এই চারটি বিষয় বা পক্ষকেই সর্বোচ্চ সততা ও আন্তরিক এবং যথাযথ হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

পুলিশ সদর দফতরের তথ্য বলছে, বিগত দুই বছরে (২০২৩ ও ২০২৪) সারা দেশে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করা হয়েছে ৯ হাজার ৫৮৫টি। আর চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ৩৯২টি ধর্ষণ মামলা হয়েছে সারা দেশে। অর্থাৎ, ২৫ মাসে মামলা করা হয়েছে ৯ হাজার ৯৭৭টি ধর্ষণের ঘটনায়। সেই হিসাবে প্রতি মাসে মামলা হচ্ছে প্রায় ৪০০টি। দৈনিক মামলার সংখ্যা ১৩টিরও বেশি।




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ। নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।
ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close