
নিজস্ব কোনো কোম্পানি বা বৈধ ব্যবসা নেই। নেই নিজস্ব কোনো আয়ের উৎস। অথচ তিনি শত শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। রাজধানীতে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। একের পর এক গড়ে তুলেছেন বিলাসবহুল বাড়ি ও ফ্ল্যাট। এই শত শত কোটি টাকার মালিকানা- তার সবই প্রতারণার মাধ্যমে উপার্জন করা।
তাকে বিশ্বাস করে নিঃস্ব হয়েছেন অনেক সাধারণ মানুষ। এই প্রতারক আর কেউ নন। তিনি হলেন প্রায় ২০ বছর আগে বন্ধ হওয়া হেনোলাক্স কোম্পানির মালিক নুরুল আমিন ও তার স্ত্রী ফাতেমা আমিন দম্পতি। এই দম্পতি প্রতারণা করে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তাদের প্রতারণার শিকার হয়ে কুষ্টিয়ার বাসিন্দা গাজী আনিসুর রহমান জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে শরীরে আগুন দিয়ে আত্মহত্যাও করেন।
নুরুল আমিন ১৯৮১-১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ঢাকার গোপীবাগ এলাকায় কাদের হোমিও হল নামে একটি প্রতিষ্ঠানে ১৫ বছর চাকরি করেন। এরই মধ্যে ১৯৯১ সালে হেনোলাক্স কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। চাকরির পাশাপাশি শুরু করেন ব্যবসা। পরে ১৯৯৬ সালে দীর্ঘ ১৫ বছরের চাকরিটি নুরুল আমিন ছেড়ে দেন। পরিচিতি পায় তার হেনোলাক্স কোম্পানি।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, নরসিংদী জেলার শিবপুর গ্রামের সহজ-সরল হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক নূরুল আমিন খুবই অর্থকষ্টে দিনযাপন করতেন। ত্বক ফর্সা ও মুখের দাগ দূর করার কয়েকটি ক্রিম নিয়ে তিনি হেনোলাক্স নাম দিয়ে শুরু করেন ব্যবসা। হঠাৎ করেই নানা প্রতিকূলতায় ২০০৪ সালে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হন নূরুল আমিন। পরে হেনোলাক্স ফুড নামে খাদ্যপণ্য ও আমিন হারবাল কোম্পানি নামে ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু লোকসানের কারণে দুটি ব্যবসাই ২০১৯ সালে বন্ধ করে দেন। বর্তমানে তিনি নিজেকে আমিন ফুড প্রসেসিং অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং ও আমিন পোলট্রি লিমিটেডের চেয়ারম্যান বলে দাবি করেন। প্রকৃতপক্ষে এসব কোম্পানির কোনোটিরই কার্যক্রম নেই। এমনকি এসব প্রতিষ্ঠানের প্রায় সবগুলোরই ঠিকানা দেখানো হয়েছে ৩/১, পুরানা পল্টন, হেনোলাক্স সেন্টারকে। আর বিভিন্ন ব্যক্তিকে এ কোম্পানির নাম ও সেগুলোতে পার্টনার বানানোর কথা বলে নুরুল আমিন দম্পতি হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। নুরুল আমিন দম্পতি নিজেদের ব্যবসায় অংশীদার বানানোর যে প্রলোভনের ফাঁদ পেতেছিলেন তাতে পা দিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন অনেকেই, যাদের একজন হলেন কুষ্টিয়ার ঠিকাদার গাজী আনিসুর রহমান। কিন্তু সবাই প্রতিবাদ না করলেও গাজী আনিসুর রহমান আত্মাহুতি দিয়ে এই প্রতারক দম্পতির মুখোশ উন্মোচন করেন।
এ ঘটনায় নুরুল আমিন দম্পতির বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় ২০২২ সালের ৫ জুলাই মামলা করা হয়। মামলা নং ৯।
অভিযোগ রয়েছে, প্রায় দুই যুগ ধরে বন্ধ থাকা কোম্পানির ভুয়া অংশীদারত্ব দিতে ভয়ংকর প্রতারণার ফাঁদ পাতে নুরুল আমিন দম্পতি। তাদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে ব্যবসায় অংশীদার হতে চাওয়া আগ্রহীদের অনেকেই খুইয়েছেন কোটি কোটি টাকা।
প্রতারক এই দম্পতি কথিত হেনোলাক্স গ্রুপের প্রধান কার্যালয় হিসেবে ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ঠিকানা হিসেবে উল্লেখ করেন ৩/১, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০। আর স্কাইভিউ হেনোলাক্স সেন্টার নামের ১১ তলার এই বাণিজ্যিক ভবনটির তৃতীয় তলায় কথিত হেনোলাক্স গ্রুপের প্রধান কার্যালয় দেখানো হয়েছে।
কর্ণফুলী গার্ডেন সিটির এক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সময়ের আলোকে বলেন, সদ্য বিদায়ি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কর্ণফুলী গার্ডেন সিটি অ্যাপার্টমেন্টে নূরুল আমিনের অনেক আধিপত্য ছিল। কারণ কর্ণফুলী গার্ডেন সিটিতে নূরুল আমিনের বাসায় ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক মন্ত্রী ও প্রভাবশালী নেতার যাতায়াত ছিল। আর এ সুযোগে প্রভাব খাটিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কর্ণফুলী গার্ডেন সিটি মালিক সমিতির কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। তার দাপটে ভবনের সবাই তটস্থ থাকতেন। অনেক দিন ধরে তার কোনো ব্যবসা নেই। অথচ অর্থ সম্পদ বেড়েছে অনেকগুণ। তার এ সবই হয়েছে প্রতারণার মাধ্যমে অন্য মানুষের অর্থ আত্মসাৎ করে।
অন্যদিকে নূরুল আমিনের কথিত হেনোলাক্স কারখানা নামের রাজধানীর কদমতলী এলাকায় মোহাম্মদবাগে ৩ তলা ভবন রয়েছে। যার নম্বর ৯৮৭। ভবনটিতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে এক ভূতুড়ে পরিবেশ বিরাজ করছে। কিছুদিন আগে এখানে সেমাই উৎপাদন করা হতো। এ ভবনের পাশেই ব্যবসা করেন আফজাল হোসেন। তিনি একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী।
তিনি বলেন, মোহাম্মদবাগের এই বাড়িটি এক সময়ে হেনোলাক্সের কারখানা ছিল। সেটি অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। এরপর এই ভবনের একটি অংশে কিছুদিন সেমাই উৎপাদন করা হতো। এখন সেটিও বন্ধ রয়েছে। আগে এই কারখানা কদমতলীর মেরাজনগরে ছিল। পরে এটি মোহাম্মদবাগে এসেছে। এসব ছাড়াও নুরুল আমিনের পূর্বাচল এলাকার পিংক সিটিতে এ ব্লকের ৮ নম্বর রোডের ৫ নম্বর ডুপ্লেক্স বাড়ি, ১০৯ নম্বর কর্ণফুলী গার্ডেন সিটিতে ৪টি ফ্ল্যাট, যার নম্বর ১৬/ডি, ১৭/এ, ১৭/ডি এবং ১৯/এ। আবার পূর্বাচল এলাকার পিংক সিটিতে ‘এ’ ব্লকের ৮ নম্বর রোডের ৫ নম্বর ডুপ্লেক্স বাড়িটিও তার।
কদমতলীর মেরাজনগরে নূরুল আমিনের ‘হেনোলাক্স ভবন-১’ নামের আরও একটি ভবন রয়েছে। যার নম্বর ১০৭৬। ভবনটির নামকরণেই এলাকাবাসীর কাছে হেনোলাক্স মোড় বলে পরিচিত। সেখানেই হেনোলাক্সের প্রথম কারখানা ছিল। পাঁচ কাঠা জমির ওপর চার তলা বিশিষ্ট নির্মিত ‘হেনোলাক্স ভবন-১’ নামের এই ভবনটির নিচ তলায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এবং ওপরের তিন তলায় আবাসিক ফ্ল্যাট আকারে ভাড়া দেওয়া হয়েছে।
কুষ্টিয়ার বাসিন্দা গাজী আনিসুর রহমান জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে শরীরে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। প্রতারণা করে আপনি তার টাকা নিয়ে আর তাকে ফেরত দেননি। এটা কতটুকু সত্য- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গাজী আনিসুরের কাছ থেকে কোনো টাকা নিইনি। আমি কারও সঙ্গে প্রতারণাও করিনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমিন হারবাল লিমিটেডের মার্কেটিং ম্যানেজার বলেন, হেনোলাক্স কোম্পানিটি বন্ধের পর আমরা কয়েকজন পুরানা পল্টন স্কাই ভিউ টাওয়ারে অফিস করেছি। সেখানে ২০২১ সালের শেষ দিকে টাঙ্গাইল এলাকার আকরাম হোসেন নামের একজন কোম্পানির মালিকের কাছে একাধিকবার এসেছেন। তার দাবি ছিল তিনি নুরুল আমিনের কথায় বিশ্বাস করে ব্যবসার জন্য আড়াই কোটি টাকা দিয়েছেন। সেই টাকা তিনি ফেরত নিতে এসেছিলেন। তাকে ওয়াদা দিয়েও টাকা ফেরত দেননি নুরুল আমিন। এ ছাড়া দেনা-পাওনা নিয়ে একটি দুর্ঘটনার পর ২০২২ সালে আরও অনেকেই পাওনাদার হিসেবে অফিসে এসেছেন। কিন্তু কোম্পানির মালিক নূরুল আমিনকে না পেয়ে তারা ফিরে গেছেন।
নুরুল আমিনের গ্রামের বাড়ি নরসিংদী জেলার শিবপুর ইউনিয়ন পরিষদের এক সাবেক চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করার শর্তে সময়ের আলোকে বলেন, একসময় নুরুল আমিনের পরিবার খুব একটা সচ্ছল ছিল না। তিনি নিজ এলাকায় হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক নামে পরিচিত ছিলেন। হেনোলাক্স প্রতিষ্ঠার পর খুব দ্রুতই তার ভাগ্য বদলে যায়। তিনি ঢাকা ও নরসিংদীতে অনেক জমি কিনেছেন। এখন শোনা যাচ্ছে তিনি অনেকের সঙ্গে ব্যবসার অংশীদার বানানোর নামে প্রতারণা করে শত শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন।