
পবিত্র রমজান প্রতিটি মুমিনের জন্য আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে বিশেষ উপহার। এই মাসে একটি নফল আদায়ের সওয়াব অন্য মাসের একটি ফরজের সমপরিমাণ। আর একটি ফরজ আদায়ের সওয়াব অন্য মাসের সত্তরটি ফরজের সমপরিমাণ। তাই প্রিয় নবী (সা.) বাকি এগারো মাসের তুলনায় এই মাসে অনেক বেশি আমল করতেন। দান-সদকাও করতেন বেশি বেশি।
হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) ধনসম্পদ ব্যয় করার ব্যাপারে সবার চেয়ে অধিক দানশীল ছিলেন। রমজানে জিবরাইল (আ.) যখন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন, তখন তিনি আরও অধিক দান করতেন। রমজান শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতি রাতেই জিবরাইল (আ.) তাঁর সঙ্গে একবার সাক্ষাৎ করতেন। আর নবীজি (সা.) তাঁকে কুরআন পড়ে শোনাতেন। জিবরাইল যখন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন তখন তিনি রহমতসহ প্রবাহিত বাতাসের চেয়ে অধিক দানশীল হয়ে যেতেন (বুখারি : ১৯০২)।
হাদিসের বক্তব্য ‘প্রবাহিত বাতাসের চেয়ে বেশি দানশীল ছিলেন’ কথার কী অর্থ? হাদিসবিশারদগণ এর বিভিন্ন ব্যাখ্যা করেছেন। এর একটি অর্থ হলো কখনো কখনো প্রবাহিত বাতাস সবার জন্য কল্যাণ বয়ে আনে না। কারও জন্য হয় উপকারী আবার কারও জন্য হয় ক্ষতিকর।
কিন্তু রাসুল (সা.) সমগ্র পৃথিবীর জন্য উপকারী প্রবাহিত বাতাসের মতো। অর্থাৎ তিনি যেমনিভাবে আর্থিক দান-সদকা করতেন, তেমনিভাবে আত্মিক দান-সদকাও করতেন সমানভাবে। ধনসম্পদ খরচ করার পাশাপাশি মানুষকে দ্বীনি ইলম শিক্ষা দান এবং হেদায়েতের বিষয়ে অধিক বেশি তৎপর থাকতেন।
দান-সদকা কাদের করা যায়? দান-সদকার উপযুক্ত পাত্র কে বা কারা? এমনই এক প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিলেন প্রিয় নবী (সা.)। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন সুস্পষ্টভাবে। বর্ণিত হয়েছে, ‘লোকেরা আপনাকে জিজ্ঞেস করছে তারা কী ব্যয় করবে? বলে দিন, যে বস্তুই তোমরা ধনসম্পদ থেকে ব্যয় করবে তা পিতা-মাতা, আত্মীয়স্বজন, এতিম, মিসকিন ও মুসাফিরদের জন্য ব্যয় করো এবং তোমরা যে সৎ কাজ করো আল্লাহ তা সম্যক অবগত’ (সুরা বাকারা : ২১৫)।
মুকাতিল (রহ.) বলেন, এই আয়াতটি হচ্ছে নফল দান সম্পর্কে নির্দেশনা (ইবনে আবি হাতেম : ২/৬১৯)। আয়াতের ভাবার্থ হচ্ছে, হে নবী! মানুষ আপনাকে খরচ করার পাত্র সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে। আপনি তাদের বলে দিন, তারা যেন আয়াতে উল্লেখিত শ্রেণির মানুষের মধ্যে খরচ করে অর্থাৎ দান-সদকা করে।
দান-সদকার ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়, তা হলোÑনিজের পছন্দনীয় এবং উৎকৃষ্ট বস্তু দান করা। অপ্রয়োজনীয় এবং মূল্যহীন বস্তু নয়। এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তেমরা যা ভালোবাসো বা পছন্দ করো তা থেকে ব্যয় না করা পর্যন্ত কখনোই কল্যাণ লাভ করতে পারবে না। আর তোমরা যা কিছু খরচ করো আল্লাহ সে সম্পর্কে অবগত’ (সুরা আলে ইমরান : ৯২)। ইমাম ওয়াকি তার তাফসিরে উল্লেখিত আয়াতের ব্যাখ্যায় আমর ইবনে মায়মুন থেকে বর্ণনা করেন যে, ‘বিররুন’ শব্দের ভাবার্থ জান্নাত (তাফসিরে তাবারি : ৬/৫৮৭)। আয়াতে বলা হয়েছে, যে পর্যন্ত তোমরা তোমাদের পছন্দনীয় এবং উৎকৃষ্ট বস্তু দান না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত জান্নাতে যেতে পারবে না। এই আয়াতের সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি হৃদয়স্পর্শী ঘটনা হাদিসে বর্ণিত আছে।
হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) বলেন, আনসারি সাহাবিদের মধ্যে আবু তালহা (রা.) ছিলেন সবচেয়ে বেশি সম্পদশালী। তিনি তার সমুদয় ধনসম্পদ থেকে বাইরুহা নামক বাগানটিকে সর্বাপেক্ষা বেশি পছন্দ করতেন। বাগানটি মসজিদে নববীর সামনে অবস্থিত ছিল। রাসুল (সা.) প্রায়ই ওই বাগানে যেতেন এবং তার নির্মল পানি পান করতেন।
যখন উপরোক্ত আয়াতটি নাজিল হয় তখন আবু তালহা (রা.) রাসুল (সা.)-এর কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহ তায়ালা এরূপ কথা বলেছেন এবং বাইরুহা নামক বাগানটি হচ্ছে আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় সম্পদ। এ জন্য আমি এটি আল্লাহর পথে সদকা করছি এ আশায় যে, তাঁর কাছে যে প্রতিদান রয়েছে তাই আমার জন্য জমা থাকবে। সুতরাং আপনাকে অধিকার দিলাম, যেভাবে ভালো মনে করেন ওটা বণ্টন করে দিন। রাসুল (সা.) খুশি হয়ে বলেন, বাহ বাহ এটা খুবই উপকারী সম্পদ! বাহ বাহ এটা খুবই উপকারী সম্পদ! এটা খুবই উপকারী সম্পদ! তুমি যা বললে আমি তা শুনলাম।
আমার মতে, তুমি এ সম্পদ তোমার আত্মীয়স্বজনের মধ্যে বণ্টন করে দাও। আবু তালহা (রা.) বলেন, খুব ভালো। অতঃপর তিনি ওটা তার আত্মীয়স্বজন ও চাচাত ভাইদের মাঝে বণ্টন করে দিলেন (বুখারি : ১৪৬১)। আল্লাহ তায়ালা আমাদের এই পবিত্র মাসের গুরুত্ব উপলব্ধি করে সেই অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা এবং বেশি বেশি দান-সদকা করার তওফিক দান করুন।