
মার্কিন জালে ফেঁসেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়াল্টজ বৃহস্পতিবার বলেছেন, তাকে আবার আলোচনায় বসতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। পাশাপাশি ইউক্রেনের খনিজ সম্পদে মার্কিন প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে একটি চুক্তি করতে হবে।
বুধবার ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির তীব্র সমালোচনা করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি তাকে ‘নির্বাচনবিহীন স্বৈরাচার’ হিসেবেও অভিহিত করেন। সেই ধারাবাহিকতায় জেলেনস্কির সমালোচনায় মেতেছেন বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ও ট্রাম্পের বন্ধু ইলন মাস্কও। বৃহম্পতিবার তিনি বলেছেন, যুদ্ধে যখন শিশুরা মারা যাচ্ছিল তখন জেলেনস্কি তার স্ত্রীকে নিয়ে ভগের ম্যাগাজিনে মডেল হয়ে ফটোশ্যুট করেছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের বিরল খনিজ সম্পদের অংশীদারত্ব দাবি করলে গত বুধবার জেলেনস্কি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন যে ওই চুক্তি করলে রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের চলমান যুদ্ধে মার্কিন সহায়তার ক্ষেত্রে এর প্রতিফলন থাকবে। মাইক ওয়ালটজ বৃহস্পতিবার হোয়াইট হাউসের এক ব্রিফিংয়ে বলেন, সপ্তাহের শুরুতে ট্রাম্পকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ অপমান করার কারণে হোয়াইট হাউস ভলোদিমির জেলেনস্কির প্রতি ‘খুব হতাশ’।
ইউক্রেন বিপুল পরিমাণ গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ও খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ। সেসবের মাঝে যেমন লিথিয়াম ও টাইটানিয়াম আছে, পাশাপাশি অনেক বড় পরিসরে কয়লা, গ্যাস, তেল ও ইউরেনিয়ামের মজুদ রয়েছে; যার বাজারমূল্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। বৃহস্পতিবারের আগে ওয়াল্টজ পরামর্শ দিয়েছিলেন যে ইউক্রেন যদি যুক্তরাষ্ট্রকে তার খনিজ সম্পদে প্রবেশ করার অধিকার দেয়, তা হলে তাদেরকে মার্কিন সহায়তা দেওয়া যেতে পারে। বা, ইতিমধ্যে যে মার্কিন সহায়তা দেওয়া হয়েছে, এটিকে তার ক্ষতিপূরণ হিসেবেও দেখা যেতে পারে। আমরা ইউক্রেনীয়দের সত্যিই একটি অবিশ্বাস্য এবং ঐতিহাসিক সুযোগ দিয়েছি যোগ করে মাইক ওয়াল্টজ বলেন, এটি ‘টেকসই’ এবং ইউক্রেনের জন্য ‘সেরা’ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। তবে জেলেনস্কি এই প্রস্তাবকে নাকচ করে বলেন, ‘আমি আমাদের রাষ্ট্রকে বিক্রি করতে পারি না।’
কিয়েভে কিথ কেলোগের সঙ্গে জেলেনস্কির বৈঠক শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ পরে ইউক্রেনীয় নেতা ঘোষণা করেন যে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘একটি বিনিয়োগ ও নিরাপত্তা চুক্তি’ করতে প্রস্তুত, যা ইউক্রেনের যুদ্ধ শেষ করতে সাহায্য করবে। এরপর মাইক ওয়াল্টজ হোয়াইট হাউসের সংবাদ সম্মেলনে ওই মন্তব্য করেন। জেলেনস্কি কিয়েভের বৈঠকটিকে ‘ফলপ্রসূ’ বলে অভিহিত করেন ঠিকই, কিন্তু এটিকে অনেকটা অপ্রতিভ রাজনৈতিক সাক্ষাতের মতো মনে হচ্ছিল।
ট্রাম্পের পক্ষের সিনিয়র নেতারা যখন সরাসরি মস্কোর সঙ্গে যোগাযোগ করছিল, তখন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল কেলোগ বলেন তিনি কিয়েভে কেবল ‘শুনতে’ গিয়েছিলেন। কিন্তু এটি খুব দ্রুতই স্পষ্ট হয়ে যায় যে তিনি প্রকাশ্যে কিছু বলবেন না। কারণ শেষ মুহূর্তে একটি সংবাদ সম্মেলন বাতিল হয়ে যায়। বিবিসি জানতে পেরেছে যে এটি একটি মার্কিন সিদ্ধান্ত ছিল। ইউক্রেনীয় সূত্রগুলো দাবি করেছে যে তারা বিশ্বাস করে, কেলোগকে হোয়াইট হাউস সাইডলাইনে রেখেছে। কিয়েভের জন্য কেলোগের সঙ্গে বৈঠকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ ইউক্রেনের কর্মকর্তারা তার মাধ্যমে তাদের চাওয়াগুলো ওয়াশিংটনকে জানাতে পারতেন।
এক্সে শেয়ার করা এক পোস্টে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট বলেন যে তিনি ও বিশেষ মার্কিন দূত যুদ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতি, যুদ্ধবন্দিদের ফেরত আনার উপায় এবং কার্যকর নিরাপত্তা নিশ্চিতের ব্যবস্থা নিয়ে ‘বিস্তারিত আলোচনা’ করেছেন। তিনি আরও বলেন, ‘ইউক্রেন চুক্তি করার জন্য প্রস্তুত।’
বৃহস্পতিবারের পর জেলেনস্কি জানান যে, তিনি কানাডা, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে ও দক্ষিণ আফ্রিকার নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। এক পোস্টে তিনি লেখেন, ‘ইউক্রেনকে বাদ দিয়ে ইউক্রেন সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত নয়।’
এদিকে কিথ কেলোগ কেন সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতে চাননি, তার সম্ভাব্য কারণগুলো উঠে আসছে। কেলোগের এই বৈঠক এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে হয়েছে, যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ভলোদিমির জেলেনস্কির মধ্যে তীব্র বাকযুদ্ধ চলছে। ট্রাম্প সম্প্রতি ইউক্রেনের নেতাকে ‘অনির্বাচিত একনায়ক’ বলে আক্রমণ করেছেন। একইসঙ্গে তিনি দাবি করেছেন, যুদ্ধের জন্য জেলেনস্কিই দায়ী।
এখন বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা যাচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের একটি প্রস্তাবকে স্বীকৃতি দিতে চাইছে না যেখানে মস্কোকে আক্রমণকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং ইউক্রেনের আঞ্চলিক অখ-তাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
এই সপ্তাহের শুরুর দিকে সিনিয়র রাশিয়ান এবং মার্কিন কর্মকর্তারা যুদ্ধ শেষ করার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করতে সৌদি আরবে একটি বৈঠক করেন। সেখানে জেলেনস্কিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ তিন বছর আগে শুরু হয়, যখন রাশিয়া ইউক্রেনে পুরোদমে আক্রমণ শুরু করে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে এক মাস ধরে ক্ষমতায় থাকা ট্রাম্প বিশ্বাস করেন যে এই যুদ্ধে মার্কিন সম্পৃক্ততা আমেরিকার স্বার্থে নয়। তাই তিনি আগের মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি থেকে সরে এসে সরাসরি রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত যুদ্ধ শেষ করতে চাইছেন।
গত মঙ্গলবার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও সৌদি আরবে রাশিয়ান কূটনীতিকদের সঙ্গে ৪ ঘণ্টার বেশি আলোচনার পরে জানান, উভয় পক্ষই আলোচনার প্রাথমিক ধাপে সম্মত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে বৈঠকের পরে ডোনাল্ড ট্রাম্প ইঙ্গিত দেন যে ভলোদিমির জেলেনস্কি ‘যুদ্ধ শুরু করেছিলেন’ যা নিয়ে জেলেনস্কি মন্তব্য করেন যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ‘মস্কোর তৈরি বিভ্রান্তিকর তথ্যের জগতে বসবাস করছেন।’
তার জবাবে মি. ট্রাম্প তাকে ‘একনায়ক’ আখ্যা দিয়ে সমালোচনা করেন এবং দাবি করেন যে ইউক্রেনের মানুষদের মধ্যে ভলোদিমির জেলেনস্কির জনপ্রিয়তা কমে গেছে।
মাস্কের মন্তব্য : জেলেনস্কি ও তার স্ত্রীর ২০২২ সালের ২৬ জুলাই ‘ভগ ম্যাগাজিনে’ প্রকাশিত ছবি ও সংবাদমাধ্যম ডেইলি মেইলের সংবাদের স্ক্রিনশট নিজের এক্স অ্যাকাউন্টে প্রকাশ করেছেন মাস্ক। সংবাদটি শেয়ার করে ইলন মাস্ক বৃহস্পতিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) এক্সে লিখেছেন, ‘শিশুরা যখন যুদ্ধের সম্মুখভাবে পরিখায় থেকে মারা যাচ্ছে, তখন জেলেনস্কি এই কাজ করেছিলেন।’
ডেইলি মেইল ওই ছবি প্রকাশের সময় জেলেনস্কির সমালোচনা করে তাদের শিরোনাম করেছিল, ‘রিড দ্য রুম, জেলেনস্কি ও তার স্ত্রী সবাইকে অবাক করেছেন, বিখ্যাত ফটোগ্রাফার অ্যানি ল্যাবিউইৎজের জন্য ভগের হয়ে ছবি তুলে। যখন রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের যুদ্ধের তীব্রতা বাড়ছে।’