
খতমে তারাবির সপ্তম দিন আজ। আজ থেকে তারাবিতে প্রতিদিন এক পারা করে পড়া হবে। পারা হিসেবে কোরআনের দশম পারা। সুরা আনফালের ৪১ থেকে সুরা তওবার ৯৩ আয়াত পর্যন্ত। গনিমতের সম্পদ বণ্টননীতি, জাতীয় জীবনে উত্থান-পতনের মূলনীতি, মুসলমানদের বিজয়ে আল্লাহর সাহায্য, বন্ধু গ্রহণের নীতি, আনসার, মুহাজির এবং মুজাহিদদের পুরস্কার ও মর্যাদা, জিহাদ, বদর যুদ্ধের ঘটনা ও শিক্ষা, যুদ্ধবন্দী, মক্কা বিজয়, হুনাইন যুদ্ধ, তাবুক যুদ্ধ, তওবা, মুশরিকদের কাবাঘর তাওয়াফে নিষেধাজ্ঞা, কাফেরদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল, পূর্ববর্তী জাতিদের ভয়াবহ পরিণাম, মতানৈক্য, অহংকার পরিহার, একনিষ্ঠ মুসলিমদের প্রংশসাসহ ইত্যাদি বিষয়ের বিবরণ রয়েছে এই অংশে।
যেভাবে বণ্টন করতে হবে গনিমতের সম্পদ
গনিমতের সম্পদে অংশীদারত্ব এবং বণ্টনের নীতিনির্ধারণ বিষয়ে আলোচনা রয়েছে আজকের তারাবির শুরুতে। অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হওয়ার পর যে সম্পদ পাওয়া যায়, তা গনিমত। মুহাম্মদ (সা.)-এর উম্মতের জন্য এই গনিমতের সম্পদ হালাল করে দিয়েছেন আল্লাহ। আগেরকার উম্মতের জন্য তা হালাল ছিল না; যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর অবিশ্বাসীদের কাছ থেকে পাওয়া সব সম্পদ এক জায়গায় জমা করলে আসমান থেকে আগুন এসে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দিত। মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনব্যবস্থায় যুদ্ধলব্ধ সব সম্পদ রাষ্ট্রের কাছে জমা দিতে হয়। কোনো সৈনিকের জন্য তা থেকে বণ্টনের আগে কোনো কিছু রেখে দেওয়ার অনুমতি নেই। রাষ্ট্রপ্রধান সেই সম্পদ বণ্টন করবেন।
তাফসিরে ইবনে কাসিরে এসেছে, যুদ্ধলব্ধ সব সম্পদ পাঁচ ভাগে ভাগ করা হবে। এর চার ভাগ যোদ্ধাদের মধ্যে বণ্টন করা হবে। আর বাকি এক পঞ্চমাংশ পাঁচ ভাগে ভাগ করা হবে। এই পাঁচ ভাগ যারা পাবেন—
১. আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের জন্য। এই অংশ মুসলিমদের সাধারণ স্বার্থ সংরক্ষণে ব্যয় হবে।
২. মুহাম্মদ (সা.)-এর স্বজনদের জন্য নির্ধারিত। তাঁরা হলেন—ওই সব লোক, যাদের ওপর সদকা খাওয়া হারাম। অর্থাৎ বনু হাশেম ও বনু মুত্তালিব।
৩. এতিমদের জন্য সুনির্দিষ্ট।
৪. ফকির ও মিসকিনদের জন্য।
৫. মুসাফিরদের জন্য।
আল্লাহর সাহায্য পাওয়ার চার শর্ত
এ সুরার ৪৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহর সাহায্যপ্রাপ্তির জন্য চারটি শর্তের উল্লেখ রয়েছে। যথাÑএক. যুদ্ধের ময়দানে দৃঢ়পদ থাকা। দুই. অধিক পরিমাণে আল্লাহকে স্মরণ করা। তিন. পরস্পর মতানৈক্য এবং ঝগড়া-বিবাদ থেকে বেঁচে থাকা। চার. শত্রুর মোকাবেলায় অপ্রীতিকর বিষয় সামনে এলে ধৈর্যধারণ করা।
ইমানদার কারা
আল্লাহ তাআলা সুরা আনফালের ৭৪ নম্বর আয়াতে প্রকৃত ইমানদারের গুণাবলির বর্ণনা দিয়েছেন। তাদের জন্য ক্ষমা ও সম্মানজনক জীবনের ঘোষণা দিয়েছেন। গুণগুলো হলো—আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ বিশ্বাস রাখা, ইসলামের জন্য হিজরত (মাতৃভূমি ত্যাগ) করা, জিহাদ করা, জিহাদকারীদের আশ্রয় ও তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করা।
দায়মুক্তি ও তওবার সুরা
১২৯ আয়াত বিশিষ্ট সুরা তওবা কোরআনের নবম সুরা। এটি মদিনায় অবতীর্ণ। এ সুরায় মুমিনদের তওবা কবুল হওয়ার আলাপ থাকায় একে সুরা তওবাও বলা হয়। এটিকে ‘সুরা বারাআত’ও বলা হয়। বারাআত অর্থ দায়মুক্তি বা সম্পর্ক ছিন্ন করা। এতে অবিশ্বাসীদের সঙ্গে মুসলমানদের সম্পর্কচ্ছেদ ও তাদের ব্যাপারে দায়িত্বমুক্তির কথা উল্লেখ রয়েছে। এ সুরার শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ লেখা হয়নি। অন্যান্য সুরা নাজিলের সময় ‘বিসমিল্লাহ’সহ নাজিল হতো, যাতে বোঝা যেত এই সুরা শেষ হয়ে আরেক সুরা নাজিল হচ্ছে। এই সুরা নাজিল হওয়ার সময়, ‘বিসমিল্লাহ’সহ নাজিল হয়নি। নবিজি (সা.) এর শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ লেখার নির্দেশ দেননি। (তাফসিরে মাআরেফুল কোরআন, মুফতি মুহাম্মাদ শফি, অনুবাদ : মাওলানা মুহিউদ্দীন খান, পৃষ্ঠা : ৫৫২)
তাবুক যুদ্ধে সাহাবিদের আত্মত্যাগ
আল্লাহতাআলা সুরা তওবার ৩৯ নম্বর আয়াতে মুসলমানদের তাবুক যুদ্ধে যাওয়ার নির্দেশ দেন। ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দের নবম হিজরিতে তাবুক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তাবুক মদিনা ও দামেস্কের (সিরিয়া) মধ্যবর্তী একটি স্থানের নাম। মদিনা থেকে এটি ৬৯০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ইসলামের বিরুদ্ধে আরবের কাফের ও মুনাফিকদের শেষ চেষ্টা ছিল এই যুদ্ধ। রোমানদের দ্বারা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দূত হারেস বিন উমায়ের (রা.)-কে হত্যার মধ্য দিয়ে তাবুক যুদ্ধের সূচনা হয়েছিল। রাসুল (সা.) দূতের মাধ্যমে জানতে পারলেন, ‘মুতা যুদ্ধে’র প্রতিশোধ নিতে চূড়ান্ত ফায়সালাকারী একটি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে পরাশক্তি রোম। শাম ও আরব সীমান্তে তারা বিশাল বাহিনী মোতায়েন করেছে।
মদিনায় তখন চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। নবিজি আদেশ করলেন, হিরাক্লিয়াসের আক্রমণের আগে তিনি আক্রমণ করবেন। মদিনার সব মুসলমানকে তৈরি হতে বললেন। এর আগে এমন রাজকীয় বাহিনীর মুখোমুখি তারা কোনো দিন হননি। মদিনার বাইরে গিয়ে যুদ্ধও করেননি।
এদিকে মদিনায় তখন খেজুর পাকার মৌসুম চলছে। সময়মতো খেজুর ঘরে না তুলতে পারলে মুশকিলে পড়তে হবে। মদিনায় খাদ্যাভাবও দেখা দিয়েছে এর মধ্যে। তীব্র গরমে জনজীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। তাবুক প্রান্তরে পৌঁছাতে হলে পাড়ি দিতে হবে দুর্গম মরুভূমি। যুদ্ধের রসদও তেমন নেই। এসবের মধ্যে শহর ছেড়ে এমন রাজকীয় বিশাল বাহিনীর মোকাবিলা করতে যাওয়া; বিরাট কষ্টসাধ্য ও ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপারই বটে। কিন্তু সাহাবিরা সবকিছু পেছনে ফেলে ত্যাগের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে নবিজির হাতে যুদ্ধের বাইয়াত নেন। অনেকে যুদ্ধে যেতে চাইলেন না। আল্লাহ তাদের মুনাফিকির পরিচয় সুস্পষ্ট করে দেন। রাসুল (সা.) ৩০ হাজার যোদ্ধা সাহাবির কাফেলা নিয়ে চললেন তাবুক প্রান্তের দিকে। হিরাক্লিয়াস মুসলমানদের এমন দুঃসাহসিক অভিযানের সংবাদ পেয়ে ময়দান ছেড়ে পালিয়ে যায়।
মুনাফিকদের ১১ অভ্যাস
সুরা তওবার ৪২ থেকে ৫৯ নম্বর আয়াতে তাবুক যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে যুদ্ধে অংশ না নেওয়া মুনাফিকদের কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যথা—
১. মিথ্যা অজুহাত পেশ করে।
২. টালবাহনা করে।
৩. হাস্যকর আপত্তির কথা বলে জিহাদে না যাওয়ার অনুমতি আদায় করে।
৪. মুসলিম সমাজে অনিষ্ট ছড়ায়।
৫. মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিংসা-বিদ্বেষ ছড়ায় ও মুসলমানদের বিপদে আনন্দ প্রকাশ করে।
৬. মিথ্যা শপথ করে।
৭. সম্পদ পেলে আনন্দ পায়, না পেলে ক্ষোভ প্রকাশ করে।
৮. আল্লাহর মহব্বত, আল্লাহর জিকির ও তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ শূন্য অন্তর।
৯. নববিজি (সা.)-কে গালমন্দ করে।
১০. একে অপরকে মন্দ কাজের আদেশ দেয়, ভালো কাজ থেকে নিষেধ করে।
১১. কৃপণ।
জাকাত প্রদানের ৮ খাত
সুরা তওবার ৬০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তাআলা জাকাত প্রদানের আটটি খাত বর্ণনা করেছেন। যথা—
১. গরিব—যার নেসাব পরিমাণ সম্পদ নেই।
২. মিসকিন—যার মালিকানায় কোনো সম্পদ নেই।
৩. ইসলামি সরকারের পক্ষ থেকে জাকাত সংগ্রহে নিয়োজিত ব্যক্তি।
৪. ইসলামের দিকে চিত্তাকর্ষণের জন্য জাকাত দেওয়া।
৫. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি।
৬. নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের বিনিময়ে স্বাধীন হওয়ার চুক্তিতে আবদ্ধ দাস-দাসী।
৭. মুসাফির—সফর অবস্থায় অভাবগ্রস্ত মানুষ।
৮. আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারী।
লেখক: আলেম ও সাংবাদিক