ই-পেপার মঙ্গলবার ১১ মার্চ ২০২৫
মঙ্গলবার ১১ মার্চ ২০২৫
ই-পেপার

মঙ্গলবার ১১ মার্চ ২০২৫

নারী অগ্রগতির আনন্দেও বিষাদের ছায়া
প্রকাশ: রবিবার, ৯ মার্চ, ২০২৫, ১:৫৩ পিএম  (ভিজিট : ৯৬)

গতকাল বিশ্বব্যাপী পালিত হলো ‘নারী দিবস’। নারীর সম্মানেই দিনটিকে বিশেষ করতে নানা আয়োজন আমাদের দেশেও। করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোতে নারী সহকর্মীদের ফুল, চকলেট, মিষ্টি ও নানা ধরনের উপহার দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়েছে। সেসব ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরছে। আমরা লাভ, কেয়ার, ওয়াও রিঅ্যাক্টে আঙুল ছুঁইয়ে সমর্থন জানাচ্ছি। এটি আনন্দের। গণমাধ্যমেরও রয়েছে বিশেষ বিশেষ আয়োজন। পত্রিকার পাতাভর্তি নারীর সফলতার ফিচার। টেলিভিশনগুলোতে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা। এর বাইরেও যে যার মতো আয়োজন করে সম্মান জানাচ্ছে নারীদের। এই যে সাড়ম্বরে নারী দিবস পালিত হচ্ছে এটি আমাদের সমাজের এগিয়ে যাওয়ার স্বাক্ষর বহন করে। এই যে এত সব আয়োজন, সব যেন আবার মøান হয়ে যায় একই সময়ের দুয়েকটি ঘটনায়। আমাদের শিক্ষা, রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব এবং অর্থনৈতিক অংশগ্রহণে অগ্রগতি এলেও সহিংসতা, প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য এবং অপূর্ণ প্রতিশ্রুতির এক উদ্বেগজনক চিত্র উন্মোচিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। কখনো খবর হয় শিশু ধর্ষণ, কখনো পোশাক, কখনো ধূমপান ইত্যাদি নানাবিধ আনুষঙ্গিক বড় হয়ে ওঠে প্রকৃত নারী উন্নয়নকে বাদ দিয়ে। 

যখন পুরো বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা নারীদের সম্মান রক্ষায় এত সব আয়োজন করছি, ঠিক সেই মুহূর্তে আইসিইউতে মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে মাগুরায় ধর্ষণের শিকার হওয়া শিশু মেয়েটি। হয়তো লেখাটি পাঠকের হাতে পৌঁছানোর আগেই সে মৃত্যুর কাছে পরাজয় বরণ করতে পারে। পরাজয় না বলে বরং মুক্তি বললে বেশি মানানসই হবে সম্ভবত। শিশুটি হয়তো ভাবছে লোলুপ সমাজের কাছে প্রতি ক্ষণ পরাজয়ের শঙ্কা নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যুর মাধ্যমে মুক্তি অনেক স্বস্তির। মেয়েটি কি-ই বা বোঝে? স্কুল থেকে রোজার ছুটি পেয়ে বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল ঈদ করতে। ঈদের ছুটিতে বেড়াতে যাওয়ার মতো আনন্দময় ঘটনা কলঙ্কিত হলো। এরপর কোনো শিশুমেয়েকে একা বেড়াতে যাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চয় কোনো অভিভাবক সাহস দেখাবেন না। 

এই কোমলমতি শিশুদের আনন্দকে বিষাদে পরিণত করার জন্য কে বা কারা দায়ী? মাগুরার মেয়েটির ধর্ষণের শিকার হওয়ার ঘটনাটি রীতিমতো শঙ্কার। গণমাধ্যমের খবর থেকে জানা গেছে, মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার জারিয়া গ্রামের তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে শিশুটি রমজান ও ঈদের ছুটিতে স্কুল বন্ধ থাকায় কয়েক দিন আগে আপন বোনের বাড়ি মাগুরা শহরের নিজনান্দুয়ালি মাঠপাড়া গ্রামে বেড়াতে আসে। বৃহস্পতিবার সকালে বাড়ির পাশে রক্তাক্ত অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে পরিবারের সদস্যরা তাকে মাগুরা ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করেন। পরে অবস্থার অবনতি হলে সেখান থেকে শিশুটিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। বর্তমানে শিশুটি আশঙ্কাজনক অবস্থায় আইসিইউতে চিকিৎসাধীন।

এ ঘটনায় শিশুটির বড় বোনের স্বামী ভগ্নীপতি সজিব হোসেন ও শ্বশুর হিটু শেখকে আটক করেছে পুলিশ। ঘটনার বিশ্লেষণে এখন পর্যন্ত অভিযোগ দুলাভাই ও বোনের শ্বশুরের প্রতি। যিনিই অপরাধী হোন না কেন, দুজন পুরুষই তো শিশুটির আশ্রয়স্থল হওয়ার কথা ছিল। দুলাভাই বড় ভাইয়ের মতো। অভিভাবকও বটে। আর বোনের শ্বশুর? বাবার সম্মানই তো দেওয়া হয় তাকে। এমন ঘটনার পর নারী কার কাছে নিরাপদ বোধ করবে? এ ঘটনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আরও একটি খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে ফরিদপুরের। সেটিও শিশু ধর্ষণের। প্রায়ই এমন ঘটনা ঘটে। হইচই হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু প্রতিবাদী পোস্টও হয়। হয়তো পত্রিকার পাতায় কিছু কলাম বা টকশোর একটা অংশে কিছু আলোচনাও হয়। কিন্তু পরিবর্তন হয় না পরিস্থিতির। নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় না নারীদের। পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে হতাশই হতে হয়। চলতি বছরের শুরুতেই যৌতুকের দাবিতে নারীকে নৃশংসতার শিকার হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। জানুয়ারিতে কুড়িগ্রামের এক ১৬ বছরের বালিকা যৌতুকের মামলা প্রত্যাহার করতে অস্বীকৃতি জানালে তার স্বামী তাকে পুড়িয়ে মারে। ২০১৯ সালের নোয়াখালীর সোনাগাজীর মর্মান্তিক স্মৃতি কখনোই ভুলার নয়। নুসরাত জাহান রাফি নামক এক মাদরাসাছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ জানানোয় জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল, সেই মাদরাসার প্রিন্সিপালও এতে সম্পৃক্ত ছিলেন। 

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) মতে, মাত্র ৩ শতাংশ ধর্ষণের মামলায় সাজা হয়, যা বিচারিক জবাবদিহিতার দুর্বলতাকে নির্দেশ করে। আইনি নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও শিশুবিবাহ থামেনি। ২০২৪ সালের ইউনিসেফের গবেষণায় দেখা গেছে, ৫৯ শতাংশ বাংলাদেশি নারী ১৮ বছরের আগে বিয়ে করে, যা মহামারি-পরবর্তী অর্থনৈতিক সংকটে বেড়েছে। কক্সবাজারে, রোহিঙ্গা শরণার্থী কন্যাশিশুদের ১২ বছর বয়সে বিয়ে দেওয়া হয় দারিদ্র্য ও সংস্কৃতির কারণে। কর্মক্ষেত্রেও নারী শোষণ চলমান। ঢাকার গার্মেন্টস কারখানায় নারী শ্রমিকরা মজুরি চুরি, যৌন হয়রানি এবং অনিরাপদ পরিবেশের মুখোমুখি। ২০২৪ সালের ক্লিন ক্লথেস ক্যাম্পেনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডের পোশাক তৈরি করেও ৮০ শতাংশ শ্রমিক মৌলিক পুষ্টি নিশ্চিত করতে পারে না। এ তো গেল পরিসংখ্যান। 

সাম্প্রতিক আরেকটি ঘটনা উল্লেখ না করলেই নয়। এক উত্ত্যক্তকারীকে আইনের হাত থেকে অনেকটা বাধ্য করে ছাড়িয়ে নিয়ে ফুলেল সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। ঘটনাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে হেনস্থার অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সহকারী বাইন্ডার মোস্তফা আসিফকে বুধবার সন্ধ্যায় গ্রেফতার করে শাহবাগ থানার পুলিশ। হেনস্থার শিকার ছাত্রী এ বিষয়ে প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিসে অভিযোগ করেন এবং পরে শাহবাগ থানায় মামলা করেন। হেনস্থার শিকার ওই ছাত্রী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্টে অভিযুক্ত আফিসের ছবি দিয়ে লেখেন, ‘এই লোকটা আজ আমাকে শাহবাগ থেকে আসার পথে হ্যারাস করেছে। 

আমাকে হুট করে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলে আমার ড্রেস ঠিক নাই, আমি পর্দা করি নাই ইত্যাদি। তার আচরণ খুবই এগ্রেসিভ ছিল। পরে তাকে আমি জিজ্ঞাসা করি, আপনি কোন হলে থাকেন, কোন ডিপার্টমেন্টে পড়েন। বলেন, তিনি এই ক্যাম্পাসের কেউ না।’ 

এরপরই মূলত তাকে আটক করা হয়। কিন্তু পরক্ষণে এই সংবাদ পেয়ে একদল উৎসাহী জনতা শাহবাগ থানায় হাজির হয়ে ওই উত্ত্যক্তকারীকে ছেড়ে দিতে চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। পুলিশকে চাপ প্রয়োগের পাশাপাশি চলে উত্ত্যক্তের শিকার হওয়া মেয়েটিকে নানাভাবে ভয় দেখানো, হুমকি দেওয়া। গণহারে তারা মেয়েটিকে হত্যা ও ধর্ষণের হুমকি দিতে থাকে এক দল। 

সারা রাত এমন পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে অতিবাহিত হওয়ার পর ভোররাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতা ও আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যাওয়ার ব্যাপারে সুরাহা হয়। অর্থাৎ সকালেই তাকে আদালতে তোলা হবে এবং তাকে জামিন দেওয়া হবে। অর্থাৎ জামিনের ব্যাপারেও চুক্তি করা হয় থানায় বসেই। এরপর চুক্তিমোতাবেক ওই উত্ত্যক্তকারীকে জামিন দেওয়া হয়। এরপর তাকে গলায় ফুলের মালা পরিয়ে মিছিল করা হয়। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিন্দার ঝড় উঠলেও অপরাধী কিন্তু মুক্তই। বরং উত্ত্যক্তের শিকার হওয়া মেয়েটি এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এই ঘটনায় নিশ্চয় অপরাধ বাড়বে বৈ কমবে না। 

যে সময়ে পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নারী সমাজকে, অর্থনীতিকে এগিয়ে নিচ্ছে। আন্দোলন সংগ্রামে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ সফলতা সহজ করছে সেই সময়ে নারীর এমন অসম্মান সব আনন্দে বিষাদ ঢেলে দেয়। কাজেই স্পষ্টভাবে বলা যায় বাংলাদেশের নারীদের জন্য মর্যাদার লড়াই এখনও শেষ হয়নি। এ লড়াই নারীর একার নয়, আমার আপনার সবার। আমার মা-বোন-স্ত্রী-কন্যার নিরাপত্তার জন্য লড়াইটা আমাকেই করতে হবে। 

রনি রেজা
প্রাবন্ধিক




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ। নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।
ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close