
বর্ধিত সভায় খালেদা জিয়া বক্তব্য দেবেন এটি কিছুক্ষণ আগেও জানতেন না বেশিরভাগ নেতা। এমনকি জানা ছিল না গণমাধ্যমকর্মীদেরও। অনুষ্ঠান সূচিতেও উল্লেখ ছিল না বিএনপি চেয়ারপারসনের বক্তব্যের কথা। সভার শুরুর দিকে হঠাৎই মঞ্চ থেকে ঘোষণা আসে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেবেন বিএনপি চেয়ারপারসন। যিনি কি না দেড় মাসের বেশি সময় ধরে লন্ডনে চিকিৎসাধীন। খালেদা জিয়া বক্তব্য দেওয়ার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে নড়েচড়ে বসেন উপস্থিত নেতারা। সভাস্থলে একজন আরেকজনকে বলছিলেন, ‘ম্যাডাম আজ বক্তব্য দেবেন। আয়োজক কমিটিকে ধন্যবাদ ম্যাডামের বক্তব্য শোনার ব্যবস্থা করে দেওয়ায়।’
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উদ্বোধনী বক্তব্যের পরপর দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বড়পর্দায় দেখা যায় খালেদা জিয়াকে। তার জন্য সভামঞ্চের মাঝখানের একটি চেয়ার ফাঁকা রাখা হয়। খালেদা জিয়াকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে নেতাকর্মীরা দাঁড়িয়ে মুহুর্মুহু করতালি দিয়ে অভিবাদন জানান। অনেকে নেত্রীর নাম ধরে স্লোগান দিতে থাকেন। নেতাকর্মীদের এমন বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসের মধ্য দিয়ে বক্তব্য শুরু করেন বিএনপি চেয়ারপারসন। মা খালেদা জিয়া যখন বক্তব্য দিচ্ছিলেন তখন পাশে ভার্চুয়ালি বসে ছিলেন ছেলে তারেক রহমান। দলের চেয়ারপারসনের বক্তব্যের সময়ে তৃণমূলসহ সিনিয়র নেতারা পিনপতন নীরবতার মধ্যে তাদের নেত্রীর কথা শুনতে দেখা যায়। অনেকে মোবাইল ফোনে খালেদা জিয়ার বক্তব্য দেওয়ার দৃশ্যটি মোবাইল ফোনে ক্যামেরাবন্দি করেন। কেউ কেউ তার ভিডিও ধারণ করেন।
খালেদা জিয়া বক্তব্য দেওয়ার সময় লন্ডনে তার সঙ্গে থাকা ব্যক্তিগত চিকিৎসক এজেডএম জাহিদ হোসেন ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন। স্বল্পপরিসরের বক্তব্যে নেতাকর্মীদের উদ্দেশে খালেদা জিয়া ঐক্যবদ্ধ বিএনপি গড়ে তোলার বার্তা দেন। এ জন্য জনগণকে সম্পৃক্ত করার আহ্বান জানান তিনি। খালেদা জিয়া বলেন, আমি যুক্তরাজ্য থেকে অসুস্থ অবস্থায় আপনাদের আহ্বান জানাতে চাই, আসুন জনগণকে সম্পৃক্ত করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে পূর্বের ন্যায় আন্দোলন, সংগ্রাম ও রাষ্ট্র পরিচালনার নেতৃত্ব দিতে আরও ঐক্যবদ্ধ এবং সুসংহতভাবে গড়ে তুলি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ বিশেষ করে তরুণসমাজ আজ এক ইতিবাচক গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সংকীর্ণতা ভুলে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে আমাদের কাজ করতে হবে। এখনও ফ্যাসিস্টদের দোসররা এবং বাংলাদেশের শত্রুরা গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্জনকে নস্যাৎ করার জন্য গভীর চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে।
বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণে খালেদা জিয়া পরামর্শ দিয়ে বলেন, ইস্পাত কঠিনে ঐক্যের মাধ্যমে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ওদের চক্রান্তকে ব্যর্থ করে দিতে হবে, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। আসুন আমরা আগামী দিনগুলোতে শহিদ জিয়াউর রহমানের স্বপ্নের আধুনিক, সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য আমাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করি এবং এত ত্যাগের বিনিময় এ অর্জনকে সুসংহত এবং ঐক্যকে আরও বেগবান করি।
বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, আপনাদের মাধ্যমে ছাত্র-যুবকসহ দেশবাসীর কাছে আহ্বান রাখতে চাই, আসুন প্রতিহিংসা-প্রতিশোধ নয় পারস্পরিক ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্বে মাধ্যমে আমরা সবাই মিলে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থেই একটি বাসযোগ্য উন্নত ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করি।
খালেদা জিয়া বলেন, দীর্ঘ ছয় বছর পর নেতারা আবার একসঙ্গে ফ্যাসিস্টমুক্ত বাংলাদেশে একত্রিত হয়েছেন। সে জন্য আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া আদায় করছি। দীর্ঘ ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামে যারা শহিদ হয়েছেন এবং সম্প্রতি জুলাই-আগস্টের ফ্যাসিবাদী শাসনের নির্মম ও ভয়াবহ দমননীতির কারণে গণহত্যায় যারা শহিদ হয়েছেন তাদের প্রতি আমি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। যারা আহত হয়েছেন তাদের প্রতি জানাচ্ছি আন্তরিক সমবেদনা। আমি চিকিৎসার কারণে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করলেও আমি সবসময় আপনাদের পাশেই আছি। দীর্ঘ ১৫ বছর গণতন্ত্রের জন্য, আমার মুক্তির জন্য আপনারা যে নিরন্তর সংগ্রাম করেছেন এবং আমাদের অসংখ্য সহকর্মী প্রাণ দিয়েছে, জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং প্রায় সোয়া লাখ মিথ্যা মামলায় জর্জরিত হয়েছেন এখনও তারা আদালতের বারান্দায় ন্যায়বিচার পাওয়ার আশায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আপনাদের শুধু দল নয়, জাতি চিরকাল স্মরণ রাখবে।
বক্তব্যের সময় খালেদা জিয়াকে বেশ সুস্থ ও মানসিকভাবে দৃঢ় মনে হয়েছে। তিনি ছেলের বাসায় একটি সোফায় বসে লিখিত বক্তব্য দেন। পরে তাদের নেত্রী খালেদা জিয়াকে নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে বেশ উচ্ছ্বাস দেখা যায়। তারা অনেকটা সুস্থ খালেদা জিয়াকে দেখে আনন্দের সঙ্গে আবেগাপ্লুপত হয়ে পড়েন।
ছাত্রদল সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব সময়ের আলোকে বলেন, ‘বর্ধিত সভায় সবচেয়ে বেশি মিস করেছি গণতন্ত্রের মাতা ম্যাডাম খালেদা জিয়াকে। কতটা মিস করেছি তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। আমাদের প্রত্যাশা এরপর থেকে ম্যাডাম সরাসরি দলীয় কর্মসূচিতে উপস্থিত থাকবেন। আমরা উনার সুস্থতার জন্য দোয়া করি।’
গাইবান্ধা জেলা বিএনপির সভাপতি ডা. মইনুল হাসান সাদিক সময়ের আলোকে বলেন, সাত বছর পর বড় কোনো দলীয় অনুষ্ঠানে আমরা খালেদা জিয়ার বক্তব্য শুনতে পেরেছি। যদিও তিনি ভার্চুয়ালি যুক্ত হন। আমরা উনাকে দেখে বেশ উজ্জীবিত। কারণ উনার বক্তব্য ছিল অত্যন্ত সাবলীয় ও স্বতঃস্ফূর্ত। আমাদের প্রত্যাশা দ্রুতই চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দলীয় অনুষ্ঠানে শারীরিকভাবে উপস্থিত হবেন। সামনাসামনি দেখতে পেলে নেতাকর্মীরা আরও চাঙ্গা হবেন।
লন্ডনে নিজের ছেলে তারেক রহমানের বাসায় লন্ডন ক্লিনিকের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সার্বিক তত্ত্বাবধানে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়া। গত ৭ জানুয়ারি তাকে কুয়েতের আমিরের পাঠানো বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে লন্ডন নিয়ে লন্ডন ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। সেখানে কয়েক দিন চিকিৎসায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তারেক রহমান বাসায় চিকিৎসার নেওয়ার জন্য ছাড়পত্র দেয়। ২০১৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর লা মেরিডিয়ান হোটেলে বিএনপির সবশেষ বর্ধিত সভা হয় যেখানে খালেদা জিয়া সভাপতিত্ব করেছিলেন। এর চার দিনের মাথায় তিনি কারাবরণ করেন।