প্রকাশ: মঙ্গলবার, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ৯:৫৬ এএম আপডেট: ১১.০২.২০২৫ ১০:০২ এএম (ভিজিট : ৫৩৫)

অন্তর্বর্তী সরকারকে বেকায়দায় ফেলা এবং পুরো দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে শেখ হাসিনাসহ পালিয়ে যাওয়া এমপি ও মন্ত্রীদের যেন ঘুম নেই। নিয়মিত বক্তব্য ও বিবৃতিতে মিথ্যা ও বানোয়াট অপতথ্য প্রচার করে কর্মীদের উসকে দিচ্ছেন।
জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার ৬ মাস ইতিমধ্যে পূর্ণ হয়েছে। অতীতে আওয়ামী লীগের এত বড় পরাজয় আর কখনো হয়নি। দেশ ও দল পরিচালনায় চরমভাবে ব্যর্থ শেখ হাসিনার পক্ষে এ পরাজয় মেনে নেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে সে ক্ষেত্রেও দেখা দিয়েছে ধোঁয়াশা। তবু বারবার রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শন করে আওয়ামী লীগের ফেরার চেষ্টা যে ভুল তা আরও একবার প্রমাণিত হলো ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি বিসর্জনের মধ্য দিয়ে।
অন্তর্বর্তী সরকারকে বেকায়দায় ফেলা এবং পুরো দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে শেখ হাসিনাসহ পালিয়ে যাওয়া এমপি ও মন্ত্রীদের যেন ঘুম নেই। নিয়মিত বক্তব্য ও বিবৃতিতে মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য প্রচার করে কর্মীদের উসকে দিচ্ছেন। নেতৃত্বহীন কর্মীরা তাদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে পড়ছেন বিপদে, দেশকে করছেন অস্থিতিশীল।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অনেক ভুল-ভ্রান্তি আছে। নানাদিকে আছে সমালোচনা। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক হয়নি। ছাত্র সমন্বয়কদের ঐক্য আগের মতোন দৃশ্যমান নয়। এসব ধারণা থেকেই দীর্ঘ ৬ মাস পর আওয়ামী লীগের রাজনীতির মাঠে পুরোশক্তি নিয়ে নামতে চাইছে যা সর্বশেষ শেখ হাসিনার ভারতের দিল্লি থেকে লাইভে সংযুক্ত হয়ে ছাত্র-জনতা ও দলীয় কর্মীর উদ্দেশে বক্তব্যের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়। চেষ্টাটি সম্পূর্ণ ব্যর্থ এ অর্থে যে, তার বক্তব্যে কোনো নতুনত্ব নেই।
সেই পুরোনো অভিযোগ এবং তার পরিবারের বাইরে তেমন কোনো কথা নেই। নেই কোনো অনুশোচনা কিংবা ক্ষমা চাওয়ার মাহাত্ম্য। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারসহ পুরো ছাত্র আন্দোলনকে একটি জঙ্গি তকমা দেওয়ার পুরোনো অভ্যাস থেকে ফিরতে পারেননি। পুরো বক্তব্যে তাকে দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নয় যেন তিনি এ দেশের রাজা ছিলেন এমন ভূমিকায় কথা বলেছেন। প্রজারা তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে এদেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে।
হঠাৎ কেন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসাটি ভাঙা হলো? এতদিন পর এ ধরনের ঘটনা কারও কি কাম্য ছিল? নানা ধরনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে সবাই হয়তো শেখ হাসিনাকেই দুষবেন। হয়েছেও তাই। ছাত্র-জনতা তো ৫ আগস্টেই ভাঙতে পারত। বরং অনেকের মতে, শেখ হাসিনার বক্তব্যই ছাত্র-জনতাকে এমন কাজ করতে উসকে অথবা সুযোগ করে দিয়েছে।
ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়িতে ভাঙচুরের ঘটনা অনভিপ্রেত ও অনাকাক্সিক্ষত উল্লেখ করে অন্তর্বর্তী সরকারের এক বিবৃতিতে বলা হয়, গত ৬ মাসে ৩২ নম্বরের বাড়িতে কোনো ধরনের আক্রমণ ও ধ্বংসযজ্ঞ হয়নি। শেখ হাসিনা বক্তব্যে জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আত্মদানকারীদের অপমান ও অবমাননা করেছেন। বিকৃতিতে আরও অভিযোগ করা হয়, শহিদের মৃত্যু সম্পর্কিত অবান্তর, আজগুবি ও বিদ্বেষমূলক কথা বলে জুলাই গণঅভ্যুত্থানকেই অবজ্ঞা করেছেন। তা ছাড়া গণঅভ্যুত্থানের মুখে পালিয়ে যাওয়ার পরও তিনি হুমকির সুরে কথা বলেছেন। মানুষের মনে জুলাই গণহত্যা নিয়ে যে ক্ষত রয়েছে, সে ক্ষতে একের পর এক আঘাত করেছেন। তার সহিংস আচরণের জবাবেই ধানমন্ডির বাসাটিতে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।
অনেকের কাছে সরকারের এ বিবৃতি একটি গতানুগতিক এবং দায়সারা হতে পারে। কিন্তু তিনি কেন কোনো ধরনের অনুশোচনা কিংবা ভুল স্বীকার না করে এই গণহত্যাকে আন্দোলনকারীদের ওপর চাপানোর চেষ্টা করেছেন এবং গণঅভ্যুত্থানকে অবজ্ঞা ও অশ্রদ্ধা করেছেন? তা কি তিনি করতে পারেন? ঘণ্টাখানেকের ভাষণে তিনি আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের রাস্তায় নামার নির্দেশ দিলেন। অথচ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের প্রধান নেতারা সফরে আনন্দে দিনানিপাত করছেন। নেত্রী নির্দেশ দিয়ে যে নেতাকর্মীদের রাস্তায় নামিয়ে দিলেন, তাদের প্রত্যেকের বাবা-মা, সন্তান-স্ত্রী পরিজনসহ একটি পরিবার আছে। তাদের প্রত্যেকের নিজের ভবিষ্যৎ আছে। নিজের পরিবার-পরিজনের কথা ভাবলেন, অথচ একবারও এদের নিরাপদ জীবনের কথা তিনি ভাবলেন না?
তার এমন বক্তব্যে সুস্থ ধারার রাজনীতিতে ফিরতে আগ্রহী আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা চরম হতাশ হয়েছেন। জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীসহ পুরো দেশবাসী হয়তো শেখ হাসিনার এমন আচরণে অবাক হয়নি। তার একঘেয়েমি চরিত্রের কাছে পুরো দেশ যে জিম্মি হয়ে পড়েছিল তা সবারই জানা। বিদেশে বসে দেশের বিরুদ্ধে এমন প্রকাশ্য ষড়যন্ত্র অতীতে কেউ করেছে বলে জানা নেই।
ফেব্রুয়ারিজুড়ে আওয়ামী লাগের বিভিন্ন কর্মসূচি এবং তার বক্তব্যকে কেন্দ্র করে জনগণের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে শুধু ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়িটিই ভাঙেনি, জেলায় জেলায় ভেঙে দেওয়া হয়েছে সাবেক মন্ত্রী, এমপি এবং নেতাকর্মীদের অনেক বাড়িঘর। গণঅভ্যুত্থানের ৬ মাস পর কেন এমন ঘটনা ঘটল তা বিশ্লেষণ করলে শুধু তার বক্তব্য নয়, বরং পদ্ধতিগত ত্রুটির কারণেই এমনটি ঘটছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
এদিকে একই সময়ে গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম এক অডিও বার্তায় ঘোষণা দিলেন, আমাদের কথা স্পষ্ট, যে রাজধানীতে দিনের বেলা স্বাধীনভাবে ঘুরতে পারব না, চলতে পারব না, আমাদের চূড়ান্ত ডিসিশন সেই রাজধানীতে রাতের বেলায় মানুষ ঘুমাতে পারবে না।
এ ধরনের চরমপন্থা কথায় উত্তাল গাজীপুরসহ সারা দেশ। ছাত্র-জনতার বিক্ষোভে গাজীপুর এখন থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। তিনি তার নেত্রীর নির্দেশেই কি এমন বক্তব্য দিলেন? তিনি কোথায় আছেন? দেশে আছেন নাকি কর্মীদের বিপদে ফেলে হত্যাযজ্ঞকে উসকে দিচ্ছেন? তার বক্তব্যে গাজীপুরে যে তাণ্ডব হলো তার দায় কার?
গাজীপুর থেকেই শুরু হয়েছে অপারেশন ডেভিল হান্ট। অভিযানের প্রথমদিনে ১ হাজার ৩০৮ জনকে গ্রেফতার করেছে যৌথবাহিনী। অপারেশন ডেভিল হান্টে শত শত আওয়ামী কর্মী বিপদে পড়বে নিশ্চিত কিন্তু তারা তো ঘোষণা দিয়ে নিরাপদে গা-ঢাকা দিয়েই আছেন। সত্যিকার অর্থে আওয়ামী ফাঁদে পা দিচ্ছে বড় বড় নেতাসহ হাজারো কর্মী। এদের ভবিষ্যৎ কী? এদের তো দেশেই থাকতে হবে? দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে রাজনীতির একটি ফাঁদ তৈরি করছে একটি অংশ। ভবিষ্যতে রাজনৈতিক সুবিধা হাসিলের জন্য একটি রাজনৈতিক ফাঁদ তৈরি করছে বড় রাজনৈতিক দলগুলো। মামলা-হামলায় জড়িয়ে তাদের রাজনীতিতে বাধ্য করা হচ্ছে।
শেখ হাসিনা কি চায় তার নেতাকর্মীদের বাসা ভেঙে দিক, তাদের গ্রেফতার করুক, যাতে জনগণের একটি অংশের সহানুভূতি অর্জন করতে পারে? জুলাই আন্দোলনের পর যখনই দেশ স্থিতিশীলতার দিকে এগিয়ে যায়, ঠিক তখনই কোনো না ইস্যু নিয়ে আন্দোলনের নামে দেশকে অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করাই কি প্রধান উদ্দেশ্য? নাকি ভবিষ্যতে একটি সুস্থ ধারার রাজনীতিতে ফিরে আসার পরিকল্পনা করা উচিত? আওয়ামী লীগের অনেক সাধারণ কর্র্মী ঘরের বাইবে বের হয়ে আসতে পেরেছিল কিংবা আশা করছিল তাদের ওপর আর কোনো সহিংস হামলা হবে না। কিন্তু প্রতিনিয়ত মিথ্যা গুজবে এবং মিথ্যা আশ্বাসে প্রতারিত হচ্ছে আওয়ামী লীগের কর্মীরাই। এভাবে আস্থাভাজন বহু কর্মীকে বলি দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের পরিকল্পনা হয়তো আর সফল হবে না।
প্রশ্ন আসছে, শত শত হত্যা মামলা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে একজন ওয়ারেন্টভুক্ত আসামিকে কোনো আশ্রিতা দেশ এমন বক্তব্য দিতে সাহায্য করতে পারে কি? তারা বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল দেখতে চায়? বাংলাদেশ সরকার ভবিষ্যতে যদি এমন কোনো আচরণ করে তখন কি তারা মেনে নেবে? নাকি ভারতের স্বার্থেই ভারতকে এমন কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে?
সময়ের আলো/এএ/