*আদালতকে বিকেন্দ্রীকরণে বিচার বিভাগ সংস্কার *২৫টি মন্ত্রণালয় ও ৪০টি বিভাগে পুনর্বিন্যাস করার সুপারিশ জনপ্রশাসনে *সংসদের মেয়াদ চার ও প্রধানমন্ত্রী পদে দুইবার সংবিধান কমিশন *বিচার প্রক্রিয়ায় দোষী সাব্যস্ত না হওয়ার আগে মিডিয়া ট্রায়াল নয় পুলিশ সংস্কার কমিশন *এমপিদের বিশেষ প্রটোকল বাতিল চায় নির্বাচন সংস্কার কমিশন *রাজনীতি ও আমলানির্ভরতা কমিয়ে ৪৭ সুপারিশ দুদক কমিশন

রাষ্ট্র সংস্কারে গঠিত প্রথম ধাপের ছয় কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। শনিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্থার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ও সংবিধান সংস্কার কমিশনের (প্রথম খণ্ড) পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।
এর আগে গত ১৫ জানুয়ারি সংবিধান সংস্কার কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশন এবং দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা পড়ে। সেদিন কমিশনগুলোর প্রধানরা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন। গত ৫ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেওয়া হয় জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ও বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন।
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের ২৮ দফার ৪ নম্বর দফায় রয়েছে আদালতের বিকেন্দ্রীকরণ। এতে বলা হয়েছে, সংবিধানের ১০০ অনুচ্ছেদ সংশোধনীর মাধ্যমে রাজধানীর বাইরে প্রতিটি বিভাগীয় সদরে হাইকোর্ট বিভাগের স্থায়ী বেঞ্চ প্রতিষ্ঠা করা। তবে হাইকোর্ট বিভাগের এখতিয়ারের পূর্ণাঙ্গতা বা অবিভাজ্যতা এমনভাবে বজায় রাখতে হবে, যেন স্থায়ী বেঞ্চগুলো স্থাপনের কারণে দেশের সর্বত্র কর্তৃত্ব প্রয়োগের ক্ষেত্রে হাইকোর্ট বিভাগের এখতিয়ার কোনও ভৌগোলিক সীমারেখা দ্বারা বিভাজিত না হয় এবং রাষ্ট্রের একক চরিত্র ক্ষুণ্ণ না হয়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে যে, উপজেলা সদরের ভৌগোলিক অবস্থান ও বৈশিষ্ট্য, জেলা-সদর থেকে দূরত্ব ও যাতায়াত ব্যবস্থা, জনসংখ্যার ঘনত্ব ও বিন্যাস এবং মামলার চাপ বিবেচনা দেশের বিভিন্ন উপজেলায় সিনিয়র সহকারী জজ ও প্রথম শ্রেণির জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত স্থাপন।
এদিকে, মন্ত্রণালয়গুলোকে যুক্তিসংগতভাবে হ্রাস করে সরকারের সব মন্ত্রণালয়কে মোট ২৫টি মন্ত্রণালয় ও ৪০টি বিভাগে পুনর্বিন্যাস করার সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। একইসঙ্গে সব মন্ত্রণালয়কে সমপ্রকৃতির পাঁচটি স্বল্প মেয়াদি গুচ্ছে বিভক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে।
সংস্কার সুপারিশে পুরনো চারটি বিভাগের সীমানাকে চার প্রদেশে বিভক্ত করে প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা চালু, কুমিল্লা ও ফরিদপুর নামে নতুন দুটি বিভাগ, ‘নয়াদিল্লির মতো’ কেন্দ্র শাসিত ‘রাজধানী মহানগর সরকার’ গঠন করে প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে পুনর্বিন্যাসের জন্য সংস্কার প্রস্তাব করা হয়েছে। একইসঙ্গে একটির বদলে তিনটি পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠন এবং উপসচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডারের কোটা ৭৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫০ শতাংশে আনার মতো প্রস্তাবও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
সংস্কার প্রতিবেদনকে মোট ১৭টি অধ্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। এরমধ্যে আছে জনপ্রশাসনের কর্মচারীদের আচরণগত সংস্কার, নাগরিক পরিষেবা উন্নয়নে জনপ্রশাসন, জনপ্রশাসনের প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত পুনর্গঠন (মন্ত্রণালয়/দফতর পুনর্বিন্যাসকরণ), সিভিল সার্ভিসের কাঠামো ও প্রক্রিয়াগত সংস্কার, জনপ্রশাসনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির সংস্কার, জনপ্রশাসনে নিরপেক্ষতা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সংস্কার, জনপ্রশাসনের নৈপুন্য বিকাশ ও সক্ষমতার উন্নয়ন, কর্মদক্ষ জনপ্রশাসনের জন্য সংস্কার, জনপ্রশাসনে কার্যকারিতার লক্ষ্যে সংস্কার, বাংলাদেশ স্বাস্থ্য সার্ভিস সংস্কারে বিশেষ সুপারিশমালা, বাংলাদেশ শিক্ষা সার্ভিস সংস্কারে বিশেষ সুপারিশমালা, পার্বত্য এলাকার জনপ্রশাসন সংস্কারে বিশেষ সুপারিশ, জনপ্রশাসনে নারীবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিতে সংস্কার প্রস্তাব।
অপরদিকে, বাংলাদেশ বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীনদের অগণতান্ত্রিক প্রবণতা ও ফ্যাসিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য ১৯৭২ সালে রচিত দেশের প্রথম সংবিধানের ‘দুর্বলতাকে’ দায়ী করেছে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত সংবিধান সংস্কার কমিশন। এই কমিশনের ভাষ্য, ফ্যাসিবাদের বীজ ৭২ সালের সংবিধানের মাঝেই নিহিত ছিল।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পরবর্তীকালের অগণতান্ত্রিক প্রবণতা ও শেষপর্যন্ত ফ্যাসিবাদের বীজ ৭২ সালের সংবিধানের মাঝেই নিহিত ছিল। এরই ফলাফল হল প্রতিটি আমলেই ক্ষমতার পূঞ্জীভবন আরও ঘনীভূত হয়েছে, আমলাতান্ত্রিকতা আরও প্রকট রূপ পেয়েছে, বিচারবিভাগ ক্রমশ বেশি বেশি হারে দলীয়করণের শিকার হয়েছে, জবাবদিহিতার অভাবে ক্ষমতাসীনদের আর্থিক দুর্নীতি আরও প্রবল চেহারা নিয়েছে। একইভাবে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা দল, রাষ্ট্র ও সমাজে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশকে রুদ্ধ করেছে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকেও ধ্বংস করেছে। এভাবে ১৯৭২ সালে একজন একক ব্যক্তি ও একটি দলকে কেন্দ্রে রেখে যে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত উত্তরোত্তর স্বৈরতন্ত্রী চেহারা ধারণ করতে করতে অবশেষে বাংলাদেশ জুড়ে একটি ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম করেছে।
সংসদের মেয়াদ চার বছর করার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী পদে সর্বোচ্চ দুইবার দায়িত্ব পালনের সুযোগ রাখাসহ দেশের সাংবিধানিক নাম এবং সংসদীয় কাঠামোতে পরিবর্তনের মত সুপারিশ করা হয়েছে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে।
১৪৪ পৃষ্ঠার এ প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়েছে, একজন ব্যক্তি জীবদ্দশায় সর্বোচ্চ দুইবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পাবেন। প্রধানমন্ত্রী পদের মেয়াদ হবে ৪ বছর করে। এ সময় তিনি রাজনৈতিক দলের প্রধান বা সংসদ নেতা হতে পারবেন না। এ কমিশনের সুপারিশ প্রস্তুত করতে গিয়ে প্রায় এক লাখ মানুষের মতামত নেওয়ার কথা বলেছেন আলী রীয়াজ। কমিশনের সদস্যদের পাশাপাশি ৩২ জন গবেষক এতে কাজ করেছেন। পাঁচ খণ্ডের এ প্রতিবেদনের প্রথমেই রয়েছে ভূমিকা, পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশসমূহের সারসংক্ষেপ; যা ইতোমধ্যে প্রকাশ করেছে সরকার। এটি তিন অধ্যায়ে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। প্রথম অধ্যায়ে রয়েছে বিদ্যমান সংবিধানের পর্যালোচনা, দ্বিতীয় অধ্যায়ে রয়েছে সুপারিশসমূহ ও তৃতীয় অধ্যায়ে রয়েছে সুপারিশের যৌক্তিকতা।
দ্বিতীয় খণ্ডে ১২১ দেশের সংবিধানের পর্যালোচনার ফল রাখা হয়েছে; তৃতীয় খণ্ডে রাজনৈতিক দল, সিভিল সোসাইটিসহ ব্যক্তির মতামতের সারাংশ রয়েছে; চতুর্থ খণ্ডে কার্যাবহ এবং পঞ্চম খণ্ডে রাজনৈতিক দলের থেকে সংবিধান সংস্কারের সুপারিশ রয়েছে।
অন্যদিকে, বিচার প্রক্রিয়ায় সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে চূড়ান্তভাবে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত মিডিয়ার সামনে কাউকে অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন করা যাবে না বলে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জমা দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এ সুপারিশ করেছে পুলিশ সংস্কার কমিশন।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো প্রায়শই গ্রেফতারের পর অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গণমাধ্যমের সামনে এমনভাবে উপস্থাপন করে থাকে বা তাদের ছবি ও পরিচয় প্রচার করে থাকে এবং তথাকথিত জব্দ করা জিনিসপত্র সাজিয়ে রেখে এমনভাবে উপস্থাপন করে থাকে ও বর্ণনা তুলে ধরে, যাতে বিচারের আগেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সমাজের চোখে দোষী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যান। অনেক সময় অনেকের ক্ষেত্রে নানারকম আপত্তিকর বিশেষণও ব্যবহার হয়। এমন ক্ষেত্রে গ্রেফতার ব্যক্তিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয় না। এতে যে সম্মানহানি ঘটে তা আর কোনো কিছুর দ্বারা পূরণ হয় না।
এমনকি, পরে আদালত কর্তৃক নির্দোষ প্রমাণিত হলেও তা পুনরুদ্ধার হয় না। ফলশ্রুতিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং তার পরিবারকে পরবর্তীতে নানারকম অসম্মান ও অপমানের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। নারীদের জন্য এটা হয় আরও বিব্রতকর ও অপমানজনক। বিষয়টি কেবল মানহানিকরই নয়, মানবাধিকারেরও সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এ ধরনের কর্মকাণ্ড বন্ধে বিভিন্ন সময়ে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও এগুলো এখনো পুরোপুরি বন্ধ হয়নি।
বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে নাগরিকদেরকে যেসব মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে, তন্মধ্যে ৩২ অনুচ্ছেদে আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা হতে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত না করার কথা বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে জীবনের অধিকার অর্থ সম্মানজনক জীবনকে বোঝানো হয়েছে। কিন্তু গ্রেফতার পরবর্তী সময়ে গণমাধ্যমে উপস্থাপনের সময় অভিযুক্তকে যেভাবে অসম্মানজনকভাবে উপস্থাপন করা হয়, তা উক্ত বিধানের পরিপন্থি।
৩৫ অনুচ্ছেদে- কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা না দেয় কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড না দেওয়া কিংবা কারও সঙ্গে অনুরূপ ব্যবহার না করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু গ্রেফতার পরবর্তী সময়ে গণমাধ্যমে উপস্থাপনের সময় অভিযুক্তকে যেভাবে অসম্মানজনকভাবে উপস্থাপন করা হয়, তাতে তার মানবিক মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয়। ৩৫(৪) অনুচ্ছেদে- অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য না করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু অনেক সময় গ্রেফতার পরবর্তী সময়ে গ্রেফতার ব্যক্তিকে গণমাধ্যমে উপস্থাপন করে কৃত অপরাধের বিস্তারিত বর্ণনা দিতে বাধ্য করা হয়, যা উক্ত বিধানের পরিপন্থি।
বিচার করার এখতিয়ার কেবল আদালতের। যতক্ষণ পর্যন্ত উপযুক্ত আদালত কর্তৃক একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি বিচার প্রক্রিয়া শেষে সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে দোষী সাব্যস্ত না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত চূড়ান্তভাবে বলা যায় না যে, তিনি প্রকৃত অপরাধী বা তার দ্বারাই অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। তাই অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতারের পরে বিচারের আগেই যদি পুলিশ মিডিয়ায় ঘোষণা দিয়ে বলে যে, তিনি অপরাধ করেছেন, তাহলে বিচারের প্রয়োজনীয়তা অর্থহীন হয়ে যায়।
অপরদিকে, সংসদ সদস্যদের বিশেষ প্রটোকল বাতিল করার প্রস্তাব করেছে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। সংস্কার প্রস্তাবে সংসদ সদস্যদের সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে বলা হয়েছে- (ক) সংসদ সদস্যদেরকে শুল্কমুক্ত গাড়ি ও আবাসিক প্লট প্রদান বন্ধ করা এবং বিভিন্ন ধরনের ভাতা প্রদানের বিধান পর্যালোচনা ও সংশোধন করা। (খ) একটি ‘সংসদ সদস্য আচরণ আইন’ প্রণয়নের মাধ্যমে সংসদ সদস্যদের বাৎসরিকভাবে সম্পদের হিসাব প্রদান এবং স্বার্থের দ্বন্দ্বের বিষয়গুলো ঘোষণা করা। (গ) সংবিধান লঙ্ঘন করে সংসদ সদস্যদের স্থানীয় উন্নয়নে জড়িত থাকার বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের আনোয়ার হোসেন বনাম বাংলাদেশ মামলার রায় কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা এবং সংসদ সদস্যদেরকে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টার পদ থেকে অপসারণ করা। (ঘ) সংসদ সদস্যদের জন্য বিশেষ প্রটোকলের অবসান করা। এ ছাড়া সংসদের ডিপুটি স্পিকার বিরোধী দল থেকে মনোনীত করার বিষয়েও প্রস্তাব করা হয়েছে।
এছাড়া ব্যক্তিগত স্বার্থে সাংবিধানিক ও আইনগত ক্ষমতার অপব্যবহার ও ঘুষ লেনদেনকে অবৈধ ঘোষণা এবং আইনে কালো টাকা সাদা করার বৈধতা স্থায়ীভাবে বন্ধ করাসহ ৪৭ দফা সুপারিশ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কার কমিশন। দুদককে শক্তিশালী, কার্যকর ও ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে কমিশনারদের পদ বাড়ানো, নিয়োগ, সার্চ কমিটি, আইনের সংস্কার, বেতন বৃদ্ধি ও প্রণোদনার জন্য সুপারিশ করা হয়।
দেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা ও গভীরতা বিবেচনায় যে ধরনের পেশাগত বৈচিত্র্য থাকা দরকার, সেটি নিশ্চিত করতে একজন নারীসহ পাঁচজন দুদক কমিশনার নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। তাদের মেয়াদ হবে চার বছর। নিয়োগেও বৈচিত্র্য থাকতে হবে। যেসব পেশা দুদকের কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বা যুক্ত সেখান থেকে দুদকের বিভিন্ন পদে নিয়োগ দিতে হবে। দুদকে শুধু আমলাদের নিয়োগে যে প্রধান্য দেওয়া হয়, তা থেকে সরে আসতে হবে। সংস্কার কমিশন চায় দুদক স্বাধীন ও কার্যকর হোক। তবে দুদকের কোনো স্বাধীনতা সীমাহীন নয়। দুদক যে কাজ করবে, তার জবাবদিহি থাকবে। ভালো কাজের যেমন প্রশংসা থাকবে, তেমন কাজ করতে না পারলে জবাবদিহি করতে হবে।
দুদকের চেয়ারম্যান ও কমিশনার নিয়োগে যে সার্চ কমিটি রয়েছে, সেটিকে সার্চ ও পর্যবেক্ষণ কমিটি করার সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। সার্চ কমিটির দুটি দায়িত্বের সুপারিশ করা হয়েছে। এর একটি, নিয়োগে যাচাই-বাছাই করা। অন্যটি, কমিশন কী কাজ করছে, সেটি পর্যবেক্ষণ করে ছয় মাস পরপর প্রতিবেদন দেওয়া।
রাজনৈতিক বিবেচনায় দুদকে নিয়োগ বন্ধে সাত সদস্যের বাছাই কমিটি করার সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। সেখানে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি, পরে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তি যিনি রয়েছেন, তাকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাছাই কমিটির প্রধান করার কথা বলা হয়েছে। এরপর সদস্য হবেন হাইকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, হিসাব মহানিয়ন্ত্রক (সিজিএ), সংসদ নেতার মনোনীত একজন, প্রধান বিরোধীদল থেকে মনোনীত একজন। এ ছাড়া একজন সরাসরি প্রধান বিচারপতি থেকে নিযুক্ত হবেন, যাঁর দুর্নীতিবিরোধী কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে।
দুদককে আমলাতন্ত্র মুক্ত করতে সচিব, মহাপরিচালক ও পরিচালক-পদগুলোতে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া নিজস্ব প্রসিকিউশন বিভাগ ও প্রশিক্ষণ একাডেমি করা, ৫৪ এর ৩ ধারা বাতিল এবং বেতন দ্বিগুণ করার সুপারিশ করা হয়েছে।
সুপারিশ করা হয়েছে দুদকে শৃঙ্খলা অনুবিভাগ রাখার। এটির দায়িত্ব হবে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে বরখাস্ত করা। কেউ যাতে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে না পড়েন, সে জন্য কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে নজরদারি অব্যাহত রাখার সুপারিশও করেছে কমিশন।
সভায় সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার, পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান এবং জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী অংশগ্রহণ করেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার প্রস্তাব তৈরির জন্য দুই ধাপে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে সরকার। প্রথম ধাপে জনপ্রশাসন, পুলিশ, দুর্নীতি দমন কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থা, সংবিধান ও বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন গঠিত হয় গত অক্টোবরে। দ্বিতীয় ধাপে গণমাধ্যম, স্বাস্থ্য, শ্রম, নারীবিষয়ক ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় সংস্কারের প্রস্তাব তৈরির জন্য আরও পাঁচটি কমিশন গঠন করা হয়।