ই-পেপার শনিবার ১৫ মার্চ ২০২৫
শনিবার ১৫ মার্চ ২০২৫
ই-পেপার

শনিবার ১৫ মার্চ ২০২৫

সংকট বাড়বে গ্যাস খাতে
প্রকাশ: শনিবার, ৮ মার্চ, ২০২৫, ১০:২৪ এএম  (ভিজিট : ২১০)

দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। সক্ষমতা না থাকায় এলএনজি আমদানিও বাড়ছে না। যা সরবরাহ করা হচ্ছে তার মধ্যে আবার দৈনিক চুরি হয়ে যাচ্ছে ৩২৪ মিলিয়ন ঘনফুট। চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ না বাড়া এবং চুরি বন্ধ না হওয়ায় গ্যাস খাতে সংকট বাড়ছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে শিল্পকারখানা, বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদনে, আবাসিকে রান্নার গ্যাসে। দেশীয় উৎস থেকে সরবরাহ বাড়ানোর পাশাপাশি বিকল্প ব্যবস্থার উদ্যোগ না নিলে ভবিষ্যতে এ সংকট আরও বাড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, দিনে গ্যাসের চাহিদা ৪০০ কোটি ঘনফুট ছুঁয়েছে। বৃহস্পতিবার সরবরাহ করা হয়েছে ২ হাজার ৮৩৫ মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে আমদানি করা এলএনজি রয়েছে ৯৫১ মিলিয়ন ঘনফুট, সক্ষমতা ১১০০ মিলিয়ন ঘনফুট। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে সক্ষমতা ২ হাজার ৪২০ মিলিয়ন, প্রয়োজন ১ হাজার ২০০ মিলিয়ন সরবরাহ করা হয়েছে ৯৯১ মিলিয়ন ঘনফুট। নন গ্রিডে সরবরাহ করা হয়েছে ২১৩ মিলিয়ন, সার কারখানায় ৩২৯ মিলিয়ন প্রয়োজনের বিপরীতে সরবরাহ করা হয়েছে ১৩৪ মিলিয়ন। শিল্প এবং আবাসিকে সরবরাহ করা হয়েছে ১ হাজার ৬৪৩ মিলিয়ন, চাহিদা এর দ্বিগুণ।

পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, গ্যাসের উৎপাদন ধারাবাহিকভাবে কমছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে প্রতিদিন গ্যাসের গড় উৎপাদন ছিল অন্তত ২৬০ কোটি ঘনফুট। পরের বছর প্রায় ২২ কোটি ঘনফুট কমে যায়। বর্তমানে এটি ২০০ কোটি ঘনফুটের নিচে নেমেছে। নতুন করে গ্যাস না পেলে উৎপাদন আরও কমবে।

সরকারি তথ্যমতে, বছরে ১ টিসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হলে দেশে গ্যাসের যে মজুদ আছে, তা দিয়ে ১০-১১ বছর চলবে। ২০১০ সালে করা একটি আন্তর্জাতিক কোম্পানির সমীক্ষা অনুযায়ী, বিবিয়ানা ও জালালাবাদ গ্যাসক্ষেত্রের উত্তোলনযোগ্য মজুদ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ২০২৩ সালে। দুটি গ্যাসক্ষেত্র থেকেই এখনও উৎপাদন অব্যাহত রয়েছে। যদিও উৎপাদন কমছে। উৎপাদনের শীর্ষে থাকা গ্যাসক্ষেত্র বিবিয়ানার মজুদও শেষের দিকে। দুই বছর আগে এটি থেকে দিনে ১৩০ কোটি ঘনফুট উৎপাদন করা হয়েছে। এখন এটি নেমে এসেছে ৯৫ কোটি ঘনফুটে। অন্য বড় গ্যাসক্ষেত্র থেকেও সক্ষমতা অনুসারে উৎপাদন হচ্ছে না।

এ ছাড়া দৈনিক সরবরাহ করা ২ হাজার ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মধ্যে ৩২৪ মিলিয়ন চুরি হয়ে যাচ্ছে। অনুপাতের দিকে থেকে চুরির শীর্ষে রয়েছে বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি, পরিমাণের দিক তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি।

অনুযায়ী, গত ৬ মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) গ্যাসের সামগ্রিক সিস্টেম লস আগের বছরের তুলনায় ৫ শতাংশ বেড়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গ্যাসের সিস্টেম লস ছিল ৮.৪৩ শতাংশ, যা চলতি অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে হয়েছে ১৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ।

সবচেয়ে বৃহৎ বিতরণ কোম্পানি তিতাস গ্যাসের গত ডিসেম্বর মাসের জোনভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ভৈরব এরিয়ায় সবচেয়ে বেশি সিস্টেম লস রয়েছে। ডিসেম্বর মাসে ৪০ দশমিক ৭০ শতাংশ গ্যাসই চুরি হয়ে গেছে। ভৈরব জোনে ডিসেম্বর মাসে ৩ দশমিক ৯৮ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস সরবরাহ করা হয়। আর প্রকৃত গ্রাহকরা পেয়েছে মাত্র ২ দশমিক ৩৬ মিলিয়ন। ভৈরবের পরেই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লোকসান দিয়েছে কিশোরগঞ্জ জোন। ওই জোনে ২৭ শতাংশ সিস্টেম লস দেখা গেছে।

অপরদিকে, দেশে গ্যাস সংকট থাকলেও দেশি কোম্পানিগুলো বিদেশি কোম্পানির চেয়ে গ্যাস উৎপাদনে পিছিয়ে রয়েছে। এমনকি তাদের উত্তোলনের পরিমাণও কমে কমছে। দেশি কোম্পানিগুলো ১৮টি গ্যাসক্ষেত্রের ৭০টি কূপ থেকে গ্যাস উত্তোলন করছে। আর বিদেশি কোম্পানি শেভরন ও তাল্লো ৪টি গ্যাসক্ষেত্রের ৪৩টি কূপ থেকে গ্যাস উত্তোলন করছে। অর্ধেকের কম কূপ খনন করে শেভরন ও তাল্লো দেশি কোম্পানিগুলোর চেয়ে অনেক বেশি গ্যাস উত্তোলন করছে। শুধু বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রের ২৬টি কূপ থেকে শেভরন বৃহস্পতিবার উত্তোলন করছে ৯৫৪ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাস, যা দেশি কোম্পানিগুলোর তোলা গ্যাসের চেয়ে ১২২ মিলিয়ন ঘনফুট বেশি। এর পেছনে দেশি কোম্পানিগুলোর কারিগরি অদক্ষতাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এদিকে, গ্যাস সংকটে উৎপাদন শুরুর ৩৮ দিন পর আবারও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ সার কারখানায় ইউরিয়া উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। এর আগে গ্যাসের অভাবে টানা ১১ মাস ধরে কারখানায় ইউরিয়া উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ ছিল। গ্যাস-স্বল্পতায় সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে শিল্প খাত। এখন চাহিদার চেয়ে ৩০ শতাংশ কম গ্যাস পাচ্ছে শিল্পকারখানা। গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, নরসিংদীসহ দেশের শিল্পাঞ্চলে এই সংকট দিন দিন বাড়ছেই। এতে উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। গ্যাসের অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে শতাধিক কারখানা। অনেকটি বন্ধের পথে। বাধ্য হয়ে চলছে শ্রমিক ছাঁটাই।

চলমান গ্যাস সংকটের এমন পরিস্থিতির জন্য বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধানে অবহেলা, আমদানিতে জোর এবং জ্বালানি বিভাগের অদক্ষতাকেই দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেড় দশক আগে গ্যাস সংকটের এমন আভাস পাওয়া গেলেও তৎকালীন সরকার উচ্চমূল্যের এলএনজি আমদানিতে বেশি মনোযোগী ছিল। বিদেশি কোম্পানিগুলোর মতো বিনিয়োগ নেই দেশি কোম্পানিগুলোর। কারিগরি দক্ষতাও কম। দেশে যে কূপগুলো রয়েছে সেগুলোয় কিছু কাজ করা হলে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। পাশাপাশি এলএনজি আমদানি কমিয়ে দেশি গ্যাস ক্ষেত্র থেকে সরবরাহ বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ করা এখনই দরকার। এ ছাড়া গ্যাস চুরি ঠেকাতে কঠোর পদক্ষেপ না নেওয়ায় সংকট আরও ঘনীভূত করছে। একই সঙ্গে দেশের স্থলে ও সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানে জোর তৎপরতা চালাতে হবে।

জ্বালানি বিভাগ সূত্র বলছে, অনুসন্ধান, সংস্কার ও উন্নয়ন কূপ মিলিয়ে ১০০টি কূপের প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। নতুন গ্যাসের অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়। পুরোনো গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদনের জন্য নতুন করে উন্নয়ন কূপ খনন করা হয়। আর উৎপাদন কমে আসা পুরোনো কূপ বা উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়া কূপ থেকে উৎপাদন বাড়াতে কূপ সংস্কার করা হয়। এখন গ্যাসের উৎপাদন পরিস্থিতি বিবেচনায় কূপ সংস্কারে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজসম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) বলছে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনে জোর দিয়ে কূপ খননের কাজ হাতে নিয়েছে। আগামী বছর থেকে আরও ১০০টি কূপ খননের পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে। আগের পরিকল্পনা অনুসারে ২০২৫ সালে ৫০টি কূপ খনন করা গেলে জাতীয় গ্রিডে দিনে প্রায় ৬৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস যুক্ত হবে। ইতিমধ্যে দিনে ১ কোটি ৮৪ লাখ ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব হয়েছে, যার মধ্যে ৭২ লাখ ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হচ্ছে। চুরি ঠেকাতে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। দেশি কোম্পানিগুলোর উৎপাদন বাড়ানোর বিষয়ে পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও সাবেক বিইআরসি সদস্য (গ্যাস) মকবুল-ই-ইলাহী চৌধুরী সময়ের আলোকে বলেন, বিদেশি কোম্পানির চাইতে দেশীয় কোম্পানির কম গ্যাস উত্তোলনের কারণ হচ্ছে কারিগরি ব্যর্থতা। কিন্তু ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। আমরা গ্যাস উত্তোলন বাড়াতে পারি, সেই সুযোগও রয়েছে, কিন্তু করা হয়নি।

তিনি বলেন, এখন বাঁচতে হলে দ্রুত গ্যাস উত্তোলন বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে, পাশাপাশি নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান করতে হবে।

বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, আমাদের গ্যাসের মজুদ ফুরিয়ে আসছে, সেটা সবাই আগে থেকেই জানে। গ্যাসের উৎপাদন কমছে, বিশেষজ্ঞরা অগণিতবার বলার পরও উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আমদানির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এ কারণে বর্তমান পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

তিনি বলেন, পেট্রোবাংলা কিছু উদ্যোগ নিয়েছে, সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়নে জোর দিতে হবে। নতুন করে গ্যাস অনুসন্ধান এবং চলমান কূপগুলো থেকে উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি বিকল্প জ্বালানির কথা ভাবতে হবে। এ ছাড়া উপায় নেই।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান মো. রেজানুর রহমান বলেছেন, গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহ বাড়ানোর জন্য কূপ সংস্কারে জোর দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে ১৬টি কূপ সংস্কারের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে ৭টি কূপের কাজ শেষে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ কিছুটা বেড়েছে। সবকয়টি শেষ হলে উৎপাদন আরও বাড়বে। এখন কূপ খননের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) দ্রুত অনুমোদন করে দিচ্ছে জ্বালানি বিভাগ।




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ। নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।
ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close