ই-পেপার রবিবার ১৬ মার্চ ২০২৫
রবিবার ১৬ মার্চ ২০২৫
ই-পেপার

রবিবার ১৬ মার্চ ২০২৫

তারাবির সারাংশ-১: মুত্তাকি-মুনাফিকের পরিচয় ও হারুত-মারুতের গল্প
প্রকাশ: শনিবার, ১ মার্চ, ২০২৫, ৯:৫৬ পিএম আপডেট: ০১.০৩.২০২৫ ১০:১৯ পিএম  (ভিজিট : ১২৬৯)

পবিত্র রমজান মাসের প্রথম তারাবি পড়া হয়েছে আজ। প্রথম তারাবিতে কোরআনের প্রথম দেড় পারা পড়া হয়। সুরা ফাতিহা ও সুরা বাকারার ১ থেকে ২০৩ নম্বর আয়াত পর্যন্ত। ইসলামের বহু গুরুত্বপূর্ণ বিধানের আলোচনা রয়েছে এই অংশে। কোরআনের বৈশিষ্ট্য, বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী এবং মুনাফিকদের পরিচয়, পৃথিবীতে মানুষের আগমন, ফেরেশতাদের সেজদা, ইবলিশের সেজদায় অস্বীকৃতি ও অহংকার, ইবরাহিম (আ.)-এর কোরবানি, কাবাঘর নির্মাণ, নবিজির (সা.) যুগে কিবলা পরিবর্তনের কারণ ও যৌক্তিকতা, হালাল-হারামের নীতিমালা, অবৈধ পন্থায় সম্পদ উপার্জন, হত্যার অপরাধে হত্যা ও ক্ষমার বিধান, রমজানের রোজা, হজ, খুন, গাভি নিয়ে বনি ইসরাইলের বাড়াবাড়ি, হারুত-মারুতের কাহিনি, চান্দ্র তারিখ ব্যবহারের প্রতি উৎসাহসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবৃত হয়েছে।

কোরআনের মা ও রোগের ওষুধ
নবিজি (সা.)-এর ওপর নাজিলকৃত প্রথম পূর্ণাঙ্গ সুরা এটি। মোট দুবার এই সুরা নাজিল হয়েছে; একবার মক্কায় ও আরেকবার মদিনায়। এটি কোরআনের প্রথম সুরা। ফাতিহা মানে প্রারম্ভিকা। এ সুরার মাধ্যমে কোরআনের শুরু হয়েছে, তাই এর নাম রাখা হয়েছে ফাতিহা। এ সুরাকে ‘ফাতিহাতুল কিতাব বা কোরআনের মুখবন্ধ,  ‘কোরআনের গুপ্তভাণ্ডার’, ‘কোরআনে মা’ ও ‘কোরআনের সার’ বলা হয়। (জামে তিরমিজি, হাদিস: ২৮৭৫)। নামাজে এ সুরা পড়া আবশ্যক।

সুরা ফাতিহার প্রথম তিনটি আয়াতে আল্লাহর প্রশংসা এবং শেষের তিনটি আয়াতে মানুষের পক্ষ থেকে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা ও দরখাস্তের বিষয়বস্তুর সংমিশ্রণ। মাঝের একটি আয়াত প্রশংসা ও দোয়া মিশ্রিত। (তাফসিরে মাআরেফুল কোরআন, মুফতি মুহাম্মাদ শফি, অনুবাদ : মাওলানা মহিউদ্দিন খান, পৃষ্ঠা : ২)

সুরা ফাতিহা আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জন্য বিশেষ নুর—যা অন্য কোনো নবি-রাসুলকে দেওয়া হয়নি। (মুসলিম, হাদিস: ১৭৫০)। শরিয়তসম্মত রুকইয়ার ক্ষেত্রে সুরা ফাতিহার উপকারিতা শীর্ষে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সুরা ফাতিহা মৃত্যু ছাড়া সব রোগের মহৌষধ।’ (শুয়াবুল ইমান, বাইহাকি, হাদিস: ২৩৭০)। সাহাবায়ে কেরাম এ সুরার মাধ্যমে ঝাড়ফুঁক করেছেন। চমৎকার ফলও পেয়েছেন। 

কোরআনের দীর্ঘতম সুরা
২৮৬টি আয়াত বিশিষ্ট সুরা বাকারা মদিনায় অবতীর্ণ। কোরআনের দীর্ঘতম সুরা এটি। বাকারা অর্থ গাভি। এ সুরায় একাধিক স্থানে বাকারা শব্দ এসেছে এবং গাভি জবাইয়ের ঘটনা রয়েছে, এ জন্য এর নাম রাখা হয়েছে সুরা বাকারা। ইসলামের মৌলিক নীতি, বিশ্বাস ও শরিয়তের বিধিবিধানের যতটুকু বিস্তারিত বর্ণনা এই সুরায় করা হয়েছে, ততটুকু অন্য কোনো সুরায় করা হয়নি। এ সুরায় এক হাজার আদেশ, এক হাজার নিষেধ, এক হাজার হেকমত এবং এক হাজার সংবাদ ও কাহিনি রয়েছে। (তাফসিরে মারেফুল কোরআন, পৃষ্ঠা: ১১)। এটি কোরআনের শিখর বা চূড়া। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক জিনিসের একটি চূড়া বা শিখর থাকে। আর কোরআনের শিখর হচ্ছে সুরা বাকারা।’ (তিরমিজি, হাদিস: ২৮৭৮)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের ঘরগুলো কবর বানিয়ো না। নিশ্চয় যে ঘরে সুরা বাকারা তেলাওয়াত করা হয়, শয়তান সে ঘরে প্রবেশ করতে পারে না।’ (তিরমিজি, হাদিস: ২৮৭৭)

রহস্যময় অক্ষরমালা 
সুরা বাকারার প্রথম অক্ষরগুলো ‘আলিফ, লাম, মিম’। এগুলোকে হুরুফে মুকাত্তায়াত (রহস্যময় অক্ষরমালা) বলা হয়। কোরআনের আরও কয়েকটি সুরার শুরুতে এ রকম হরফ রয়েছে। অধিকাংশ সাহাবি, তাবেয়ি এবং আলেমদের মধ্যে সর্বাধিক প্রচলিত মত হলো, হুরুফে মুকাত্তায়াতগুলো রহস্যপূর্ণ, যার মর্ম ও মাহাত্ম্য একমাত্র আল্লাহ তাআলা জানেন। অন্য কাউকে এ বিষয়ে জ্ঞান দেওয়া হয়নি। (তাফসিরে ইবনে কাসির, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ১৭৮-১৭৯)


কোরআনের চ্যালেঞ্জ
কোরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে। এটা সন্দেহাতীতভাবে নির্ভুল। এর কোথাও কোনো সংশয় ও সন্দেহের অবকাশ নেই। তৎকালীন আরবি ভাষার পণ্ডিতেরা এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একটি ভুলও বের করতে পারেনি। কেউ কখনো পারবেও না। এমন ব্যাপক, পূর্ণাঙ্গ, সুস্পষ্ট ও প্রামাণ্যগ্রন্থ জগতে দ্বিতীয়টি নেই। আল্লাহ বলেন, ‘এটা ওই (মহান) কিতাব, যাতে কোনো সন্দেহ নেই।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২) 

বিশ্বাসীদের পাঁচ বৈশিষ্ট্য
এ সুরার ৩ ও ৪ নম্বর আয়াতে মুত্তাকিদের পাঁচটি গুণের কথা বলা আছে। যাদের অন্তরে আল্লাহর ভয় আছে এবং যারা আল্লাহর ভয়ের কারণে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে তারা মুত্তাকি। গুণগুলো হলো—
১. যেগুলো ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, ওই সমস্ত বাস্তব সত্য বিষয়ের ওপর ইমান আনা। যেমন- জান্নাত, জাহান্নাম, হাশর ইত্যাদি। 
২. নামাজ প্রতিষ্ঠা করা। 
৩. জাকাত আদায় করা। 
৪. ওই সমস্ত আসমানি কিতাবের ওপর বিশ্বাস রাখা, যেগুলো যুগে যুগে বিভিন্ন নবি-রাসুলের ওপর অবতীর্ণ হয়েছে। 
৫. পরকাল বিশ্বাস করা।

মুনাফিক চেনার ১২ উপায়
এ সুরার ৮ থেকে ২০ নম্বর আয়াতে মুনাফিক বা কপটের ১২টি চিহ্ন বা আলামতের কথা এসেছে। যেমন- 
১. ধোঁকা দেওয়া।
২. মিথ্যা বলা। 
৩. আল্লাহ-প্রদত্ত বিধিবিধান নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা। 
৪. সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করে নিজেকে শান্তিকামী দাবি করা। 
৫. ইমানদারদের নিয়ে উপহাস করা। 
৬. অন্তরে কপটতা ও বক্রতা থাকা। 
৭. ফিতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টি করা। 
৮. বিশ্বাসীদের বন্ধু দাবি করলেও অবিশ্বাসীদের সঙ্গে গোপন আঁতাত করা। 
৯. মূর্খতা। 
১০. গোমরাহি ও ভ্রষ্টতা। 
১১. হেদায়তের মর্ম বুঝতে না পারা। 
১২. নির্বুদ্ধিতা।


বনি ইসরায়েলের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ
এ সুরার ৪০-১০৩ নম্বর আয়াতে বনি ইসরায়েলের প্রতি পরিপূর্ণ ইমান আনার নির্দেশ, তাদের ওপর আল্লাহর অনুগ্রহ, আল্লাহর বিশেষ নেয়ামত পেয়েও তাদের নাফরমানি, তাদের কাছে সবচেয়ে বেশি নবি-রাসুল প্রেরণ, খাবার হিসেবে মান্না ও সালওয়া, ছায়া হিসেবে শীতল মেঘমালা প্রদান এবং পানির প্রয়োজন মেটাতে পাথরের বুক চিরে ১২টি নদীর প্রকাশ, ফেরাউনের অত্যাচার থেকে নিষ্কৃতি দান, ফেরাউনকে তার বাহিনীসমেত সমুদ্রে নিমজ্জিত, তাদের গো-পূজায় লিপ্ত হওয়া,  এবং সম্পদের লোভে একজন আরেকজনকে হত্যা ইত্যাদি অপকর্মের কথা আলোচিত হয়েছে। 

মানুষ হত্যা ও গাভি নিয়ে বনি ইসরাইলের বাড়াবাড়ি
বনি ইসরায়েলের এক ধনী লোকের উত্তরাধিকারী ছিল তার ভাইয়ের ছেলে। সম্পত্তির লোভে চাচাকে হত্যা করে ছেলে। রাতে গ্রামের এক লোকের দরজায় মরদেহ রেখে আসে। হত্যার অপবাদ দেয় ওই লোকের ওপর। দুই দলের মধ্যে বিবাদ লেগে যায়। মুসা (আ.)-এর কাছে বিচার আসে। আল্লাহর নির্দেশে মুসা (আ.) তাদের একটি গাভি জবাই করে হত্যার রহস্য উদ্‌ঘাটনের আদেশ দেন। তারা ব্যাপারটাকে ঠাট্টা মনে করে। মুসা (আ.) তাদের সতর্ক করেন। তারা তাঁর কথা মেনে নিয়ে গাভির রঙ কেমন হবে জানতে চায়। অথচ আল্লাহর প্রথম নির্দেশে গরুর কোনো নির্দিষ্ট রঙের কথা উল্লেখ ছিল না। তাদের বাড়াবাড়িতে মুসা (আ.) আল্লাহর নির্দেশে রঙের কথা বলেন। তারপর তারা গরুর ব্যাপারে আরও বিস্তারিত জানতে চায়। মুসা (আ.) তা-ও বলে দেন। শুরুতে তারা যেকোনো একটি গরু জবাই করলেই হয়ে যেত। তারা প্রশ্ন করে বিষয়টি জটিল করে তুলে। তারা আল্লাহ বিশ্বাসী ও মা ভক্ত এক যুবকের কাছে বর্ণনাকৃত গাভিটি পেল। যুবকের চাহিদা মতো গরুর চামড়াপূর্ণ স্বর্ণের দামে তারা কিনল। তারা গাভিটি জবাই করল। আল্লাহর নির্দেশ মতো মাংসের একটি অংশ খুন হওয়া মানুষটির দেহে স্পর্শ করলে মৃত মানুষটি জীবিত হয়ে যে মানুষটি বিচার নিয়ে গিয়েছিল, তার নাম বলে দেয়। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘এবং (স্মরণ করো) যখন তোমরা এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছিলে, তারপর তোমরা তার ব্যাপারে একে অন্যের ওপর দোষ চাপাচ্ছিলে। আর তোমরা যা গোপন করছিরে, তা প্রকাশ করে দেওয়া ছিল আল্লাহর অভিপ্রায়।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ৭২) 

হারুত-মারুতের কাহিনি
সোলায়মান (আ.)-এর সময়ে দুই ফেরেশতা বাবেল শহরে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তাদের নাম হারুত-মারুত। হারুত-মারুত কিছু লোককে জাদু শিখিয়েছিলেন। শেখানোর শর্ত ছিল, সেই জাদু কারও ওপর প্রয়োগ করা যাবে না। জাদুবিদ্যা মন্দ, জাদু ও মুজিজার মধ্যে পার্থক্য আছে—সবাইকে এটা শেখানোর জন্যই তাঁরা এসেছিলেন। কিন্তু তারা ফেরেশতাদের কথা রাখল না। জাদুর চর্চা করে ভয়ংকর কুফরিতে লিপ্ত হলো। এ ঘটনার বর্ণনা রয়েছে এ সুরার ১০২ নম্বর আয়াতে।

ইবরাহিম (আ.)-এর কথা
ইবরাহিম (আ.)-এর মর্যাদা ও ব্যক্তিত্ব, তাকে নানা রকমের পরীক্ষায় ফেলানো, সব পরীক্ষায় সর্বোত্তমভাবে কৃতকার্য হওয়া, পিতার মূর্তিপূজা থেকে তার সম্পর্কহীনতা, সম্প্রদায়ের অত্যাচার, নমরুদের সঙ্গে বিতর্ক, অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপের ঘটনা, নিজ ভূমি থেকে হিজরত, স্ত্রী ও নবজাতক ছেলেকে খাদ্য ও পানিশূন্য বিরান এলাকায় রেখে আসার নির্দেশনা, নিজের আদরের একমাত্র পুত্র-সন্তানকে নিজ হাতে জবাই করার হুকুম এবং তার হাত ধরে কাবাঘর নির্মাণের বিবরণ রয়েছে এ সুরার ১২৪ থেকে ১৪১ নম্বর আয়াতে।

কিবলা পরিবর্তন
এ সুরার ১৪৪ নম্বর আয়াতে কিবলা পরিবর্তনের বর্ণনা রয়েছে। ইসলামের সূচনাকালে মুসলমানরা কাবাঘরের দিকে ফিরেই নামাজ আদায় করতেন। মধ্যবর্তী কয়েক মাস (১৬-১৭ মাস) আল্লাহর নির্দেশে বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে ফিরে নামাজ পড়েন তারা। মদিনায় হিজরতের পরও রাসুলুল্লাহ (সা.) বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে ফিরেই নামাজ পড়তেন। তিনি হৃদয় দিয়ে চাইতেন, কাবা হোক কিবলা। তিনি বারবার আকাশের দিকে তাকাতেন। সেদিন তিনি মসজিদে বনু সালামায় জোহর নামাজ আদায় করছিলেন। দুই রাকাত নামাজ আদায়ের পর কিবলা পরিবর্তনের নির্দেশ আসে। নামাজের ভেতরই তিনি বায়তুল্লাহর দিকে ফিরে যান। অবশিষ্ট দুই রাকাত বায়তুল্লাহর দিকে ফিরেই আদায় করেন। 


লেখক: আলেম ও সাংবাদিক




আরও সংবাদ   বিষয়:  তারাবি   আজকের তারাবি   তারাবির সারাংশ   প্রতিদিনের তারাবির সারাংশ  




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ। নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।
ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close