ই-পেপার বুধবার ১৯ মার্চ ২০২৫
বুধবার ১৯ মার্চ ২০২৫
ই-পেপার

বুধবার ১৯ মার্চ ২০২৫

যানজটে নাকাল মানুষ
প্রকাশ: সোমবার, ৩ মার্চ, ২০২৫, ১০:০৫ এএম  (ভিজিট : ২৪৬)

যানজট। একটি আতঙ্ক। যন্ত্রণা। সমস্যা। মানুষের বিরক্তির বড় কারণ। যানজট সমস্যার কোনো সমাধানই হচ্ছে না। রমজান মাস কেন্দ্র করে যানজট দশগুণ বেড়ে গেছে। যানজট সমস্যা সমাধানের কোনো কর্তৃপক্ষও যেন নেই। 

যানজটে পড়ে পরীক্ষার্থী সময়মতো পরীক্ষার হলে যেতে পারেনি। যার কারণে পরীক্ষা দিতে পারেনি। অ্যাম্বুলেন্সে থাকা গুরুতর রোগী যানজটের কবলে পড়ে মারা গেছেন। অফিসগামী মানুষ সময়মতো অফিসে যেতে পারেন না। এমন নজিরের অভাব নেই। যানজট সমস্যা যেন চরম আকার ধারণ করেছে। যানজটের কবলে পড়ে নষ্ট হচ্ছে মানুষের শত শত কর্মঘণ্টা। টাকার অঙ্কে হিসাব করলে এসব কর্মঘণ্টার দাম শতকোটিরও বেশি হবে। 
একজন ডাক্তার যিনি প্রতি ঘণ্টায় ১০ জন রোগী দেখে পনেরো হাজার টাকা আয় করেন তিনি যদি দুই ঘণ্টা যানজটে আটকা থাকেন তা হলে তার ত্রিশ হাজার টাকা লোকসান। একজন শিল্পপতির আরও বেশি লোকসান। যানজটের কবল থেকে সচিব মন্ত্রী এমপি কর্মকর্তা কর্মচারী সাধারণ মানুষ কেউ রেহাই পান না। 

তাদের সবারই সময়ের দাম আছে। সে দাম নিতান্তই কম নয়। যার যার সময়ের দাম তার তার মতো। যানজট সমস্যার কারণ, এই সমস্যা হতে মুক্তি পাওয়ার উপায় সবই আমাদের জানা। কিন্তু আমরা মুক্তি পাচ্ছি না। বিনিময়ে বাড়ছে মানুষের অস্থিরতা। বুক ধুকধুকানি। সময়মতো অফিস আদালত স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে না যেতে পেরে অনেকেই ভোগে মানসিক অশান্তিতে। পেরেশানি যেন তাদের নিত্যসাথি। 

রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকা মানুষগুলোকে দেখলে বোঝা যায় তারা কতটা অসহায়। গরমে ঘামছে। ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ। এমন দৃশ্যের অভাব নেই। ঢাকা শহরের রাস্তায় বের হলে চোখে পড়ে এমন হাজারটা দৃশ্য।

কোথাও বের হলে মানুষ আতঙ্কে থাকে সময়মতো পৌঁছাতে পারবে কি না। দশ মিনিটের রাস্তা এক ঘণ্টা আগে বের হওয়ার পরও সময়মতো পৌঁছানো যায় না। ভুগতে হয় অসহনীয় যানজটে। প্রায় সময়ই যানজটে স্থবির হয়ে যায় রাজধানী ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো। অসহায়ের চেয়েও অসহায় মানুষগুলো গণপরিবহনে বসে প্রহর গোনে। দশ মিনিটের পথ যায় এক ঘণ্টায়। 

আট ঘণ্টা অফিস আর চার ঘণ্টা যানজটে বসে থাকা। এ হলো রাজধানীবাসীর প্রতিদিনের জীবন। যানজট যেন মানুষের অস্থিরতা দ্বিগুণ-তিনগুণ বাড়িয়ে তুলছে। মানুষ না পারছে বলতে, না সইতে। সকাল ছয়টায় বের হয়ে যে পথ যাওয়া যায় ছয়টা দশে, সকাল নয়টায় বের হলে সে পথ যেতে হয় পাক্কা দুই ঘণ্টায়। প্রশ্ন জাগে-এ কেমন আজব শহর? প্রশ্নটা অমূলক নয়। যথাযথ কর্তৃপক্ষ প্রশ্নটা শোনে কি না তা হলো কথা। যদি শোনে তা হলে শোনার মতো শোনে কিনা? নাকি এক কান দিয়ে শোনে আরেক কান দিয়ে বের করে দেয়। 

কারণে-অকারণে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি যানজটের একটা বড় কারণ। উন্নয়নমূলক কাজের জন্যও যানজট বাধে। যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং, ফুটপাথ দখল করে দোকান বসানো, রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে যেখানে-সেখানে যাত্রী ওঠানো-নামানো, ট্রাফিক সিগন্যাল ঠিকমতো না দেওয়া ও না মানা যানজটের কারণ। এসব কারণের ব্যাপারে যথাযথ কর্তৃপক্ষ অবগত। তারপরও কারণগুলোর গভীরে ঢুকে যানজট সমস্যার সমাধান করা হচ্ছে না। হয়তো সে কারণেই যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকা সাধারণ যাত্রীদের আক্ষেপ ‘গরম ও জ্যামে বসে থাকতে আমাদের কেমন লাগে তা ওই প্রশাসনের লোকরা বুঝবেন না’। কথাটাতে ক্ষোভ আছে, আক্ষেপ আছে-আছে অসহায়ত্বের ছাপ। 
সাধারণ মানুষ আসলেই ‘সাধারণ মানুষ’। তাদের জ্বালা-যন্ত্রণা বোঝার যেন কেউ নেই। এই যে যানজট সমস্যায় ভোগছে বছরের পর বছর তার কি কোনোই সমাধান নেই? সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকায় কতগুলো বিভাগ চলছে। তারা দেখাচ্ছে যে জনগণের সুবিধা-অসুবিধা দেখছে। আসলে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। দিনের পর দিন বছরের পর বছর যানজট নিয়ে চলছে গবেষণা। খরচ হচ্ছে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। ফলাফল শূন্য।

যানজট নিয়ে জাতীয় সংসদে বাহাস হয়েছে। গণপরিবহনে অরাজকতা নিয়ে মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছেন মন্ত্রী-এমপিরা এমন দৃশ্যও দেখেছে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। যেই লাউ সেই কদু। যানজটে পড়ে সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের ভোগান্তির যেন শেষ নেই। তাদের মধ্যকার নানা কথাবার্তা থেকে উঠে আসে যানজটের ভয়াবহ চিত্র।

বিগত সরকারগুলো উন্নয়ন অনেক করেছে কিন্তু রাজধানীতে ট্রান্সপোর্টের একটা সুষ্ঠু ও সফল নীতিমালা করতে পারেনি। ঢাকা শহরে ঘর থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই। এই শহরে যেসব বাস চলে বেশিরভাগই পুরোনো বাস, লক্কড়ঝক্কড়, লাইসেন্স নেই এবং কোনো আইন মানে না। রাস্তাঘাটে একেবারে অরাজক অবস্থা করে রাখে। এতে মানুষের মধ্যে ভয়, ত্রাসের অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।

বর্তমানে আরেক উপদ্রব অটোরিকশা। অটোর যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ নগরবাসী। যত্রতত্র অটোর প্রবেশাধিকার যেন কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না। বেপরোয়া গতিতে চলা অটোগুলো যানজটের সৃষ্টি করছে পাশাপাশি বাড়াচ্ছে দুর্ঘটনার মাত্রা। অটোগুলো দেখা ও নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যেন কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। 

অটোর কারণে ছুটির দিনেও রাজধানীতে দেখা যায় ভয়াবহ যানজট। কর্ম দিবসে যেমন-তেমন ছুটির দিনেও নগরবাসী রেহাই পান না যানজটের কবল থেকে। ছুটির দিনেও দীর্ঘ সময় যানজটে অসহনীয় ভোগান্তি পোহাতে হয় নগরবাসীকে। বলা যায় যানজটের হাতে জিম্মি রাজধানীর সাধারণ মানুষ। 

এ রকম সমালোচনা-আলোচনার পর নিশ্চয়ই কোনো বিষয়ের গুরুত্ব বাড়ে। যানজট নিয়ে প্রতিনিয়ত যত আলোচনা-পর্যালোচনা হচ্ছে তাতে বিষয়টা অধিকতর গুরুত্বের দাবিদার। কিন্তু আদৌ কি কোনো গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে যানজট নামক ভয়ংকর বিষয়টির প্রতি? ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় আধুনিকতম পদ্ধতি ব্যবহারের একটা প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে। ট্রাফিক বাহিনীতে যারা আছেন তাদের যথাযথ দায়িত্ব পালনের বিষয়টাও গুরুত্বের সঙ্গে ভাবার সময় এসেছে। দক্ষ ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টের বিষয়টাতো আরও আগেই আলোচিত সমালোচিত পর্যালোচিত। 

আসলে দক্ষ ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টের ওপর যানজট সমস্যার সমাধান অনেকটাই নির্ভরশীল। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে রাস্তায় কোনো ট্রাফিক পুলিশ নেই। কোথাও কোনো অনিয়মও নেই। যানজটও নেই। চালকরা শতভাগ ট্রাফিক আইন মেনেই রাস্তায় গাড়ি চালাচ্ছে। বাংলাদেশে এমন ব্যবস্থাপনা কতটা সম্ভব, আদৌ সম্ভব কি না জানি না। তবে একসময় এমন আধুনিক ব্যবস্থাপনার দিকে যেতে বাধ্য হবে বাংলাদেশ। 

সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে সময়োপযোগী ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার দিকে অবশ্যই ঝুঁকতে হবে। প্রয়োজনীয় আধুনিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশে ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট অবশ্যই ডিজিটাল হওয়ার দাবি রাখে। এই দাবিটা সরকার যত দ্রুত পূরণ করবে ততই মঙ্গল। দেশের মানুষ তত তাড়াতাড়ি মুক্তি পাবে যানজট নামক মহাবিপদ হতে। কমবে মানুষের ভোগান্তি। বাঁচবে সময়। অহেতুক অপচয় হবে না ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

বেশ কয় বছর আগে ঢাকা শহরে পুরো অটোমেটিক সিগন্যাল ব্যবস্থা চালু হয়েছিল। ম্যাজিকের মতো কাজ করেছিল। যানজট যে লেজ গুটিয়ে কোথায় পালিয়ে ছিল আল্লাহ মালুম। কয়েক দিন মাত্র চলেছিল এই অটো সিগন্যাল ব্যবস্থা। পরে জানা গেল রাস্তায় দায়িত্বে থাকা ট্রাফিক পুলিশের কাজ একেবারেই কমে যাওয়ায় এই ব্যবস্থা স্থায়ী রূপ পায়নি। 

বাংলাদেশের সেনানিবাসগুলোতে অটো সিগন্যাল ব্যবস্থা আছে। সেখানে ট্রাফিক আইনও মানা হয় কঠোরভাবে। তাই কোনো সেনানিবাসেই যানজটের বালাই নেই। যানজটের শত কারণের অন্যতম প্রধান কারণ আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা না থাকা। পরীক্ষিত অটো সিগন্যাল ব্যবস্থা পৃথিবীর উন্নত-উন্নয়নশীল ও অনুন্নত সব দেশেই সমধিক কার্যকরী বলে প্রমাণিত। মানুষ নিয়ন্ত্রিত ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অকার্যকারিতার মূল কারণ সময়। কোন সিগন্যাল কত সময় চালু রাখা হবে আর কোনটা কত সময় ধরে বন্ধ রাখা হবে সেটা একটা বড় বিষয়। মানুষচালিত সিগন্যাল ব্যবস্থাপনায় সিগন্যাল ছাড়া ও বন্ধ রাখার বিষয়টি পরিমিতভাবে হয় না। কোনো সিগন্যাল অনেকক্ষণ ধরে রাখা হয় আবার কোনোটা খানিক বাদেই ছেড়ে দেওয়া হয়। যার কারণে যানবাহনগুলো যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ হয় না। বেধে যায় যানজট। 

বাংলাদেশের মানুষ সময়ের মূল্য দিতে শিখেছে। তারা এখন বুঝে যে সময়ই টাকা। যার কারণে তারা যানজটে বসে থেকে অহেতুক মূল্যবান সময় নষ্ট করতে চায় না। চাপ দিতে চায় না হার্টের ওপর। তিন বছর আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন হয়েছে। নির্মিত হয়েছে, হচ্ছে অনেক সড়ক-মহাসড়ক। কিন্তু যানজটের কারণে এসবের পুরোপুরি সুফল মানুষ পাচ্ছে না। যানজট কমিয়ে অবশ্যই সুফল পাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। যানজটের কারণে উন্নয়নশীল বাংলাদেশের উন্নয়নের চাকায় এতটুকু আঘাত আসুক তা কারও কাম্য নয়।




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ। নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।
ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close